উৎসবেও নেই ফুরসত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০২২, ৬:৪৯:০৯ অপরাহ্ন

নাজমুন নাহার হেলেন
পালা, পার্বণ, উৎসব ও আনন্দে সবার ছুটি মিললেও মেলে না নারীর। সাধারণ দিন কিংবা উৎসব আনন্দের দিনে অন্যদের উৎসবকে আনন্দময় করতে নারীদের গৃহকর্মে ব্যয় করতে হয় অতিরিক্ত সময়। ঘরের রান্না, উৎসবের রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া-মোছা, শিশু ও বৃদ্ধদের যত্ন, উৎসবের দিন কে কী পরবে- তা মার্কেট খুঁজে সাধ এবং সাধ্যের মিলন ঘটিয়ে কিনে আনা, ক্ষেত্রবিশেষে দর্জিওর দোকানে দৌড়ানো; সেই নারীকেই সব করতে হয়। এর পর সব গুছিয়ে জায়গামতো রাখা- যেন সকালে উঠেই হাতের কাছেই সেসব খুঁজে পায়। এমনতর হাজারো কাজ এখনো নারীর কাঁধেই চাপে। পরিবারে সদস্যদের প্রতি ভালোবাসায় তারা এখনো এসব কাজ করে যান হাসিমুখে। কখনো আবার প্রত্যাশার চাপেও করতে হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গৃহিণী-কর্মজীবী- সব নারীর যেন সামান্য ফুরসতও নেই, সবার বেলাতেই একই চিত্র দেখা যায়। ঈদে দেখা যায়- কোরবানির পরই যেন পুরুষদের দায়িত্ব শেষ, নারী তুমি এখন সামলাও।
বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘরের কাজে বাংলাদেশের নারীরা গড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি প্রতিদিন কাজ করেন। অন্যদিকে পুরুষরা এই কাজে সময় দেন এক ঘণ্টার বেশি। অতিরিক্ত এই সময় দিতে গিয়ে নারীদের ঘুম ও ব্যক্তিগত সময় কমে যাচ্ছে। কমছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ। এমনকি অনেকে যথাযথভাবে নজর দিতে পারেন না নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও।
স্কুলশিক্ষিকা শিরীন নাহার বলেন, ‘ঈদ উৎসব মানেই কাজের উৎসব। বন্ধে স্কুলের কাজ থাকে- যেসব ঘরে করতে হয় আবার সংসারের কাজেও ফুরসত মেলে না। অনেক সময় আমরা কর্মজীবী নারীরা কাজ শেষ হওয়ার পর ঘর দেখতে হবে বলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি বা ফিরতে চেষ্টা করি। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি হয় না। কারণ ঘরের এ কাজটিকে তাদের কাজ বলেই মনে করা হয় না। আমি শুধু নয়, আমার মতো অনেকেই আছেন- যাদের দুইবেলা রান্না সামলে কাজে যেতে হয়। আর মেহমান এলে তো কথাই নেই। পারলে ছুটি নিয়ে মেহমান সামলাও- যদি সে মেহমান শ^শুরবাড়ির হয়। উপার্জন করি, কাজের মানুষ রাখতেই পারি। কিন্তু এতেও স্বামীর আপত্তি- কেন বউ থাকতে বুয়ার রান্না খাব? ফলে পরিশ্রম আরও বেড়ে যায়। নারী উচ্চশিক্ষিত হলেও তাদের ঘরের ভেতরে পরিবারের সব কাজে থাকতে হয়- যদিও তারা বাইরে যাচ্ছেন, উপার্জন করছে- তবুও।’
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা শামীম আরা বলেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সময় লাগবে। চাইলেই রাতারাতি সংকীর্ণতা দূর হবে না। ব্যবসাটি আমার স্বামীসহ দুজনেই সামলাই। যখন সন্তান ছোট ছিল, তখন কাজের লোক ছাড়াও আমার স্বামী ব্যবসা ও গৃহকর্মে সমানভাবে সাহায্য করেছে। তার প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া আমার এতদূর এগিয়ে আসা সম্ভব হতো না। কারণ উদ্যোক্তাদের অনেক কিছু দেখতে হয়। নিজের দক্ষতা উন্নয়ন, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, কৌশল পরিবর্তন, ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ, পণ্যের ডেলিভারির পাশাপাশি পরিবারেও সময় দিতে হয়। ফলে উদ্যোক্তাদের অনেক কাজ একই সঙ্গে করতে হয়। উদ্যোক্তাদের বাসায় থেকেও সারাক্ষণ কাজ করতে হয়। এই যে সামনে কোরবানি ঈদ- ওই ঈদে গরু কেনাকাটা, প্যাকেট ও বিলি করা সব সে সামলায়। মোছা-গোছানোর কাজেও সে হাত লাগায়। তার সহযোগিতায় আমি হ্যাপি। তবে সব জায়গায় এমনটা দেখা যাবে না। এখনো জেলা শহর বা গ্রামাঞ্চলে ছেলেদের ঘরের কাজে হাত লাগানোকে অকল্যাণ ভাবা হয়। এটি ঠিক নয়।’
সিঙ্গেল মাদারদের অবস্থা তো কহতব্য নহে। দশভুজার চাক্ষুস নমুনা যেন তারা। এক হাতে সন্তানদের স্কুলে পাঠানো, খেলার ক্লাবে নেওয়া, গান, আঁকা- সব সামলানো আবার নিজের কর্মক্ষেত্র সামলে এসে নিজ গৃহকর্ম সামলানো। এ ছাড়া স্বামী নেই, এতে কী! স্বামীর পরিবার আছে। তারা সময়-অসময়ে আসবে খবরদারি ফলানোর চেষ্টা করবে, খাতিরদারি আদায়ের চেষ্টা করবে। শ^শুর-শাশুড়ি থাকলে তাদের প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন- সবটাই নারী তুমি সামলে নেবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সময়ের ব্যবহার নিয়ে সর্বশেষ সমীক্ষায় উঠে এসেছে, পুরুষের চেয়ে নারীরা সংসারের কাজকর্ম আটগুণ বেশি করেন। তারা ২৪ ঘণ্টার অর্ধেক সময়ই সংসারের কাজকর্ম, শিশু-বৃদ্ধসহ পরিবারের সদস্যদের যত্ন-আত্তি করেই পার করে দেন। নারীরা গড়ে ১১ দশমিক ৬ ঘণ্টা এসব কাজে ব্যয় করেন। অন্যদিকে পুরুষরা সংসারের কাজে ব্যয় করেন মাত্র ১ দশমিক ৬ ঘণ্টা।
নারীর গৃহকাজের স্বীকৃতি নেই। তবু তারা এ মজুরিহীন কাজেই বেশি সময় দেন। নারী চাকরি, ব্যবসা করে বাইরে সামলান আবার একই সঙ্গে সন্তান, সংসার, স্বামী, শ্বশুরবাড়িসহ ঘর সামলান। নাটক-সিনেমা, সমাজের মুখ দিয়ে প্রশংসার বুলি আউড়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে মহিমান্বিত করা হয়; তাকে প্রকৃত নারীর স্বীকৃতি দিয়ে জয় জয়কারের আহ্লাদ দেখানো হয়। এসব মনভোলানো বুলি আউড়ানোর দিন শেষ হওয়া দরকার। কারণ সংসার যদি দুজনের হয়, তা হলে গৃহকর্মও দুজনের সমান হওয়া উচিত। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে পুরুষরা নারীর সব ধরনের কর্মের সঙ্গী হবেন- এমনই প্রত্যাশা সবার। দুজনের সমসহযোগিতায় সুখী হবে সংসার।