ওলিদের আল্লাহপ্রেম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ এপ্রিল ২০২২, ৭:০১:১৯ অপরাহ্ন

মুন্সি আব্দুল কাদির
আল্লাহর প্রেমে যারা হাবুডুবু খান, আল্লাহর ধ্যান- জ্ঞান- ভয়- ভালবাসা ছাড়া তারা চলতে অপারগ। এক মূহূর্ত তাদের থেকে আল্লাহর ভয়, ভালবাসা আড়াল হয় না। যদিও কখনো এই অবস্থায় পড়ে যায়, চোখের পানি আর আহাজারিতে চারিদিকে এক ভীতির কম্পন সৃষ্টি হয়। মাওলার ভয়ে তারা মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কাবু হয়ে যান। তাদের আল্লাহর ভয়, ভালবাসা, আখেরাতের ভয়, দুনিয়া বিমুখিতা, দুনিয়ায় কষ্ট সহিষ্ণুতা আমাদের জন্য প্রেরণা।
আমরা অনেকেই সুলাইমান আত তাইমী (রাহ.) এর কথা জানি। সুলাইমান আত তাইমী সব সময় হয় ইবাদাতে, নয় তাসবিহ তাহলিল পাঠে, নতুবা মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। অবসর নামক শব্দ তার অজানা ছিল। তার সম্পর্কে হাম্মাদ ইবনে সালামা বলেন, আমরা যখনই তার কাছে এসেছি তাকে কোন না কোন ইবাদাদে মশগুল পেয়েছি। নামাজের সময় এলে নামাজে পেয়েছি। নামাজের সময় না হলে অসুস্থদের সেবায় পেয়েছি। মানুষ মারা গেলে কবরগাহে কবর তৈরীতে পেয়েছি। নতুবা মসজিদে বসে তাসবিহ তাহলিল পাঠে রত পেয়েছি। পাপের ভয়ে তিনি সব সময় কম্পমান থাকতেন। ইস্তেগফারকে সাথী বানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি অনেক ঋণে জর্জরিত ছিলেন। ঋণ মুক্তির জন্যও সব সময় ইস্তেগফার পড়তেন। তার থাকার জন্য সামান্য একটি ঘর ছিল। একবার এই ঘরটিও পড়ে যায়। লোকজন তাকে ঘর মেরামত করার পরামর্শ দিলে তিনি জবাব দিলেন, মৃত্যু খুব নিকটে, ঘর মেরামত করে আর কী হবে! এরপর থাকার জন্য একটি তাবু টানান। মৃত্যু পর্যন্ত এই তাবুতেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।
সুলাইমান আত তাইমী (রাহ.) এক বন্ধুর নিকট থেকে তার প্রয়োজনে একটি চাদর ধার নেন। প্রয়োজন শেষে আবার ফেরত দিয়ে দেন। তার বন্ধু বলেন, আমি অনেক দিন এই চাদরে মৃগনাভীর সুঘ্রাণ অনুভব করেছি। তার হৃদয় ছিল আল্লাহর প্রেমে ভরপুর। রাসুল প্রেমে তিনি ছিলেন ব্যাকুল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করতে গেলে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। তিনি বলেন, নেক কাজ হৃদয়ের আলো, ইবাদাতের শক্তি। গোনাহের কাজ অন্ধকার, ইবাদাতে দুর্বলতা। আর গোনাহের কাজ চিরদিনের জন্য কলঙ্ক হয়ে যায়।
সালামা বিন আদম (রাহ.) বলেন, আমির (রাহ.) এর ভাতিজি তার জন্য দুধ দিয়ে এক থালা খাবার তৈরী করে তার জন্য নিয়ে এলেন। ভাতিজি বলেন, আমার আশা চাচা এগুলো দিয়ে নাস্তা করবেন। এমন সময় এক ভিক্ষুক এসে আওয়াজ দিল, কে আছে এমন যে ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়াবে। আমির (রাহ.) তার ভাতিজিকে লক্ষ্য করে বলেন, হে ভাতিজি এই খাবার কি আমার জন্য নয়? আমি এই খাবার দিয়ে যা ইচ্ছা তা কি করতে পারি? ভাতিজি জবাব দিল হ্যাঁ চাচা। এই কথা শুনে আমির (রাহ.) সব খাবার ভিক্ষুককে দিয়ে দিলেন। আমিতো তাজ্জব, চাচার জন্য খাবার আনলাম আর চাচা সব দান করে দিলেন। তারপর দাসীর কাছ থেকে কিছু খেজুর ও সামান্য খাবার দিয়ে নাস্তা সেরে নিলেন। এরপর ভাতিজিকে বললেন, হ্যাঁ ভাতিজি, পেট হল একটা পাত্র, তুমি একে যত বোঝাই করবে সে ততো বোঝাই হবে। তোমার সংগ্রহ করা সেই জিনিসই তোমার অবশিষ্ট থাকবে যা তুমি কেবল মাত্র আখিরাতের জন্য প্রেরণ করতে পারবে।
আলী (রা.) কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে দেখলেন এক লোক তাকে গালাগাল করছে। আলী (রা.) একটু এগিয়ে গেলেন। মোলায়েম সুরে ঐ ভাইটিকে বললেন- প্রিয় ভাই আমার, তুমি আমার সম্পর্কে যা বলছ, তা যদি সত্য হয় মহান মালিক যেন আমাকে মাফ করে দেন। আর যদি সত্য না হয় আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমাকে মাফ করে দেন।
ইয়াহ ইয়া বারমুকি (রাহ.) রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন সেলজুক সালতানাতের মন্ত্রি। তিনি যাওয়ার সময় এক লোক তার সাথে দুর্ব্যবহার করে বসে। মন্ত্রীর গার্ডগণ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। ইয়াহ ইয়া বারমুকি (রাহ.) ঐ ব্যক্তিকে বলেন- তুমি কি জান আমি কে? সে জবাব দেয়, হ্যাঁ জানি আপনি মন্ত্রী। আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি কি জান, আমি তোমাকে ফাসি কাষ্ঠে ঝুলাতে পারি। সে জবাব দেয় হ্যাঁ এও জানি। ইয়াহ ইয়া বারমুকি (রাহ.) তার কথা শুনে বলল, যাও আমি তোমাকে কোন শাস্তি দেব না। কেবল মাত্র মহান রবের জন্য আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম।
আতা (রাহ.) অযু করছিলেন। এমন সময় এক ঝাকুনি দিয়ে তার সারা শরীর কেঁপে উঠে। তিনি খুব উচু স্বরে কান্না শুরু করেন। আশপাশের মানুষজন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। এ কী হল। তিনি হঠাৎ কাঁদছেন কেন? ভয়ে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তার চেহারায় রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়। সাথীরা ভেবে পায় না। এ কী হল। তাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করা হল। আপনিতো অযু করছিলেন। এর মধ্যে কী হল, যে আপনি এমন ভাবে কান্না করছেন। আতা (রাহ.) জবাব দিলেন- আমি এখন এমন এক বিরাট কাজের দিকে যাচ্ছি। আমি যে আমার মহান মালিকের সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি। তাই ভয়ে আমি আর স্থির থাকতে পারি নি।
আতা (রাহ.) একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। এমন সময় আলা ইবনে মুহাম্মদ (রাহ.) তার বাড়িতে তশরিফ আনলেন। এসে এই অবস্থা দেখে আতা (রাহ.) স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন- তিনি বেহুশ হলেন কেন? তার স্ত্রী জবাব দিল পাশের বাড়ির চুলার আগুন দেখে তিনি জাহান্নামের ভয়ে ভীত হয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছেন।
আজ আমাদের সমাজে হারামের মহোৎসব। নিজের স্বার্থে হালাল হারামের কোন তোয়াক্কা নেই। হারাম বর্জন করাও ফরজ। হারাম বর্জন না করতে পারলে কোন ইবাদাতই কবুল হয় না। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নামাজ পড়তে পড়তে যদি তোমার পিঠ ধনুকের মত বাঁকা হয়ে যায়, রোজা রাখতে রাখতে শরীর এক্বেবারে চিকন হয়ে যায়, তবু আল্লাহর দরবারে তোমার ইবাদাত কবুল হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি হারাম থেকে বাঁচতে পার। সাহল তশতরী (রাহ.) বলেন, যে হারাম খায় তার প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তার অবাধ্য হয়ে যায়। কিন্তু হারামখোর ব্যক্তি তা অনুধাবন করতে পারে না। সুফিয়ান সাওরী (রাহ.) বলেন, যে ব্যক্তি ভাল কাজে হারাম মাল ব্যবহার করে, সে যেন প্রশ্রাব দিয়ে কাপড় পাক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, লোকেরা এসে অভিযোগ করে বলে, ভাই নামাজে মন বসে না। আমি নির্দিধায় বলতে পারি তোমরা একটু ভালভাবে খোঁজ খবর নিয়ে দেখ তার খাদ্যের কোন না কোন অংশে হারামের সংমিশ্রণ রয়ে গেছে। আয়েশা (রা.) বলেন, ইবাদতের আসলই হচ্ছে হারাম থেকে বেঁচে থাকা। কিন্তু অধিকাংশ লোকই এই বিষয়ে উদাসীন/বেখবর থাকে।
সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। আমি যেন আল্লাহ তায়ালার মকবুল বান্দা হতে পারি। আল্লাহ তায়ালা যেন আমার দোয়া কবুল করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হালাল খাদ্য খাও। আল্লাহর শপথ করে বলছি। কোন বান্দার পেটে যদি হারাম খাদ্যের একটি লোকমা প্রবেশ করে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত ঐ বান্দার কোন ইবাদতই কবুল হবে না।
সিররি সাকতি (রাহ.) বলেন, আমরা বাদশাহের বৈঠক খানায় গেলাম। সেখানে দেখলাম একটি শিলালিপিতে লেখা আছে, যে তুমি যতই নিরাপদ প্রহরা বেষ্টিত আলীশান রাজ প্রাসাদে বসবাস কর না কেন, একটু সময়ের জন্যও মৃত্যুর কথা ভুলে যেও না। তোমার সকল বেষ্টনি ভেদ করে, তোমার পরিধেয় সকল কিছু ভেদ করে মৃত্যুর তীর তোমাকে বিদ্ধ করবেই। তোমার কাপড়ে সামান্য ময়লা লাগলেই তা পরিষ্কার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাও। সামান্য ময়লা কাপড়ও পরিধান করতে চাও না। অথচ তোমার দ্বীনের উপর অহরহ ময়লা পড়তেছে, তোমার দ্বীনের ময়লা পরিষ্কার করার কোন তাগাদা নেই, কোন পেরেশানী নেই। তোমরা সকলে মুক্তি পাওয়ার আশা কর। কিন্তু যে পথে মুক্তি মিলবে, যে পথ মুক্তির রাজপথ, সে পথে চল না, চলতে চাও না, চলার চেষ্টা কসরত কর না। নৌকা কখনো শুষ্ক ভূমির উপর চলতে পারে না। এই কথাটি সকলের স্মরণ রাখা উচিত।
সূত্র: কুড়ানো মানিক : মাওলানা মহিউদ্দিন খান (রাহ.), কিতাবুল যুহদ : অনুবাদ : জিয়াউর রহমান মুন্সী, আউলিয়া কেরামের হাজার ঘটনা : অনুবাদ মোহাম্মদ খালেদ।