আতংকের একটি দিন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুন ২০২১, ১০:১০:৪৬ অপরাহ্ন

জুঁই ইসলাম
২৯ মে সিলেটবাসীর জন্য এক আতঙ্কের দিন। বেশ কিছু দিন থেকে অসহনীয় গরম পড়েছে। ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগে না। অসহ্য গরমে কেউ কেউ বার বার গোছল করছেন, ঠান্ডা পানি খাচ্ছেন গ্লাসের পর গ্লাস কিন্তু কোন কিছুতেই গরম কম অনুভূত হয় না। গাছের পাতাগুলোও যেনো নড়ে না। বাতাস নেই, মেঘের দেখা নেই। এক অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে কেটেছে মানুষের জীবনযাত্রা। তাপমাত্রা একদিন থেকে আরেকদিন বেড়েই চলছিল। সবার একটিই প্রার্থনা ছিল আল্লাহ মেঘ দাও, ছায়া দাও কিন্তু আল্লাহ দিলেন ভূমিকম্প।
সেদিন রান্না করছিলাম। হঠাৎ একটা ধাক্কা। মনে হলে কেউ একটা ঝাঁকুনি দিল আমায়। সাথে সাথে চুলা অফ করে লা-ইলাহা-ইল্লাহ লা পড়তে পড়তে দৌড়ে বাইরে যাই। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। বাইরে গিয়ে দেখলাম আশ-পাশের মানুষও আল্লাহ আল্লাহ করছেন। পাশে হিন্দু বাসা থেকে যোগান দেওয়ার শব্দ শোনা গেলো। বিল্ডিং-এ যারা থাকেন তারাও নিচে নেমে এসেছেন। তারপর বাড়ির আশপাশের খবর নিয়ে আবারও রান্না করতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে আবার ভূমিকম্প। চুলা, গ্যাস অফ করে দৌড়ে বাইরে গেলাম। বাঁচার আকুতি কার নাই। ঘরের একজন সদস্য বাথরুমে ছিলেন তিনিও যতদ্রুত বের হয়ে এলেন বাইরে। এবার তো পা কাঁপতে শুরু করে দিল আমার। শুধু যে আমার তা না আমি জানি আমার মতো সিলেটের লক্ষ জনতার এমনই অবস্থা। দ্বিতীয় ভুমিকম্প চলে গেলো কিন্তু ভয় আর আতঙ্ক তো আর কাটে না ভেতর থেকে তো যায় না। পরপর দু‘বার ভূমিকম্প কেন হলো কি হচ্ছে এসব। অস্থিরতা আর ভয় কাটছে না তারপরও ঘরের কাজ করেই যাচ্ছি কিন্তু মনে সাহস পাচ্ছিলাম না কোনো মতে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি আর স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু আধা ঘন্টা যেতে না যেতে আবারও ধাক্কা। এখন তো ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবতে থাকলাম দুনিয়া কি শেষ হয়ে যাবে আজ? আখিরাত কি চলে এলো? এক ঘন্টার ভেতর তিনবার জীবনে তো এক সাথে এতো ভূমিকম্প দেখিনি। পৃথিবীর মায়া কি ত্যাগ করতে হবে আজ? হাত-পা কাঁপছিল ভয়ে এসব ভেবে। চারিপাশের মানুষের ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এতো সময়ে। সবার মুখে একটি কথা শোনা গেলো, এটা আমাদের পাপের ফল। দুনিয়াবাসী অনেক পাপ করছেন তাই সৃষ্টিকর্তা ক্ষেপে গিয়ে মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। কেউ বলছেন ছোট ছোট ভূমিকম্পের পর শক্তিশালী ভূমিকম্প হবে, আবার কেউ বলছেন ছোট ছোট ভূমিকম্পের ফলে শক্তিশালী ভূমিকম্প হালকা হয়ে যায়। নানা জনের নানা কথা এভাবেই কেটে গেলো আরও কিছু সময়। একে অন্যের খবর নিয়ে ব্যস্ত। সবাই সুস্থ আছেন কি না। শহর এলাকার বিল্ডিংয়ের মানুষের ভয় আরও তিনগুণ। কখন কি হয়। বার বার কেঁপে উঠছে ভূমি আর তারা নেমে আসছেন নিচে ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে সিলেট শহরজুড়ে। ঘন্টা খানেক পরে আরও একবার কেঁপে উঠলো সিলেটের জমিন। এই নিয়ে চার। কি আছে সিলেটবাসীর কপালে? একে অন্যকে জিজ্ঞেস করে আমরা কি শেষ হয়ে যাবো। তিন ঘন্টার ভিতর চারবার ঝাঁকুনি। কম বড় কথা নয়। বিশ্বের মধ্যে জাপানে এভাবে বার বার মৃদু ভূমিকম্প দেয় তাই জাপানিরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা কতবার কম্পন হলো তা কাউন্টও করে না কিন্তু আমরা তো জাপানি না জীবনে তো আমাদের দেশে এমন ঘটনার নজির নেই তবে আজ কেন এমন হচ্ছে। সিলেটবাসী আল্লাহকে স্মরণের সাথে সাথে আস্তাগফিরুল্লাহ পাঠ করে নিজ নিজ অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে শুরু করেন। কখন কি ঘটে যায় এই ভেবে বিভিন্ন মসজিদে দোয়া ও তওবা করানো হয়।
সময় যত যায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের দিকে সবার নজর। যদিও তারা ভূমিকম্প নিয়ে নিজেরা কোনো তথ্য দিতে পারেন না সবকিছু নির্ভর করে ঢাকা আবহাওয়া অফিসের কাছে। ঢাকা অফিস কোনো তথ্য সিলেট আবহাওয়া অফিসে জানালে সে তথ্যই সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়ে দেয় সিলেটবাসীকে। বিষয়টি জানতাম না । এই ঘটনার পর জানলাম। জানার পর মনে হলো সবকিছুর জন্য যদি ঢাকা অফিসের কাছে নির্ভর করতে হয় আমাদের, তাহলে আমাদের সিলেটে এসব অফিস রেখে লাভ কি। জনগণের রক্তচুষে গড়ে উঠা সরকারী ভবন আর কর্মচারীদের বেতনে চলে অথচ কাজের সময় ঘোড়ার ডিম। দেখা গেলো। এতো বড় একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগে আতঙ্কে আজ সিলেটবাসী অথচ তারা নিজস্ব কোন তথ্য দিয়ে সিলেটবাসীকে আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ।
দুপুর যখন প্রায় দুটো তখন আবার বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো আমাদের শহর। সবাই টেনশনে কি হলো । অনেকে কান্নাকাটি শুরু করলো। আমার পাশের বাসার কিছু ছোট ছেলে মেয়ের সে কি কান্না। আমি জানি এ শহরে বড়দের চোখের পানি না আসলেও ছোট ছোট বাচ্চারা ভয়ে কেঁদেছে। তারপর পর আরো দুটো কম্পন। ১০/১৫ মিনিটের ভেতর তিনটি কম্পন সিলেটিদের রীতিমতো হতাশায় ফেলে দিলো। বেলা সাড়ে দশটা থেকে দুপুর দুটো সাতটি ভূকম্পন। অনেকে দুপুরের খাবার, গোসল না করেই হায় আল্লাহ! হায় আল্লাহ করতে থাকেন। নামাজ, রোজা মানেন এ আশু বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার তাগিদে। পেরেশানি করে করে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকে কর্মস্থল থেকে বাড়িতে চলে আসেন আপনজনদের কাছে। আপনজনদের কাছে পাওয়ার আকুতি। তাই ফোনে যোগযোগ করে একে অন্যের খবর নিচ্ছেন, মাফ চাচ্ছেন যদি মারা যান এই ভয়ে।
ছোট ছোট ভূমিকম্পের ফলে বড় বা শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে এই ভয়ে অনেকে সিলেট শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন ২৯ মে বিকালেই যদি রাতে বড় কোনো আশংকাজনক কিছু ঘটে। এছাড়া কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং-এ যারা বসবাস করতেন তাদেরও দেখা গেলো ভয়ে বাসা ছেড়ে যাচ্ছেন। যেহেতু শহরের পাঠানটুলায় একটা বিল্ডিং অন্য একটা বিল্ডিং-এর সাথে হেলে পড়েছে এ খবর দেখার পর ভয় আর আতঙ্ক আরও বেড়ে যায় সিলেট বাসীর মনে।
২৯ মে সারাদিনই ভয় আর উৎকন্ঠায় কাটে সিলেটবাসীর। মানসিক ভাবে অনেকে ভেঙ্গে পড়েন। ভূমিকম্প না হলেও বার বার মনে করছেন এই বুঝি ভূমিকম্প হলো। মনের মাঝে প্রচন্ড ভয় নিয়ে রাতে বিছানায় ঘুমাতে গেলেও দেখা গেলো অনেকের চোখে ঘুম নেই। অস্থিরতায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। তারপর ভোর রাতে আবারও একটা কম্পন সিলেটবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। জানি ভয়াল এ দিনটিকে সিলেটিরা কোনো দিন ভুলবে না। শুধু সিলেট কেন সারা বাংলাদেশ মনে রাখবে। কারণ এই প্রথম আমাদের দেশে এতোগুলো ভূমিকম্প হলো এক সাথে।
দিন রাত মিলিয়ে মোট ৮বার কম্পন হলো অথচ তা শুধু সিলেট শহর এলাকায়। শহর থেকে একটু দূরে যারা তারা কোন ভূকম্পন ঠের পান নি। বিষয়টি অনেককে ভাবিয়ে তুললো। বিষয়টি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক কথাবার্তা মিডিয়া মারফরত দেখেছি, সেদিকে কর্ণপাত নাইবা করলাম। ঘটনা যাহাই হোক আল্লাহ হেফাজতের মালিক।
ইসলামি দৃষ্টিতে ভূমিকম্প কেন হয় একটু জেনে নিই। আল্লাহ তাআলা বলেন যখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে তখন কেবলমাত্র তোমার নিজের থেকেই (সুরা আন নিসা ৭৯)। মহান আল্লাহ অতীত জাতির উপর প্রেরিত আজাব সম্পর্কে বলেন- অতঃপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুণাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচন্ড ঝড় তুফান পাঠিয়েছি (প্রচন্ডপাথরের বৃষ্টি) যেভাবে লুত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল। কাউকে মহাগর্জন এসে আঘাত হেনেছে। যেভাবে শুয়াইব (আঃ) এর জাতির উপর এসেছিল। আবার কাউকে আমি পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। নূহ জাতি ও ফেরাউন ও তার লোকদেরকে যেভাবে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল (মূলত)। আল্লাহ তাআলা এমন ছিলেন না যে তিনি এদের উপর জুলুম করেছেন, জুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে। ( সুরা আল আনকাবুত-৪০)। অতএব বলা যায় যেকোনো দুর্যোগই মানবসৃষ্ট অপরাধ বা পাপের ফল। যা শাস্তি রূপে আল্লাহ তালা যুগে যুগে পাঠিয়ে থাকেন। তাই যারা অন্যের হক খান, সুদ খান, ঘুষ খান বা যেকোনো অপরাধের সাথে যুক্ত তাদের উচিৎ আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া। নিজ কর্ম ফলের অনুশোচনা করে তওবা করা। আল্লাহ মহান তিনি ক্ষমাশীল।
সিলেটের এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মাননীয় মেয়র ঝুঁকিপূর্ণ অনেক মার্কেট বা সরকারি ভবনগুলো ১০ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষনার দাবি জানান। যেহেতু ভূ-তাত্ত্বিকদের তথ্যমতে ছোট ছোট ভূমিকম্পের পরে অনেক সময় বড় ভূমিকম্প হতে পারে সেই জন্য জানমালের রক্ষার্থে তিনি ব্যবসায়ীদের এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান।
তবে এটা সত্য আমাদের চির সবুজ সিলেট শহরে আজ গাছপালার খুব অভাব। গাছ শূণ্যই বলা যায় সিলেটকে। যে পরিমাণ গাছ কাটা হয় দিনের পর দিন সে পরিমাণ গাছ রোপণের উদ্যোগ নাই আমাদের কারো। ভূমিকম্প থেকে রক্ষার জন্য পরিবেশ বান্ধব পরিবেশ তৈরী করতে হবে তাই সকলেরই উচিৎ বেশি বেশি গাছ লাগানো।
সবকিছুর মালিক আল্লাহ তারপরও সিলেটবাসীর মনে ভয় কাটেনি এখনো। ছোট ছোট ভূমিকম্প জন-জীবন অস্থির করে তুলেছে। কাজ কাম ঠিকমতো চললেও মনে অশান্তি বিরাজমান কখন কি ঘটে। এক সপ্তাহ বা দশ দিন ডেঞ্জারজোনে আছে বলা যায় সিলেটবাসী। যদি বড় ধরনের কোন ভূমিকম্প হয় তবে সিলেটের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হবে এ ভাবনায় কারো মন ভালো নেই। অনেকে মানসিক সমস্যায় ভোগছেন। তবে একটি কথা বিজ্ঞান তার বৈজ্ঞানিক ভাবনা থেকে এসব যুক্তি বলবে। আমাদের বিশ্¦াস রাখতে হবে আল্লাহর উপর। তাই অস্থিরতা নয় যার কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। আল্লাহ ভরসা। তিনি আমাদের লালনকর্তা, পালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা। তিনি সব ভালো জানেন। তিনি মহান। তিনি দয়ার সাগর। আমরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাই, সাহায্য চাই। তিনি আমাদের রক্ষা করতা, হেফাজত করতা আমিন।
লেখক : কলামিস্ট।