আল্লামা হাবিবুর রহমান (রহ.)
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মার্চ ২০২২, ৭:৩৫:১০ অপরাহ্ন

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমরা কারো না কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনতে পাই। জন্মিলে মরিতে হবে-এটা বিধির বিধান। তবে সবার মৃত্যু আমাদেরকে ভাবায় না, কাঁদায় না। কারো মৃত্যুতে মনের মানুষ কাঁদে, দুটি নয়ন কাঁদে, কারো মৃত্যুতে সমাজ কাঁদে, কারো মৃত্যুতে জাতি কাঁদে, কারো কারো মৃত্যুতে বিশ্বভুবন কাঁদে। কবির ভাষায় ‘মনের মানুষ চলে গেলে দুটি নয়ন কাঁদে/মহান মানুষ চলে গেলে বিশ্বভুবন কাঁদে।’ যাঁদের মৃত্যুতে দ্বীন ইসলাম, দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তাঁদের মৃত্যুতে দেশ ও জাতি কাঁদে, বিশ্ব ভুবন কাঁদে। তাঁদের মৃত্যু শোকে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যায় পুরো দেশ ও জাতি। কারণ তাঁদের মৃত্যুতে দেশ ও জাতি অভিভাবক হারা হয়ে যায়।
গত ০৫ রজব ১৪৪৩ হিজরি, ২৪ মাঘ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দ রোজ সোমবার সন্ধ্যা ৬.১০ ঘটিকায় আমাদের সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে যিনি এ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন, তিনি আর কেউ নন; তিনি হচ্ছেন জৌনপুরী সিলসিলার অন্যতম বুজুর্গ, শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী সাহেব কিবলার অন্যতম খলিফা, সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামের কৃতি সন্তান, সৎপুর দারুল হাদীস আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক প্রধান মুহাদ্দিস, ইছামতি আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ বিশ্ববরেণ্য শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান। হাদীস শাস্ত্রের বিদগ্ধ পন্ডিত হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। তিনি ছিলেন হাদীস বিষয়ের একজন তাত্ত্বিক বিশ্লেষক। হাদীস বিষয়ক কোন জটিল তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হলে এতদাঞ্চলের উলামায়ে কেরামগণ তাঁর শরণাপন্ন হতেন। তিনি তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের দ্বারা এর সার্থক সমাধান করে দিতেন। তিনি ছিলেন এতদাঞ্চলের মুহাদ্দিসগণের মধ্যমণি। হাদীসশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের কাছে সবাই ছিলেন নীরব, নিষ্প্রভ ও নিস্তব্দ। এই ভারতীয় উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের খেদমতে তাঁর অবদান অনবদ্য ও অপরিসীম।
পাক-ভারত উপমহাদেশে আমরা যাঁর ওছিলায় নবীজির পবিত্র হাদীস পেয়েছি, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান পুরোধা সেই শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর (১৭০২-১৭৬২ খ্রিস্টাব্দ) পবিত্র নীতি অনুসরণ করে যাঁরা নবীজির হাদীসের খেদমত করে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (মুহাদ্দিসে ইছামতি) তাঁদের মধ্যে একজন। শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (জন্ম ১৯৩৪ খ্রিঃ) সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি জামিউল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৫ সালের আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান এবং একই মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৭ সালে ফাজিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান এবং ১৯৫৯ সালে কামিল (হাদীস বিভাগে) পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করেন। অর্থাৎ প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ সহ তিনি মেধা তালিকায় স্থান লাভ করেন।
উল্লেখ্য যে, গাছবাড়ি মাদ্রাসার ইতিহাসে বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান লাভকারী প্রথম ছাত্র তিনিই। ইলমে কেরাত, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকাহ এবং ইলমে তাসাউফ প্রভৃতিতে তাঁর উস্তাদ-শায়েখগণের মধ্যে রয়েছেন শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী সাহেব কিবলা ফুলতলী (১৯১৩-২০০৮), শায়খুল হাদীস আল্লামা শফিকুল হক (১৯২৭-২০০১), শায়খুল হাদীস আল্লামা ইদরীস আহমদ (১৯২৪-২০০৭), শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতি আব্দুল গণি (১৯২০-১৯৮৭), শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল ওয়াহিদ (১৯০৮-১৯৮১), বাহরুল উলুম আল্লামা মুহাম্মদ হুসাইন (১৮৯০-১৯৭২), মুফতি সায়্যিদ আমিমুল ইহসান মুজাদ্দিদী বারাকাতি (১৯১১-১৯৭৪), মুহাদ্দিসুল হিজাজ সায়্যিদ মুহাম্মাদ বিন আলাওয়ী মালিকী আল-মাক্কী (১৯৪০-২০০৪), সুলতানুল উলামা সায়্যিদ সালিম বিন আব্দুল্লাহ শাতিরি শাফিয়ী ইয়ামনী (১৩৫৯-১৪৩৯ হিজরি) প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরাম। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ সাহেব কিবলা ফুলতলী (র.) ছিলেন একাধারে তাঁর ইলমে কেরাত, ইলমে হাদীস ও ইলমে তাসাউফের উস্তাদ। শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) ছাত্র অবস্থায়ই অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। এ বিষয়টি আল্লামা সাহেব কিবলা ফুলতলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ কারণে অতি অল্প দিনেই তিনি আল্লামা ফুলতলীর অত্যন্ত স্নেহভাজন-প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। তাঁর অসামান্য মেধা ও তাকওয়ার কারণে তাঁর প্রতি আল্লামা সাহেব কিবলা ফুলতলীর সুদৃষ্টি পড়ে যায়। ফলে তিনি সৌভাগ্যের পরশমণি হয়ে যান। ‘নিগাহে মর্দে মুমিনছে বদল জাতি হায় তাকদীরি’ অর্থাৎ প্রকৃত মুমিন বান্দাহর ক্ষণিকের দৃষ্টি মানুষের তাকদীর পরিবর্তন করে দেয়। আল্লামা সাহেব কিবলা ফুলতলী (র.) দিব্যজ্ঞানে বুঝতে পারলেন, তাঁর ছাত্র আল্লামা হাবিবুর রহমান এক সময় ইলমে, আমলে, তাসাউফে, ইবাদতে-রিয়াজতে বিশ্বখ্যাতি লাভ করবে। তাই তিনি তাঁর প্রতি পূর্ণ তাওয়াজ্জুহ ঢেলে দেন এবং তিনি তাকে মনের মত করে গড়ে তোলেন। কবির ভাষায় ‘মণির কদর বাদশাহ জানে আর জানে তা জওহরী/জানে বুলবুল ফুলের কদর আর জানে তা শাহপরী।’ আল্লামা ফুলতলীর সুহবত পেয়েই শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) এর জীবন প্রসন্ন হয়ে যায় এবং তাঁরই নির্দেশনাই আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) বিশ্বখ্যাতি লাভ করেন।
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) ১৯৫৯ সালে জকিগঞ্জের ইছামতি দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের শুভ সূচনা করেন। ১৯৬৩ সালে বিশ্বনাথের সৎপুর দারুল হাদীস আলিয়া মাদ্রাসায় প্রধান মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ইছামতি দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গমন করে প্রথমে উম্মুল কুয়াইন শহরে একটি মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। অল্পদিনের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সে দেশের বিচার বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি উম্মুল কুয়াইন কোর্টে বিচারক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮২ সালে আবারো তিনি ইছামতি আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম প্রচার ও হাদীস শিক্ষা দানের জন্য বিভিন্ন দেশে সফর করেন। তিনি যেসব দেশে দাওয়াতি সফর করেন সেসব দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মরক্কো, সিরিয়া, মিশর, সৌদিআরব ও ভারত। এসব দেশে সফরকালে তিনি অগণিত উলামায়ে কেরামগণকে হাদীসের দরস দান করেন। তিনি প্রায় প্রতি বছরই যুক্তরাজ্যে সফর করতেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন মাহফিলে যোগদান করে বয়ান পেশ করতেন এবং হাদীসের দরস দান করতেন। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্য সফরে তিনি একাধারে নয় মাস সেখানে অবস্থান করে লন্ডনস্থ দারুল হাদীস লতিফিয়ায় ‘শামায়েলে তিরমিজী’ নামক বিখ্যাত হাদীসের কিতাব সম্পূর্ণ দরস দান করেন। নিয়মিত এ দরসে ব্রিটেনের প্রচুর আলেম-উলামা ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করতেন। দরস পূর্ণ তিনি প্রায় দুই শতাধিক আলেমকে ‘শামায়েলে তিরমিজীর’ সনদ প্রদান করেন। এছাড়া দেশ-বিদেশের অগণিত আলেম-উলামা তাঁর নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করে সনদ গ্রহণ করেছেন।
ইসলামের দাওয়াত, হাদীসের দরস দানের পাশাপাশি শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীতে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির সিলেটের একজন খ্যাতিমান নেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নেজামে ইসলামের মনোনয়ন নিয়ে তিনি তখনকার সিলেট-৭ আসনে (জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও কানাইঘাট) এমএনএ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সম্মানজনক ভোট পেয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আঞ্জুমানে আল ইসলাহ মনোনীত ও সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ সমর্থিত প্রার্থী হিসাবে তিনি জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-৫ আসনে (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একজন প্রকৃত মর্দে মুমিনের মধ্যে যতগুলো উন্নত গুণাবলি থাকা দরকার সবগুলো তাঁর মধ্যে ছিল বিদ্যমান। তিনি ছিলেন তরীকতের শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ এবং উচ্চস্তরের একজন আল্লাহর ওলী। তিনি সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি সারাদিন হাদীস ও কিতাবাদী অধ্যয়নে মগ্ন থাকতেন এবং শেষ রাত তাহাজ্জুদ নামাজে কাটাতেন। হাজার হাজার আলেমের উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) এর যে খেদমতটি তাঁকে সবচেয়ে বেশি অমর করে রাখবে তা হচ্ছে তাঁর মূল্যবান লেখনি। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর রচিত ১৮টি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এসব গ্রন্থ পাঠ করে পথহারা মানুষ চিরদিন পাবে সঠিক পথের সন্ধান।
বরেণ্য মুহাদ্দিস আল্লামা হাবিবুর রহমান (র.) ছিলেন ইলমে হাদীসের অনন্য দিকপাল। তাঁর ইন্তেকালে দ্বীনি অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ হবার নয়। জকিগঞ্জের রারাই গ্রামে নিজের প্রতিষ্ঠিত আল-হাবীব জামে মসজিদের উত্তর পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতে উচ্চ আসনে সমাসীন করুন।