উপনিবেশ, ক্লাব ও বর্ণবাদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মে ২০২২, ৬:০৫:২০ অপরাহ্ন

মাহমুদুর রহমান
মহাত্মা গান্ধীর জীবন সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে বিলাতে তাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়ার ঘটনাটি বিশেষভাবে উঠে আসে। ঔপনিবেশিক কালপর্বে বর্ণবাদ যে ব্রিটিশদের আচরণে প্রকট ছিল তা সবার জানা। ভারতীয়দের কাছ থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখার সব রকম চেষ্টাই তারা করেছে। এ সময়ে ব্রিটিশদের সংস্কৃতি চর্চা ও সামাজিক মেলামেশার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্লাব চালু করা হয়। ক্লাবের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল এর সদস্যদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ কমিউনিটির ঐক্য তৈরি করা। কিন্তু উদ্দেশ্য তা হলেও কার্যক্রম চালু হতে না হতে ক্লাবগুলো কিছু নিজস্ব চরিত্র প্রকাশ করে। বিত্ত-বৈভব প্রকাশের পাশাপাশি উন্নাসিকতা, বর্ণবাদ ও বৈষম্য ক্লাবের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।
ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে একটা সময়ে ক্লাবগুলো রাজনীতি, ব্যবসা ও সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে যুক্তদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, কিন্তু সে সময়ে ভারতীয়রা লক্ষ করে ওই কেন্দ্রে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রায় শূন্য। এখনো যে ক্লাবগুলো রয়েছে, সেখানে সদস্য নেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নেয়া হয়। ক্লাবের এ ধরনের নিয়ম বা মানসিকতা ঔপনিবেশিক আমলেই তৈরি হয়। এ সম্পর্কে লিওনার্ড ওল্ফ তার আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘শুধু সেরা মানুষেরা এবং অবশ্যই সাদা চামড়ার মানুষেরা সদস্য হবেন।’ কিন্তু এ প্রসঙ্গে আবার অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন। ওল্ফের কথার বিপরীতে বলতে গিয়ে মাদ্রাজ ক্লাবের এককালের প্রেসিডেন্ট সিপি হুগস বলেন, ‘এখানে বৈষম্য ছিল কিন্তু সেটা বিশেষভাবে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে তা নয়। প্রশ্নটা ছিল আভিজাত্যের।’
হুগসের বক্তব্যে শব্দটা ছিল ‘স্ট্যাটাস’। তার কথার অর্থ দাঁড়ায়, স্ট্যাটাস থাকলে ভারতীয়রাও সদস্য হতে পারতেন কিন্তু আমরা জানি, এমন অনেক ক্লাব ছিল যেখানে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার ছিল না। তাদের এ ধরনের নীতির অর্থ ছিল এখানে কেবল ইউরোপীয়রাই সদস্য হতে পারবেন। বিষয়টি তারা বেশ গর্ব করেই বলতেন। জর্জ অরওয়েলের বার্মিজ ডেজ বইয়ে পাওয়া যায় সেখানকার ক্যুকটাডা ক্লাব গর্ব করে বলছে, ‘এটি বার্মার একমাত্র ক্লাব, যেখানে কখনো কোনো ওরিয়েন্টালকে সদস্যপদ দেয়া হয়নি।’ অবশ্য এখান থেকে আরেকটি তথ্য পাওয়া যায়। ক্লাবটি নিজেকে একমাত্র ক্লাব বলছে, যার অর্থ হলো অন্যান্য ক্লাবে ‘ওরিয়েন্টাল’দের প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু এখানে প্রহসনের ব্যাপারটি এমন ছিল যে ক্লাবগুলো এমন নীতি গ্রহণ করত, সেখানে ভারতীয়রা সদস্য হওয়ার আবেদনই করতে পারত না।
ব্রিটিশদের ক্লাবে ভারতীয়দের (সেকালের ভাষায় ‘নেটিভ’) প্রবেশাধিকার না থাকার বিষয়টি নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত আছে। ঔপনিবেশিক ক্লাব শুরুর অর্ধশতাব্দী পরেও এ ধরনের বিধিনিষেধ চালু ছিল। ভারতীয়রা যখন সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে শুরু করে, সে সময়েও তারা বহু ক্লাবে প্রবেশাধিকার লাভ করতেন না। যেমন এমএ হুসেন নামে এক আইসিএস তার সঙ্গী হামিদকে নিয়ে লাহোরে পাঞ্জাব ক্লাবে তার সহকর্মী জন আবেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলে গেটের গার্ড জানায়, এখানে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার নেই। হুসেন তার স্মৃতি থেকে লিখেছেন, ‘পরবর্তী দিন আবেল খোদ তাদের সেটলমেন্ট অফিসে ডেকে এ ঘটনার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন নিয়মটি তার জানা ছিল না।’ আবেল আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি নিয়মটি পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। ক্লাবের নীতি পরিবর্তিত হয়, কিন্তু হুসেন এ সম্পর্কে আর খোঁজ রাখেননি। তবে একসময় দেশীয়রা পাঞ্জাব ক্লাবসহ আরো অনেক ক্লাবে যুক্ত হওয়ার অনুমতি পেয়েছিল।
এখানে প্রশ্ন আসে ক্লাবে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি কী? প্রথমত, ক্লাবে সদস্য হতে হয় এবং সদস্যরা ক্লাবের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করেন। ঔপনিবেশিক আমলে কোনো কোনো ক্লাব ভারতীয় অভিজাত যেমন রাজা, যুবরাজদের ক্লাবে প্রবেশাধিকার দিত। পরবর্তীকালে ভারতের বড় বড় ব্যবসায়ীও এ অধিকার লাভ করেন। কিন্তু ক্লাবের নির্বাচনে ভোটদানের কোনো অধিকার তাদের দেয়া হতো না। ভারতের স্বাধীন রাজ্যগুলোর রাজা ও যুবরাজদের এসব ক্লাবে যুক্ত করার কারণ ছিল তাদের সহায়তা লাভ করা। তোষামোদে খুশি হয়ে অনেক রাজা মহারাজা ক্লাবে অনুদান দিতেন। অর্থাৎ এ সময় ভারতীয়রা ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হন। এমনকি তাদের সাম্মানিক সদস্যও করা হতো। ব্রিটিশ সদস্যদের সঙ্গে আগত ভারতীয়দের ক্লাবের অতিথি হিসেবে আতিথ্য দেয়া হতো। তারা ক্লাবের বিভিন্ন সুবিধা উপভোগ করতেন। কিন্তু ভোটাধিকার দেয়া হয়নি।
ক্লাব প্রতিষ্ঠার একটি উদ্দেশ্য হিসেবে সামাজিক মেলামেশা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। কিন্তু সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশকে সদস্য করে বাকিদের নানাভাবে বাদ দিয়ে সামাজিক মেলবন্ধন তৈরি করা যায় না। ভারতীয়দের কার্যকরী সদস্যপদ না দেয়ার কারণে ঔপনিবেশিক ক্লাব প্রথমেই একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। কাজটি নিঃসন্দেহে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতীয়রাও একই কাজ করে। কেননা ব্রিটিশদের ক্লাবে যুক্ত হতে না পেরে তারা নিজেদের ক্লাব চালু করলেও সেখানে প্রায় একই প্রকারের নীতি গ্রহণ করা হয়।
ভারতীয় ধারায় ভারতীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ও সমাজসেবীরা ক্লাব চালু করেন। এক্ষেত্রে ফিরোজ শাহ মেহতার নাম প্রথমে আসে। ১৮৮৪ সালে তিনি মুম্বাইতে সমমনা কিছু মানুষকে নিয়ে একটি নতুন ক্লাব করার পরিকল্পনা করেন। মেহতা যাদের নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, সবাই ছিলেন বিলাতফেরত অভিজাত পারসি। এর আগে ফিরোজ শাহ এলফিনস্টোন ক্লাব তৈরি করেন। তবে সেখানে মূলত তার বন্ধুরাই সদস্য ছিল। ফিরোজ ভাবলেন বিষয়টি থেকে সরে আরো মানুষকে যুক্ত করা উচিত। একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন, The Elphinstone Club was extended and enlarged into a Club in which every Parsi, who wished to live in an atmosphere of high ideals and noble thoughts, was welcome. (Hear, hear.) This idea, gentlemen, has been the seed of the Ripon Club.’
মেহতা কর্তৃক স্থাপিত রিপন ক্লাব সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানায়নি। ক্লাবটিতে পারসি সম্প্রদায়ের যাদের ‘সামাজিক মর্যাদা’ রয়েছে, তাদের সদস্যপদ দেয়া হতো। অন্যদিকে ক্লাবটি ইউরোপীয়দের প্রতি আন্তরিক। ১৮৮৫ সালে লিওনেল টেনিসন (কবি আলফ্রেড টেনিসনের পৌত্র) এ ক্লাবে এসেছিলেন। তিনি দেখেন, ক্লাবটি পারসি সমাজকে একত্র করার চেষ্টা করলেও ইউরোপীয়দের কেবল অতিথি হিসেবেই গ্রহণ করত। তাদের সদস্য করা হয়নি। লিওনেল লেখেন, ‘স্থানীয়দের এতদিন আলাদা করে রাখার প্রতিশোধ হিসেবে তারা এবার ইউরোপীয়দের বাতিল করে দিয়েছে। পারস্পরিক এ অসহিষ্ণুতা আমাকে সবচেয়ে বেশি আহত করেছে।’ টেনিসনের কথার সূত্র ধরে খুঁজতে গেলে দেখা যায় ১৮৯৪ সালে শ্রীলংকায় সিংহলি সম্প্রদায়ের দ্বারা চালু হওয়া ওরিয়েন্ট ক্লাবে শ্বেতাঙ্গদের প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি। গার্ডেন ক্লাবে ‘নেটিভ’দের প্রবেশাধিকার না থাকার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
প্রবেশাধিকার বা সদস্যপদের প্রসঙ্গে বলতে হয় এসব ক্লাব কখনই সাধারণ মানুষের জন্য খোলা হয়নি। ওল্ফের ভাষায় নবংঃ ঢ়বড়ঢ়ষব সদস্যপদ লাভ করত। সহজ কথায়, ক্লাবটি ভারতীয়দের হোক কিংবা ব্রিটিশদের, সেখানে ওই দেশীয় বা সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষ সদস্য হতে পারত। স্বভাবতই ব্রিটিশ প্রধান ক্লাবগুলোয় সিভিলিয়ানদের তুলনায় সেনা বিভাগের বড় কর্তাদের আনাগোনা ও সম্মান ছিল বেশি। ছোট পদের সেনারা যদিবা ক্লাবের সদস্য হতেন, তাদের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই থাকতে হতো। ক্লাবের সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে কেবল অর্থনৈতিক অবস্থাই নয় বরং পারিবারিক আভিজাত্যও বিবেচনা করা হতো। এক্ষেত্রে সদস্য বাছাই ও অনুমোদনের জন্য প্রতিটি ক্লাবের নিজস্ব নীতিমালা ছিল। উনিশ শতকে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হওয়ার পর ক্লাবের নীতিমালা ও ক্লাব কালচারে কিছু পরিবর্তন আসে। তবে এর আগে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে সুযোগ দেয়া হয়। যেমন ক্যালকাটা ক্লাবে ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ‘বক্সওয়ালা’দের সদস্যপদ দেয়া হয়। কিন্তু বেঙ্গল ক্লাব তাদের গ্রহণ করেনি।
ক্লাবে শ্রেণীভেদের ব্যাপারটি যে কেবল ভারতীয় এবং ব্রিটিশ বা ইউরোপীয়দের মধ্যে কাজ করেছে এমন নয়। পূর্বে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক অবস্থা ও পদমর্যাদা অনুসারে ব্রিটিশরাও ক্লাবে বিভাজিত ছিলেন। প্রথমত, বেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতারা কোম্পানির কর্তাব্যক্তি ও সিভিল সার্ভেন্টদের অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু এখানে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা সদস্যপদ লাভের জন্য বিবেচিত হতেন না। বেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাস লিখতে গিয়ে প্যানক্রিজ বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যবসায়ীর নাম সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি হয়তো ভুলক্রমে প্রচারিত। অভিজাত ও অর্থবলে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী এ ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। এদের মধ্যে হায়দরাবাদের পামার অ্যান্ড কোংয়ের জন পামার, ক্যাকিনটশ অ্যান্ড কোংয়ের জেমস ক্যাডলার এবং গুটিকয় বড় ব্যবসায়ী ক্লাবের প্রথম দিকের সদস্য ছিলেন। কিন্তু এর বাইরে সাধারণ ব্যবসায়ীদের এ সুযোগ দেয়া হয়নি। মূলত ক্লাবের হয়ে ক্লাবের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি রূঢ় সত্যটি উল্লেখ করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে ‘অবহেলিত’ ব্যবসায়ীরা ১৮৮২ সালে নিজেদের উদ্যোগে ক্যালকাটা ক্লাব নামে একটি ক্লাব শুরু করেন (পূর্বে উল্লিখিত ক্যালকাটা ক্লাব নয়)।
এ তো গেল ব্রিটিশদের শ্রেণীভেদ। দেশীয় উদ্যোগে যে ক্লাবগুলো চালু করা হয়, সেখানেও শ্রেণীভেদ ও আভিজাত্যের অহংকার থানা গেড়ে বসে। দেশীয় রাজারা ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করলেও তারা অনেক ধরনের সুবিধা নিতে পারতেন না। এ কারণের পাশাপাশি ব্রিটিশদের টেক্কা দেয়ার ইচ্ছা থেকে নিজেদের উদ্যোগে তারা নিজস্ব ক্লাব চালু করার চিন্তা করেন। বালাসোরের প্রিন্সলি স্টেটের রাজা বৈকুণ্ঠনাথ দে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ১৯০২ সালে তিনি একটি ক্লাব তৈরির জন্য রাজবাড়ীর অংশবিশেষ দান করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু এ ক্লাবের দেশীয় সদস্য হিসেবে তিনজনের বাইরে কাউকে অধিকার দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাগানটি একটি ক্লাবের জন্য বিনা ভাড়ায় দান করতে চাই, যেখানে ক্লাবের সদস্য হবেন নির্দিষ্ট ইউরোপীয় ও দেশীয় ব্যক্তি: দেশীয় ব্যক্তি হিসেবে আমার সঙ্গে কেবল ময়ূরভঞ্জ ও নীলগিরি রাজাই সদস্য হতে পারবেন।’ অর্থাৎ, নিজস্ব স্টেটে তার সম্পত্তির অংশে তৈরি ক্লাবে সদস্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈকুণ্ঠনাথ কেবল নিজের সমপর্যায়ের ব্যক্তিকেই গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন। এর পেছনে একটি ঔপনিবেশিক মানসিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। রাজা ইউরোপীয়দের সঙ্গে নিজেকে বসিয়ে দেশীয়দের মধ্যে নিজেকে উচ্চ আসন প্রদান করার মানসিকতা দেখিয়েছেন। মূলত ক্লাবগুলো এ ধরনের মানসিকতা তৈরি এবং বিস্তারে সহায়তা করেছে।
সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের নীতিতে পরিবর্তন আসে। কেননা ভারতীয়রা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ক্লাবে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। কিছু ক্ষেত্রে এ শ্রেণী বৈষম্যের কারণে খোদ ব্রিটিশরা বিব্রত হয়েছেন। লর্ড উইলিংডনের সময়ে দুবার এ ঘটনা ঘটে। মুম্বাইয়ের গভর্নর থাকা অবস্থায় তিনি ভারতীয় রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যকে ইয়ট ক্লাবে আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু ক্লাবে তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি, কেননা ক্লাবটি ভারতীয়দের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। বিব্রত ও ক্ষুব্ধ উইলিংডন ১৯১৭ সালে তার সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। তিনি নিজ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ব্রিটিশ ও ভারতীয় উভয়ের প্রবেশাধিকার ছিল।
এর আগেই অবশ্য ক্লাব কালচারে জাতিবাদ, বর্ণ বৈষম্য বাদ দিয়ে দেশীয় ও ব্রিটিশদের সদস্যপদ দিয়ে সামাজিক একত্রীকরণ করার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে ইউনিয়ন ক্লাব সর্বপ্রথম কাজটি করে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় ও দেশীয় ভদ্রলোকদের মধ্যে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করা। ক্লাবটি এর সদস্যদের একটি পাঠকক্ষ, ড্রেসিং ও ডাইনিং রুমের বন্দোবস্ত করে। এর পাশাপাশি বিলিয়ার্ড ও দাবা খেলার জন্য আলাদা জায়গা ছিল। আট সদস্যের ম্যানেজিং কমিটিতে চারজন ব্রিটিশ ও চারজন দেশীয় সদস্য ছিলেন। এ ক্লাবের অন্যতম সদস্য ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়া বর্ধমান ও নদীয়ার অভিজাত পরিবারের ব্যক্তিরাও সদস্য হন। ইউরোপীয়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্যার জেমস আউটরাম ও স্যার স্টুয়ার্ট বেইলি। এভাবে নতুন ধারায় ক্লাবের কার্যক্রম শুরু হলেও সদস্যদের নাম দেখেই বোঝা যায় ক্লাব কখনই সবার জন্য ছিল না। কেননা ক্লাব মূলত নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। বর্ণবাদ তাই চলে গেলেও ক্লাব এখানো শ্রেণী মেনেই চলে।