আন্তর্জাতিক নারী দিবস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ মার্চ ২০২১, ৩:৪৬:৪৯ অপরাহ্ন

ইছমত হানিফা চৌধুরী
নারী সম্পূর্ণ একটি মানুষ। আর সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সেরা। যেহেতু একজন পুরুষকে গর্ভে ধারণ করে পৃথিবীতে আসতে দেন নারী, তাই নারী নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আর তাই এই পৃথিবীতে তার বাঁচবার অধিকার, চলবার, বলবার, ভালবাসার, ঘৃণা করবার অধিকার জন্মগত। নিজের অধিকারের দায়িত্ব কেউ কারো হাতে অর্পণ করে না। যে সম্পর্ক মানুষের অধিকার হরণ করে, সে সম্পর্ক কখনোই কল্যাণকর নয়। এই বিষয়ে বলতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী হেনরি এ্যাডামস বলেছেন-‘নারীদের আছে খুবই ইতিবাচক চেতনা, যার ফলে তাদের আছে অধিকারবোধ, এই অধিকারবোধ সু-স্পষ্ট করতে নারী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন ৮ মার্চ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক নারী সমাজ এই দিনটি পালন করে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
ইতিহাসে অনুসরণ করে, নারী দিবসের পটভূমি বলতে গেলে বলতে হয় ‘১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সূচ কারখানার মহিলা শ্রমিকগণ কারখানার মানবেতর পরিবেশ, অসম মঞ্জুরী ও ১২ ঘন্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে তাদের উপর পুলিশী নির্যাতন শুরু হয় এবং বহু মহিলা শ্রমিক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। পরবর্তী সময়ে ১৮৬০ সালে ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সূচ কারখানার মহিলা শ্রমিকরা ‘মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন’ গঠন করেন এবং নিজেদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের দর্জি শ্রমিকরা নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৯১০ সালে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। এর সূত্র ধরে ক্লারা জেটকিন ১৯১০ সালে পার্টির সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রতিটি দেশের নারী শ্রমিকরা প্রতি বছর মার্চের যে কোন একটি দিন নারীর অধিকার রক্ষা দিবস হিসেবে পালন করবে। ১৮৫৭ এবং ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ সংগ্রামের সূচনা দিবস হওয়ায় ৮ মার্চকেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালনের জন্য নির্বাচন করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
সারা বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারী দিবস উদযাপনে প্রধান লক্ষ এক এক প্রকার হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয় আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি বেশি গুরুত্ব পায়। বিশ্ব আজ একবিংশ শতাব্দীতে পা রেখেছে। এগিয়ে যাচ্ছে নতুন সহস্রাব্দের দিকে। উন্নত সভ্যতার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা যখন বিশ্ব নারী দিবস পালন করছি তখনও সারা বিশ্বের নারী সমাজের অবস্থা এক রকম নয়। এটাই সত্য যে, গত তিন দশকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার নারী সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য যে, নারী সমাজের উক্ত অগ্রগতি কোন অবস্থাতেই একই সময়কালে পুরুষ সমাজ কর্তৃক অর্জিত অগ্রগতির সমকক্ষ নয়। আর উন্নয়ণশীল দেশগুলোতে নারী সমাজের অবস্থা তো এখনো রীতিমত আশঙ্কাজনক। এই সব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্রসীমার নিচে রয়ে গেছে প্রায় ৬০ কোটি নারী। আবার মজার বিষয় হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে দরিদ্র সীমার নিচে বাস করা নারীদের সংখ্যা কম নয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ইতালি, নরওয়ে, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারী দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে। কোন নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের কথা বাদ দিয়ে সমগ্র বিশ্ব-প্রেক্ষাপটের ছায়াতুল্য তথ্য তুলে ধরলে বর্তমান বিশ্বের নারীদের অবস্থা আরো স্পষ্ট হবে। বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ নারী এবং বিশ্বের দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারি ৭০ শতাংশ নারী।
বেগম রোকেয়া থেকে বেগম সুফিয়া কামাল পর্যন্ত যে সময় অতিবাহিত হয়েছে, সে সময়ে তারা যে বাংলার নারীর স্বীয় মর্যাদা, অধিকার নারীমুক্তির অবিচ্ছেদ্য সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তা আজ আমাদের কাছে নারী মুক্তি আন্দোলনের উদাহরণ ও প্রেরণা। তবে সামাজিক অবস্থান কেন জানি আজও নারীরাই পরিবর্তীত করতে ইচ্ছুক নয়। এর পিছনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, গোঁড়ামি প্রবল। ফলে নারী অধিকার সম্পর্কে বেশিরভাগ নারী অজ্ঞ। নারীর সমঅধিকার ও নারী মুক্তির কথা জোর গলায় বলা হচ্ছে, কিন্তু নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়নি। আজও অসংখ্যক নারী নানাভাবে নানামুখি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিংবা আপামর দৃষ্টিতে সর্বক্ষেত্রেই নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছে। আজও অসংখ্যক নারী এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে। এমন একটি দিনও নেই, যেদিন খবরের কাগজে না ছাপা হচ্ছে, যদিও বিভিন্ন উন্নয়ন-কর্মকান্ডে নারী সমাজের অংশগ্রহণও লক্ষণীয়। গার্মেন্টস শিল্পে লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক কাজ করছে। আবার পরীক্ষার মেধা তালিকায়ও মেয়েদের প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে। তারপরও কোথায় যেন চাহিদা এবং প্রাপ্তির অপূর্ণতা লক্ষণীয়। চাহিদা এবং প্রাপ্তির মেলবন্ধন সমান্তরাল না হয়ে এক এবং অভিন্ন গতির হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে প্রথম নারী দিবস পালিত হয় ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ। এরপর থেকে প্রতিবছর নারীদের সম্মান জানিয়ে দিবসটি পালনে করে আসছে বাঙালিরা বাঙালির নারী দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় সেইসব কীর্তিমান নারীদের, যাদের মধ্যে প্রথমে নাম আসে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, যিনি বেগম রোকেয়া হিসেবেই বেশি পরিচিত। নারীর প্রধান শক্তি হল শিক্ষা। মূলত বাংলার সামাজিক অবস্থায় এই শিক্ষার আলো নারী সমাজে পৌঁছে দিতে বেগম রোকেয়া উদ্যোগ নেন, এবং সফলতা আজও বয়ে যাচ্ছে।
নারী যদি শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয়, তবে সে সচেতন হয় না। তার আয় বাড়ে না। ফলে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়। যা নারীকে দুর্বল করে দেয়। নারীর প্রধান শক্তি হলো শিক্ষা। নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটলে নারীর কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। তাই নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ নারী শিক্ষা বিস্তার। উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল খ্যাত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসনীয় পদক্ষেপের একটি হচ্ছে সর্বস্তরে সর্বজনীন শিক্ষা। এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকার পরও প্রশ্ন আসে নারী শিক্ষার অগ্রগতি কতটুকু। সরকার বা সরকারিভাবে যা দরকার বা চালু আছে তা চলছে। কিন্তু এই আহ্বানে সামাজিক বা পারিবারিকভাবে আপামর জনগণ কতটুকু সুযোগ সুবিধা নারীদের দিচ্ছে। যতক্ষণ না আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর শিক্ষা লাভে ইতিবাচক দৃষ্টি পড়বে, ততক্ষণ নারীর শিক্ষার উন্নয়ন শতভাগ হবে না। শিক্ষা ছাড়া যে কোন মানুষ অন্ধ, সে নারী হউক কিংবা পুরুষ। তাই নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত নারী শিক্ষা বিস্তার।
এই নারী দিবসটির তাৎপর্য, বিশ্বজুড়ে নারীর অধিকার ও নারীদের অগ্রাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ছিল নারীদের অধিকার, বিশেষত কর্মজীবী নারীদের অধিকার আদায়ের প্রথম প্রচেষ্টা। এর সূত্র ধরে নারীদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। জাতিসংঘের মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয়েছে বিভিন্ন চুক্তি ও সনদ। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এসব সনদ, তথা সিদ্ধান্ত কার্যকরি ভূমিকা পালন করছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষায় এইসব চুক্তি ও সনদ আইনে পরিণত হয়েছে, বাধ্য করছে, মালিকপক্ষ এবং সরকারকে নারীদের দাবী মেনে নিতে। তাই হাজার সমালোচনা থাকলেও নারী দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম।
দেশের অর্থনীতিতে সমাজ বিনির্মাণে এখন নারীর অবদান অনস্বীকার্য। তবে স্বীকার করতেই হবে এ নারী এখনো ব্যাপক বৈষম্য-বঞ্চনা নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। পরিবার, সমাজ, বাইরের কর্ম জগৎ সর্বত্র অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে নারীকে। সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মান্ধতা এবং অশিক্ষার কারণেও নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্য আমরা দেখেছি। এছাড়া যৌতুক বাল্যবিয়ে, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ বা হত্যার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। যা কোনভাবেই শুভ হতে পারেনা। বন্ধ করতে হবে সব ধরনের নারী নির্যাতন। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর উন্নয়ন ছাড়া পরিবারের উন্নয়ন সম্ভব নয়, আর পরিবারের সমৃদ্ধি ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন অসম্ভব, সামাজিকভাবে উন্নতি সাধন হলে রাষ্ট্রের সফলতা আসে। রাষ্ট্র সাফল্য লাভ করলে তবেই বিশ্ব সভ্যতার দিকে হেঁটে যায়। তাই মনে রাখতে হবে যে, নারী শুধু পুরুষের নম্র সহচারী নয়। বর্তমান নারীর বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে উদাহরণে সবার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নারী অধিকার কয়জনে জানে, কিংবা কয়জনে বুঝে। সফলতা অতীতে ছিল বর্তমানে আছে ভবিষ্যতে থাকবে, নারী বীরাঙ্গনা বেশে যুদ্ধ করছে শত্রুর সঙ্গে। সাহসিক অভিযানে পাল্লা দিয়েছে পুরুষের সঙ্গে। রাজনীতিতে পুরুষের সহযাত্রী দেশের কাজে আত্মদানের গৌরবে গৌরবান্বিত। ধর্ম, সমাজ সংস্কারে নারীর ভূমিকা অনন্য। সাহিত্য বিজ্ঞানে বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে নারী। নারী এখন সংগ্রামী জীবনের অংশীদার। জীবন যুদ্ধে অন্যতম শরীক।
বস্তুত নারীর মর্যাদা আর অবস্থান থেকেই অনুধাবন করা যায়, একটি দেশ কতখানি সভ্য এবং উন্নত। তাই নারীকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাাদা দেবার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবক্ষেত্রে নারীকে দিতে হবে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক ও যথাযথ মর্যাদা। পরিশেষে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি : ‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী / অর্ধেক তার নর।’
নারী বিকশিত হউক, মানুষ হিসেবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সকল নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : শিক্ষক।