উন্নয়ন ও দুর্যোগের ঝুঁকি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২২, ৯:০৯:৩৮ অপরাহ্ন

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
নিকট অতীতে সিলেট-সুনামগঞ্জের বাসিন্দাদের এত ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখী হতে হয়নি। একদিকে টানা বৃষ্টি, অন্যদিকে বন্যায় কীভাবে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তা আমরা আরেকবার দেখলাম। বন্যায় বিদ্যুকেন্দ্র ডুবে স্বাভাবিক সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সেখানকার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। আমি তিন দিন চেষ্টা করে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছি। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। এমন পরিস্থিতি আগে কখনও হয়নি। আমরা যদি আগে থেকেই সেসব এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে পারতাম, তাহলে এভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হতো না। অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা নিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলেই তাঁরা যাবেন।
এই বিপর্যয়ের সময় সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি আটকে পড়া পর্যটকদেরও উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এই মানবিক বিপর্যয়ের সময়ও আমরা কিছু অমানবিক কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছি। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে পারাপারে এক নৌকার মাঝি ৪০-৫০ হাজার টাকা দাবি করেছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় ডাকাতির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যুগ যুগ ধরে দেখেছি মানুষের বিপদে প্রতিবেশীকে এগিয়ে আসতে। কিন্তু চলতি দুর্যোগের সময় এ ধরনের অমানবিক আচরণ অপ্রত্যাশিত।
বন্যা কেন হলো- এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের মত তুলে ধরছেন। সীমান্তের ওপারে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, নিম্নচাপ, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াকে বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ। তাই বন্যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও এবারের বন্যার বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে আমাদের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে কিনা- সে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবে ক্ষতি নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল বিষয়ে আমরা যতটা কথা বলি, ততটা কিন্তু অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে বলি না। সিলেট-সুনামগঞ্জ মে মাসের বন্যার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই আবার জুনে এসেছে বন্যা। এটা দেখিয়ে দিল, শুধু উপকূলীয় এলাকা নয়; দেশের যে কোনো প্রান্তে দুর্যোগজনিত জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সেভাবেই এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। এক কথায়, আঞ্চলিক সমন্বয় বাড়াতে হবে। এটা এখানে থেমে থাকবে না। আমরা যত কথাই বলি না কেন; সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে যে এসব বিপর্যয় হচ্ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।
এটা ঠিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ে আমাদের হাত থাকবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে দাবি তুলে ধরতে তো বাধা নেই। দুর্যোগের জন্য প্রতিবেশী দেশ বা অন্য কেউ দায়ী হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে। আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা নিজেদের রোল মডেল বলি। বাজেটে বড় বরাদ্দ রাখি। অথচ সেই অর্থের স্বচ্ছ ব্যবহার সম্পর্কে আমরা জানি না। এখন সময় এসেছে সেই অর্থের সঠিক ব্যবহারের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা রাস্তা বানানোর জন্য হাওর ভরাট করে ফেলতে কুণ্ঠা বোধ করি না। এভাবে হাওর-জলাশয় ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করে এ ধরনের পরিণতি ডেকে এনেছি কিনা, সেটাও দেখার বিষয়। নাটোরে চলনবিল কিংবা কিশোরগঞ্জে হাওরের ওপর সড়ক নির্মাণ করলে স্বাভাবিকভাবেই পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে। এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করলেও আমরা শুনছি না। আমাদের টাকায় নদনদী, খালবিল ও জলাশয় একবার খনন করা হয়; আবার কিছুদিন পর ভরাট করা হয়।
এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বাংলাদেশ পুরোপুরি দায়ী- এটা বলা যাবে না। তবে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ, পলিথিনসহ অন্যান্য বর্জ্য ফেলে নদী ভরাট, হাওরের মধ্যে সড়ক নির্মাণ করে পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দায় আমাদের। শুধু প্রতিবেশী দেশের পলি এসে নদী ভরাট করে ফেলছে বলে দায় এড়ানো যাবে না। উন্নয়ন করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ানো যাবে না। না হলে দুর্যোগের মাত্রা বাড়তেই থাকবে। ভারতের সঙ্গে এসব বিষয়ে যৌথ উদ্যোগ ও সমঝোতায় আসতে হবে।
যত কথাই বলি না কেন, এবারের বন্যার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থেকে যাবে। পানি নেমে যাওয়ার পর সংকট আরও বাড়বে। যাঁরা ঘরবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বন্যাপরবর্তী সময়ে নানা রোগ দেখা দেবে। তা মোকাবিলায় পাশে থাকতে হবে। আমরা অতীতে আইলার সময় দেখেছি, দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পর অনেককে আর পাশে পাওয়া যায় না। এবার যেন সেটা না হয়। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে, তা অপ্রতুল। তাই এসব মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে এবং এক থেকে দেড় মাস পর এসব ভুলে গেলে চলবে না। গতানুগতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসে না। তাই ভবিষ্যতের জন্য উন্নয়নকে ঢেলে সাজাতে হবে। গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে। সিলেট অঞ্চলে কেন ঘন ঘন বন্যা আঘাত হানছে, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় পূর্বাভাস দিতে হবে। বলা হচ্ছে, সিলেট-নেত্রকোনা-উত্তরাঞ্চলের এ বন্যা দেশের মধ্যাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে দক্ষিণাঞ্চল প্লাবিত হওয়ারও পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। পূর্বাভাস যেন সান্ত্বনা না হয়।
পূর্বাভাস দেওয়ার পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের প্রস্তুত করতে হবে। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আমাদের ন্যায্য দাবি তুলে ধরতে হবে। আগেই বলেছি, ভাটির দেশ হওয়ায় আমরা এসব দুর্যোগ ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তবে ভারতের সঙ্গে আরও চৌকসভাবে কাজ করতে হবে।