ভূচং আর চূচং দু’জনেই আজ মন খারাপ। মন খারাপ না হয়ে উপায় কী? পা ভেঙে যাওয়ার পর ভূচংয়ের হাঁটা-চলা একদম বন্ধ। আর চূচং তো চোখেই দেখে না। তারই ওরা কোনো কাজকর্ম করতে পারছে না। কোনো রূপ দুষ্টমিও না। দুষ্টমি না করতে পেরে ওদের মাথা বিগড়ে গেছে। মাথা বিগড়ে গেলে কারো মন-মেজাজ ভালো থাকে না। ভালো থাকার কথাও না।
ভুতুড়ে ছেঁড়া কাঁথার ভেতর শুয়ে শুয়ে ভূচং মনে মনে ভাবে, যাদের পা নেই, চলতে পারে না, তারা আসলে দুনিয়াতে বড় দুখি। দুষ্ট ঘোড়া থেকে পড়ে পা-টা না ভাঙলে এই উপলব্ধিটা হত না। থাক! সবই কপালের ফের। নইলে আমার ঘোড়া চড়ার শখ জাগল কোন দুখে? চূচংটা বড় অসহায়। সে আমার চেয়েও দুখি। আমার তো কেবল একটা পা ভেঙেছে। আর সে হারিয়েছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ- চোখ। চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে গেছে বেচারা। ¯্রষ্টার কাছে শোকর! তিনি আমাদের মেরে ফেলেননি। বাঁচিয়ে রেখেছেন।
হঠাৎ চূচং কথা বলে ওঠল। ভূচংকে সে জিজ্ঞেস করল, কিরে পা ভেঙেছে বলে তুই কি খুব মন খারাপ করেছিস? খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি তোর?
ভূচং কোনো কথা বলল না। নীরব হয়ে রইল।
চূচং এবার ওর শরীর ঘেঁষে এসে বসল। ভূচংয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, মন খারাপ করিস না, দোস্ত! আমি তো আছি। চোখে দেখতে পাই না বলে কী হয়েছে। ভাবছিস শেষ হয়ে গেছি? না শেষ হয়ে যাইনি আমি। শেষ হয়ে যাবও না কোনোদিন। বুঝতেই পারছিস আমার মনে এখনো কত জোর। তোকেও আমার মত এমন শক্ত মনের হতে হবে। মনে সাহস রাখতে হবে। দৃঢ়-আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। সব সময় ভাবছি তোকে দিয়েই সব হবে। তুই আবারও আগের মত সবকিছু করতে পারবি, বুঝলি?
অন্ধ চূচংয়ের কথাগুলো যেন ভূচংয়ের মুখে প্রেরণার হাসি ফোটাল। শোয়া থেকে উঠে চূচংকে আবেগে জড়িয়ে ধরল সে। আনন্দে ভূচং কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, দোস্ত! তুই বড় ভালোরে। তুই বড় ভালো।
চূচং এবার বলল, একটি কথা সব সময় মনে রাখিস। তুই আর আমি দু’জন প্রাণের বন্ধু। সারা জীবন আমরা বন্ধু হয়েই থাকব। জীবনে চলার পথে যতই বাধা-বিঘœ, ঝড়-ঝাপটা আসুক না কেন, আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না। একসঙ্গে থাকব।
ভূচং বলল, তাই যেন হয় দোস্ত। তাই যেন হয়।
চূচং আরো বলল, তুই তোর চোখটা দিয়ে আমাকে কত সাহায্যই না করিস। আজ থেকে আমিও আমার পা-দুটো দিয়ে তোকে সাহায্য করব। তুই আমার কাঁধে চড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবি। আমি তোর দেখানো পথে হেঁটে যাব। বুদ্ধিটা কেমন? খুবই চমৎকার, তাই না?
চূচংয়ের কথা শুনে ভূচং এবার আনন্দে হেসে ওঠল। হেসে হেসেই বলল, দোস্ত। তুইও তো দেখছি বড্ড জিনিয়াসরে! ভেবে ভেবে কী দারুণ একটি বুদ্ধিই না বের করেছিস। আমি তো চিন্তায় চিন্তায় মরি। জীবনে কোনোদিন বুঝি আর দুষ্টমি করতে পারব না। তোর বুদ্ধিটা শুনে খুব ভরসা পেলাম। তারপর- কী মজা দুষ্টমি করতে পারব। কী মজা। কী মজা। বলে লাফ দিয়ে সে চূচংয়ের কাঁধে চড়ে বসল।
চূচং বলল, এখন বল কোন দিকে যাব?
ভূচং বলল, সোজা উত্তর দিকে যা। এই দিকে যা। এই দিকে বন। আজ দু’জন বনে বনে ঘুরে বেড়াব। পাখ-পাখালির গান শুনব। ফুলের সুবাস নেব। বুনো ফুলের মধু খাব।
যেতে যেতে দুজন বনের ঠিক মাঝখানে চলে এল। পথে কত গাছের সঙ্গে যে চূচং ধাক্কা খেল, কত গাছের পাতা ওর শরীর ছুয়ে গেল, তার হিসাব নেই। হঠাৎ সে বলে উঠল, দোস্ত। আমার শরীরটা না কেমন যেন জ্বলছে। শরীরের চামড়ায় এমন লাগছে কেন আমার, বলতে পারিস?
ভূচং বলল, ব্যাপারটা তো মনে হচ্ছে খুব রহস্যজনক। তোর শরীর জ্বলার তো কোনো কারণ দেখছি না।
চূচং বলল, তুই আমার কাঁধ থেকে একটু নাম তো। খুব অসহ্য লাগছে। নেমে দ্যাখ, ব্যাপারটা আসলে কী? আমার শরীরে বিছা পোকা-টোকা লাগল কিনা কে জানে।
চূচংয়ের কাঁধ থেকে নেমে এল ভূচং। তারপর আশ-পাশের গাছগুলোয় তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু না। কোথাও বিছা পোকার নাম-গন্ধ নেই। তাহলে ওর এমন লাগছে কেন? ভাবতে লাগল ভূচং।
হঠাৎ ওর চোখে পড়ল লম্বাটে পা’তাঅলা এক প্রকার গাছ। ঝোপাকৃতি গাছ। কতগুলো পাতা হাওয়ার ঝাপটায় ভূচংয়ের পিঠ ছুঁয়ে গেল। অমনি তার পিঠও জ্বলতে শুরু করল। ভূচংয়ের মনে এই গাছের প্রতি সন্দেহ দানা বাঁধল। তারপর একটি পাতা ছিঁড়ে এনে বাঁ হাতে ঘষল। সাথে সাথে জায়গাটা ফুলে ওঠল। ভূচং এতক্ষণে বুঝতে পারল, চূচংয়ের শরীর জ্বলার কী কারণ।
তারপর সে বলল, চূচং। সর্বনাশ হয়ে গেছে দোস্ত। আমরা ভুল করে চুতরা বনে ঢুকে পড়েছিরে। এ বনের সব গাছই চুতরা গাছ। চুতরা গাছের পাতা শরীরে লাগলে শরীর জ্বলে। চুলকায়। তোর শরীরে চুতরা পাতা লেগেছেরে। তাড়াতাড়ি চল, এ বন থেকে বেরিয়ে পড়ি।
চূচং উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, বড়ই বিপদ দেখছি। এখন কী হবেরে? তুই জলদি আমার কাঁধে চড়। তারপর কোন দিক দিয়ে যাব বল। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।
ওরা চুতরা বন থেকে বেরিয়ে এল। শরীর তবু জ্বলছে। প্রচন্ড রকম জ্বলছে। চুলকাচ্ছে। শরীর চুলকাতে চুলকাতে ওরা পথ চলছে। তারপর অনেকদূর এসে থামল। সামনে মস্তবড় একটি পাহাড় পড়ল। পাহাড় ভরা সবুজ গাছ-গাছালি। বড় বড় পাথর। পাথরের বুক ফেটে অবিরল ধারায় ধেয়ে চলেছে সুন্দরী ঝরণা।
ঝরনার কাছে এসে ভূচং ওর কাঁধ থেকে নেমে এল। তারপর দু’বন্ধু বড় একটি পাথরের ওপর বসে কিছু সময় বিশ্রাম নিল। ভূচং তার দেখা মত ঝরনার একটি চমৎকার বিবরণ শোনাল চূচংকে। ঝরনার এমন বিবরণ শুনে তো চূচং মুগ্ধ। চোখ নেই বলে সে ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছে না। মনে মনে সে খুব আক্ষেপ করল। ভূচংয়ের দেওয়া বিবরণ মনে গেঁথে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাল।
তারপর চূচং বলল, দোস্ত। শরীরটা এখনো খুব জ্বলছেরে। একটু কষ্ট করে তুই আমার শরীরটা ঝরনার জলে ধুয়ে দে না। ধুলে যদি কিছুটা আরাম পাই, মন্দ কী?
বন্ধুর আবদার ভূচং কী আর ফেলতে পারে? পারে না। শেষে ঝরনার স্ফটিক জলে ঘষে-মেজে চূচংয়ের শরীরটাকে সে ধুয়ে দিল। বরফ শীতল পানি শরীরে ঢাললে আরামই লাগে। নিজের গোসলটাও সেরে নিল ভূচং।
কিন্তু গোসল সারার পর মনে হল কেউ যেন শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। যন্ত্রণায় ওরা একেবারে নাচতে শুরু করে দিল।
নাচবে না তো কী করবে তোমরাই বল? চুতরা পাতা শরীরে লাগার পর পানি দিলে যে শরীর আরো বেশি করে জ্বলে। আরো বেশি চুলকায়। এটা কী ভূতদের কখনো জানার কথা? জানার কথা না। পরে কী আর করা লাফাতে লাফাতে আর হাঁপাতে হাঁপাতে আধমরী হয়ে দুজন বাড়ি ফিরে গেল।