মুসলিম স্যার নবম শ্রেণির ক্লাসে ঢুকেই ছাত্রছাত্রীদেরকে ‘বাংলার কৃষক’ শিরোনামে একটি রচনা লিখতে বললেন। এই স্যারের পুরো নাম ‘মুসলিম মিয়া’। শিক্ষার্থীদের বেশ ভালোবাসেন তিনি। স্যারের কথামতো সবাই রচনা লিখতে শুরু করল। স্যার চেয়ারে বসে বসে খবরের কাগজটাতে একটু চোখ বুলাতে লাগলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই লেখা জমা দিল। মুসলিম স্যার লেখাগুলো এক নজর দেখে দেখে রেখে দিতে লাগলেন। হঠাৎ একটি খাতায় তাঁর চোখ আটকে গেল! তিনি লেখাটি গভীর মনোযোগ সহকারে পড়লেন। এই লেখার মধ্যে কৃষকের ফসল তোলার সোনালি হাসি, উগার (ধান সংরক্ষণের গোদাম) ভরা ধানের গল্প, বন্যায় ফসলের তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কৃষকের করুণ কান্না, হেমন্তের নবান্ন উৎসব, কৃষকের স্বপ্ন, ধানক্ষেতের আল, লাঙল কাঁধে নিয়ে কৃষকের হেঁটে চলা, গোয়ালঘর, লাল দামা, কালো বলদ, দুধের গাভী, বাছুরের তিড়িংবিড়িং নাচ ইত্যাদি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে ‘বাংলার কৃষক’ শিরোনামের এই রচনায়! একদিন ভোরে কৃষক ঘুম থেকে উঠে দেখে তার লাল দামাটি মরে গেছে! তারপর কৃষকের সে কী কান্না! এক কথায় বাংলার কৃষকের পরিপূর্ণ বিষয় ফুটে উঠেছে এই রচনায়। রচনার শেষে লেখকের নাম উল্লেখ করা আছে। লেখক-মৃণাল কান্তি চক্রবর্তী।
মুসলিম স্যার অবাক হলেন! এমন প্রতিভাবান ছেলেও তাঁর বিদ্যালয়ে আছে। তিনি নিজে এত সুন্দর করে গুছিয়ে লিখতে পারতেন কিনা দশবার ভাবলেন!
শব্দের যে নিখুঁত গাঁথুনি তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কৃষকদের জীবনের বাস্তবচিত্র উঠে এসেছে এই প্রবন্ধে! অসম্ভব একটি কাজ করেছে তাঁর ছাত্র। মুসলিম মিয়া মনে মনে বললেন, ‘আমার যদি সুযোগ থাকত তবে এই প্রবন্ধটি পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে দিতাম। ছেলেমেয়েরা বাংলার কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র জানতে পারত।’
স্যার স্নেহভরা কণ্ঠে ডাকলেন, ‘মৃণাল!’
মৃণাল কান্তি চক্রবর্তী ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘জি স্যার’।
স্যার ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। মৃণাল কান্তি ঢোক গিলল! ভীষণ রকম ভয়! কারণ স্যারের হাতে তারই খাতা। অথচ খাতায় কী লিখেছে সে নিজেই জানে না।
মুসলিম স্যার বললেন, ‘মৃণাল, কাছে এসো!’।
মৃণাল ভয়ে কাঁপতে লাগল! ঢোক গিলে বলল, ‘স্যার এটি আমার লেখা নয়; দিলু লিখেছে স্যার!’
এবার স্যার দিলুকে কাছে ডাকলেন। দিলু নির্ভয়ে স্যারের কাছে ছুটে গেল। কারণ সে জানে এই রচনাটি তারই লেখা। স্যার দিলুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, ‘বড় হয়ে তুমি নিশ্চয়ই বিখ্যাত কেউ হবে। তোমার লেখার হাত খুব পক্ত।’
স্যারের কথা সেদিন দিলু বুঝতে পেরেছিল কিনা কে জানে। তবে দিলু সত্যি সত্যি বিখ্যাত হয়ে উঠল। দিলুর পুরোনাম দিলওয়ার খান। কিন্তু নিজের বংশীয় উপাধি নাম থেকে কেটে দিলেন তিনি। নামটি হলো দিলওয়ার। তিনি নিজেকে পৃথিবীর নাগরিক দাবি করতেন! তিনি বলতেন, ‘পৃথিবী স্বদেশ যার আমি তার সঙ্গী চিরদিন...’। দিলওয়ারকে ‘গণমানুষের কবি’ বলা হয়। একইসঙ্গে ছড়ার রাজাও তিনিই! পাঠ্যবইয়ে তাঁর লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একুশে পদকও।
সত্যি সত্যি বিখ্যাত হলেন দিলওয়ার! মুসলিম স্যারের চিন্তাভাবনাই সঠিক ছিল। পৃথিবীর এই নাগরিক ‘কবি দিলওয়ার’ প্রকৃতপক্ষে একজন বিশ্বকবি। তাঁর ইংরেজি ভাষাতেও রয়েছে মৌলিক সাহিত্যকর্ম! অতএব তাঁকে তো আমরা বিশ্বকবি বলতেই পারি। কিন্তু অনেকেই সেটা না বলে ‘সুরমাপারের কবি’ বলেই তৃপ্ত থাকেন। কারণ দিলওয়ার সারাটি জীবন যে কাটিয়ে দিলেন সুরমা নদীর তীরে...