উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের গুরুত্ব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৪:১১:৪১ অপরাহ্ন

শেলী সেনগুপ্তা
কথায় বলে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’, এর সঙ্গে যদি জুড়ে দেওয়া যায় ‘গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে’, তা হলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজেই হয়। কিন্তু কথাটা শুধু মেয়েরাই জুড়ে দেয়, পুরুষরা নয়।
সংসারে নারী এবং পুরুষ একটি পাখির দুটি ডানা। একটি অচল হলে অন্যটিও ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অথচ সচল থাকা দরকার দুটি ডানাই। আমরা ভুলে যাই, এ সময় অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের উন্নত দেশকে ঊন্নয়নের চূড়ায় নেওয়ার জন্য সে দেশের নারীসমাজ ফলপ্রসূ অবদান রেখেছে। তবে এটা এখন আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে।
আবার এখন বাড়ছে বললেও ভুল হবে, প্রাচীনকাল থেকেই এটি হয়ে আসছে। সভ্যতার শুরুতে পুরুষ যখন শিকারে যেত, নারী তখন নিষ্ক্রিয় বসে থাকত না। আশপাশের বৃক্ষ থেকে ফল কুড়িয়ে এনে পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করত। সেসব ফলের বীজ বাসস্থানের আশপাশে ছড়িয়ে দিত। ওখানেই হতো নতুন ফলন। এভাবেই নারীর হাতে প্রথম কৃষিকাজের সূচনা হয়।
একইভাবে কুটির শিল্পের সূচনা ও প্রসার নারীর হাতে হয়। অবসরে সংসারে ব্যবহার্য সামগ্রী নিজেই তৈরি করে নিত। নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে তা বিনিময় প্রথায় অন্যদেরও দিত। এভাবেই সভ্যতার শুরু থেকে নারী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সভ্যতার শুরুতে যারা উন্নয়নে অংশ নিয়েছিল তারাই আবার দীর্ঘকাল থেকে আমাদের দেশে প্রথাবদ্ধ সংস্কার ও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। তারা প্রাতিষ্ঠানিক ও নাগরিক নানা সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত।
এখনো সন্তান প্রসব, সন্তান লালন-পালন এবং গৃহকর্ম সম্পাদনে নারীরা অনেক বেশি সময় দিয়ে থাকে। গৃহস্থালি এবং পারিবারিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কাজে নিয়োজিত নারীশ্রম অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলে গণ্য হলেও জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় না। তার পরও প্রায় অর্ধশতক ধরে সংগঠিত নারী মুক্তি আন্দোলন বিশ্বব্যাপী নারীর অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি, নারীর ক্ষমতায়নে নতুন ধ্যান-ধারণার বিস্তার ইত্যাদি অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণের পথ অধিকতর প্রশস্ত হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ দেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নারী অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাজে ক্রমবর্ধমান অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত নারীর শ্রমশক্তি প্রায় তিন কোটিরও বেশি, এর মধ্যে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা কাজে দশ হাজারেরও বেশি। অনেক বেশি পরিমাণে নারীশ্রম মৎস্য, বনায়ন, কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিয়োজিত। এ ছাড়া দেশের আরও এক একটি বড় অর্থনৈতিক খাত পোশাকশিল্পেও অধিকাংশ শ্রমিক নারী বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশি বৃহৎ ও ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাও এগিয়ে এসেছে। এই ক্রমবর্ধমান উদ্যোগ অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছে। এক সময় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও নারীরা নানা বৈষম্যের শিকার ছিলেন। বিয়ের পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ করেও নারীকে অধীনস্থ করে রাখার মানসিকতা লালন করত। এমনকি পশ্চিমা দেশে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত নারীদের ওপর বিবাহবিরোধী প্রথা আরোপ করে গুরুত্বপূর্ণ পদে আবেদন করা থেকে বিরত রাখা হতো। এই প্রথা বিধবাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতো।
এই একই আইনের আওতায় চাকরিরত অবস্থায় বিয়ে করলে চাকরিচ্যুত করা হতো। কিন্তু কোনো কোনো নারী তাদের কর্মযজ্ঞে এতটাই একনিষ্ঠ যে, প্রয়োজনে সংসারধর্মেও নিজেকে জড়াননি। এমনই একজন নারী জীববিজ্ঞানী ড বারবারা ম্যাক্লিন্টক। তিনি জীববিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।
১৯৮৩ সালে তিনি শরীরতত্ত্ব ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এককভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনিই প্রথম ভুট্টার ক্রোমোসোমে অবস্থান পরিবর্তনে সক্ষম বংশগতির উপাদান আবিষ্কার করেন। তিনিই প্রথম ভুট্টার জেনেটিক ম্যাপিং করেন। পরে ব্যাকটেরিয়া, ইস্টসহ আরও অন্যান্য জীবে ট্রান্সপোজেবল জেনেটিক এলিমেন্ট বা জাম্পং জিন আবিষ্কার করেন।
তার সময়ে তিনি গবেষণায় অনেক অগ্রগামী ছিলেন কিন্তু তার প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়েছিল অনেক পরে। এমন একজন মানুষকেও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তুলনামূলকভাবে আমরা একজন বেগম রোকেয়া পেয়ে, একজন ডা কাদম্বিনী দেবী পেয়ে পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর হতে পেরেছি। তবে এ কথাও ঠিক যে, তাদের চলার পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। এসব মহীয়সী নারী নিজেদের পায়ের রক্ত ঝরিয়ে উত্তরসূরিদের এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিয়েছেন। তাদের দেখানো পথে চলতে চলতে বাংলাদেশের নারীরাও এখন বহির্বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রগুলোতে চমৎকার অবদান রাখছে।
এই ক্রমবর্ধমান ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য বা আরও বর্ধনশীল করার জন্য নারী শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এ কথা অনস্বীকার্য, যে কোনো উন্নয়নের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ দেশের নারীরা বুঝতে পারল এখন সময় হয়েছে ‘রাঁধার পরে খাওয়া, খাওয়ার পরে রাঁধা’র চক্র থেকে বের হয়ে আসার, ঠিক তখনই আলোর পথের যাত্রী রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বেগম রোকেয়া নারী সমাজের সামনে একটা আলোকশিখা প্রজ্বলিত করলেন যেন সেই আলোতে নারী এগিয়ে যেতে পারে।
নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে আরও বেশি সহায়ক ভূমিকা রাখছে বর্তমান নারীবান্ধব সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সবকিছুর মূলে শিক্ষাকে জায়গা দিয়েছেন। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীর শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন- সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য খাদ্য কমর্সূচি রয়েছে। পৌরসভার বাইরে বিনা বেতনে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ আর মহানগরের বাইরে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তির সুযোগ রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে। নারী শিক্ষার্থীর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার একগুচ্ছ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে হবে, আর এটি করতে হলে সমাজের প্রধান অর্ধাংশ নারীকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা জানি নারী এবং পুরুষ, একটি পাখির দুটি ডানার মতো। পাখির ওড়ার জন্য দুটি ডানাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটি ডানা দুর্বল হলে পাখি উড়ানরহিত হয়। তেমনি পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও আরও বেশি করে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হতে হবে। তেমনি নারীকে আরও বেশি বেশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে।
সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সানন্দে গ্রহণ করে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে, এই এগিয়ে যাওয়া আমাদেরকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি শুধু নয়, বরং তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। আমরাও হয়ে উঠব উচ্চ আয়ের দেশ, মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি আমাদেরও থাকবে। শুধু দরকার আন্তরিক সদিচ্ছার।