আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৩:৩৮:৪৯ অপরাহ্ন

রঞ্জিত কুমার দে:
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এর সাথে বাঙালির গৌরব ও বেদনার ইতিহাস জড়িত রয়েছে। নিজের মাতৃভাষার যথার্থ মর্যাদা আদায়ের জন্য কয়েকটি তরুণ প্রাণকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে এ দিনটি বেদনার রক্তে রঙিন। আবার ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের পথে বাঙালি তার স্বাধীকার অর্জনের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে বলে এদিনটি জাতীয় জীবনে একান্ত গৌরবেরও। প্রকৃতপক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার ন্যায্য অধিকার আদায়ের বলিষ্ট সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও বাঙালিদের অভিপ্রেত মুক্তি ও যে আসেনি তার প্রমাণ ভাষা আন্দোলন। বাঙালিদের উপর যে শোষণ চলছিল তা মাতৃভাষা বাংলাকেও অব্যাহতি দান করেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পরই বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বায়ত্বশাসন তথা স্বাধীনতার প্রস্তাব নিয়ে কেবিনেট মিশন আসে ভারতে। পাকিস্তানের জন্ম সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নের অব্যবহিত পূর্বে, বিশেষ করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়া উদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। পূর্ববঙ্গ হতে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন (১১ই শ্রাবণ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ)। এভাবেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল।
দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যার মাতৃভাষা বাংলা হলেও তার অমর্যাদা করে উর্দুকেই দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অশুভ চক্রান্ত চলে পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন কর্ণধার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এক জনসভায় একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুর কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু বাংলার জাগ্রত জনতা এই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে নি। প্রতিবাদে তখন বাঙালির কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে উঠে। পরবর্তীকালে খাজা নাজিমুদ্দিনের আমলে পুনরায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করার জোরালো প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের পর থেকে বাংলা ভাষার ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার যে ক্ষীণ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তা শাসকচক্রের অশুভ তৎপরতায় ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে। ফলে এ আন্দোলন সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের মধ্যে এ আন্দোলনের সূত্রপাত হলে সমগ্র বাংলাদেশের লোক এর সমর্থনে দাঁড়ায়। ভাষা আন্দোলনের উপর সরকারের যতই দমননীতি চলতে থাকে, আন্দোলন ততই প্রকট হয়ে উঠে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সারা দেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ধর্মঘট আহবান করা হয়। স্বৈরাচারী সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা-সমিতি ও মিছিল নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এবং সেখানে আন্দোলনকারী ছাত্ররা সমবেত হয়। মিছিল করতে উদ্যত হয়। সরকারের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ মিছিল করতে উদ্যত হয়। এ উদ্যোগ প্রতিহত করার জন্য পুলিশ মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখে ছাত্রদের উপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেক ছাত্র নিহত হয়। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয় গান, কবিতা ও নাটক। ফলে বাঙালির নবজাগরণ হয় আরও বেগবান ও কার্যকরী। এ জঘন্য হত্যাকান্ডের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমগ্র বাংলাদেশ প্রচন্ডভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আতঙ্কিত সরকার অবশ্য পরিণামে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাহ্যিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৫৬ সালের তৈরি পাকিস্তানের সংবিধানে। কিন্তু তা কাজ কর্মে প্রমাণিত হয়নি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও যে বর্বর হত্যাকান্ড সাধিত হয়েছিল তা স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর ভাবগম্ভীর পরিবেশে শহীদ দিবস উদযাপন করা হয়। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য কেবল শহীদ দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, তা বাঙালি জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ বাঙালি জাতির জন্যে এক বিরাট অর্জন। সারা বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশ নামে একটি দেশের কথা, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার কথা জানতে পারবে। ভবিষ্যতে ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এক বিরাট ভূমিকা পালন করবে। এ দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ বলেন-
‘আমি মুগ্ধ, আমি প্রীত আমাকে / স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের / কথা আমার ভাষায় জানতে পারব / বলে আমার হৃদয়-স্পন্দন বেড়েছে,/ সত্যি গর্বিত আমি।’
সর্বোপরি এ দিবসটির প্রায়োগিকতা ও প্রাপ্তি তিনটি, যেমন-(১) বাঙালি আত্মবিকাশে বিশ্বময় সহায়তা প্রাপ্ত হবে। (২) বাঙালির জাতিসত্তা ফুটে উঠবে। (৩) বিশ্ব সাহিত্য সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে ফুটে উঠবে বাংলা ভাষাভাষীদের অবিস্মরণীয় অবদান।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সদস্য দেশগুলোর কাছে তারিখে নির্ণয়ের সুপারিশ আহবান করে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও দিবসটি পালনের তাৎপর্য জাতিসংঘে উপস্থাপন করে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সবচেয়ে গৌরবজনক তারিখ হিসেবে উল্লেখ করে। ভাষার জন্যে জীবন দিয়েছে, যুদ্ধ করেছে একমাত্র বাঙালিরা। এ রক্তদান, আত্মাহুতির কারণেই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত তারিখটিকেই জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। মহান একুশ আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভাষা দিবস হিসেবে। বাংলাদেশের বাইরে বৃটেন, আমেরিকা, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত শহিদ মিনারের অনুরূপ শহিদ মিনার করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে থাকেন। আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি বাঙালিরাই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে দ্বিধা করেনি। বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের ভাষা শহিদদেরকে। জাতিসংঘের মহাসচিব এ দিবসটি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা প্রেরণ করে এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী তাদের জাতিসত্তার প্রধান বিবেচ্য বিষয় মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি তাই মাতৃভাষা রক্ষার প্রতীক হয়ে বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব লাভ করবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে বিশ্বের প্রায় ১৮৮টি দেশ পালন করছে। ফলে তারা বাংলা ভাষাভাষীদের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সভ্যতাকে জানতে আগ্রহী হবে। বাংলার বিখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিকের সৃষ্টি সম্পর্কে জানবে। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করবে। বিশ্ব জানবে, বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছে।
বিশ শতকের শেষপ্রান্তে এসে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো মাতৃভাষাগুলোর অধিকার এবং একে মর্যাদাপূর্ণভাবে টিকিয়ে রাখতে যে অনন্য সাধারণ সংগ্রামের সূচনা করল, তা সমগ্র বিশ্বের ভাষাপ্রবাহে অসামান্য অবদান রাখবে। একই সাথে এদিন বিশ্বের বৃহৎ ভাষাগুলোর পাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবহেলিত ভাষাগুলোও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে। কাল থেকে কালান্তরে মাতৃভাষার প্রতি বাঙালি জাতির দায়িত্ব শতগুণে বেড়ে গেল।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।