কাঁকড়া যখন বৈদ্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুন ২০২২, ৪:৩৭:৫৯ অপরাহ্ন

বিনতা দেবী
পুকুর পাড়ে ঝোপের পাশে কিছু কঁচুগাছ ছিল। কচুগাছের ভীড়ে গর্তে এক কাঁকড়ার বাস। এর পাশেই আবার একটি ডোবা। আষাঢ়ের ঘনঘোর বৃষ্টিতে চারদিকের পানি এখানে এসে জমে। এ ডুবার জলে কিছু খলসে, পুঁটি, শিং, মাগুর মাছ বাস করে।
এক সন্ধ্যায় চারদিক মেঘাচ্ছন্ন, এরি মধ্যে সজোরে বৃষ্টিও নামে। হঠাৎ ডুবার জলে থাকা শিং, মাগুর কচুগাছের ঝোপে থাকা ব্যাঙ এর করুণ আর্তনাদ শোনতে পেল। শিং ব্যাপার কি! ব্যাঙ মামা কাঁদছে কেন??? মাগুর হ্যাঁ তাইতো শোনা যাচ্ছে। শিং, বল কি মামার আবার কি হল। এ ঘোর অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে যাই কি করে। মাগুর এত্ত ভাবতে হবে না তো বন্ধুর বিপদে বন্ধুকেই তো এগিয়ে যেতে হবে। দুজন গিয়ে যা কাণ্ড কারখানার কথা শুনল, শুনে দুজই হতভম্ব। গর্তে থাকা কাঁকড়াটা অঝোর বৃষ্টির মধ্যে এসে ব্যাঙ মামা কে টানা-হেঁচড়া করতে করতে পা দুটো থেতলে দিয়েছে। ব্যাঙ কোন উপায় না দেখে করুণ স্বরে ঘ্যাং ঘ্যাং করে শিং, মাগুর মশাইদের ডাকতে শুরু করল আমাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে। সাপ নিশ্চয় আমাকে কামড়ে ধরেছে।
ব্যাঙের চেঁচা-মেচিতে ভয়ে কাঁকড়া ব্যাঙকে ছেড়ে গর্তে চলে গেল। কেউ টেরই পেল না। শিং, মাগুর মশাই লাফিয়ে এসে কাউকে না দেখে ব্যাঙের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বলল, আরে ব্যাঙ-এর বেটা ব্যাঙ সারাদিন নতুন পানি পেয়ে করিস ঘ্যাং ঘ্যাং। রাতের বেলা একটু নিদ্রা যাচ্ছিলাম তাও তোর ঘ্যান-ঘ্যানানিতে থাকতে পারলাম না, ছুটে আসতে হল। দেখি কোন সাপে তোকে ধরেছে? ব্যাঙের পা দুটোর অবস্থা দেখে তারা দুজন ভীষণ ভয় পেল। হ্যাঁ তাইতো, এতো দেখছি জাত সাপে ধরেছে গো, মামা জাত সাপে ধরেছে!!
ব্যাঙ হ্যাঁ মশাইরা ঠিক বলেছ, এ জাত সাপ হবে। কত সাপের কামড় খেয়েছি কত কালে এমন সাপের কামড় খাইনিতো কোন কালে। দ্যাখ, দ্যাখ! মশাইরা আমার পা দুটো কেমন থেঁতলে দিয়েছে। এখন কেউ কি আমায় বন্ধু করবে। গর্ত থেকে কান পেতে কাঁকড়া সব শুনতে পাচ্ছিল। হুংকার করে বলল, আমি তোর বন্ধু হব। তুই কি আমাকে বন্ধু বানাবি। ব্যাঙ আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে আপনি কে মশাই? কাঁকড়া বলল, আরে মশাই-টশাই এসব ছেড়ে দে তো। আমি কাঁকড়া, আমি পাঁচ -পাঁচটি গর্তের রাজা। কাঁকড়ার ভিতরে ছিল যত কুবুদ্ধি। কাঁকড়া এসে স্বশরীরে উপস্থিত। শিং, মাগুর মশাইকে বলল, তোমরা চলে যাও নিশ্চিন্তে ঘুমাও গিয়ে। আমি বন্ধু কে দ্যাখে রাখব। আহারে কেমন করে পা দুটো থেতলে দিয়েছে, কষ্ট হচ্ছে বন্ধু তাই না। তোমার কষ্ট দ্যাখে আমার চোখের জলে প্লাবন হচ্ছে। চল তুমি, আমার গর্তে চল।দ্যাখি তোমাকে সাপ কোথায় খুঁজে পায়। শিং, মাগুর মশাই তোমরা ভেবো না প্রয়োজন হলে আমি আমার পেটের ভেতর রাখব তবুও বন্ধুর ক্ষতি হতে দেব না।
শিং, মাগুর দুজন ভাবল, যাক্ ব্যাঙ মামা একটু স্বস্তি পেল। শিং বলল, মাগুর মশাই চল আমরা শান্তি মন্ত্র পাঠ করি। কিন্তু এক সাথে যে ব্যাঙের জন্যও শান্তি মন্ত্র হয়ে যাচ্ছে ওরা বুঝতে পারেনি। কাঁকড়া ওকে গর্তে নিয়ে সাবাড় করে ফেলল। পরদিন প্রাতে খলসে,পুঁটি, শিং, মাগুর মশাই সবাই ব্যাঙের গর্তের সম্মুখে এসে হাজির। ব্যাঙ মামা কোথায় তুমি? আমাদের কি জানতে মানা গো? ভাল আছো তো। রাত্রে তো চিৎকার চেঁচামেচি শুনিনি। তাই ভাবলাম একবার দেখে আসিতো। ভাল ঘুম হয়েছে নিশ্চয়ই।
এসব শুনে কাঁকড়া গর্ত থেকে বলল হ্যাঁ, এখন তোরা যা আমি ভালো আছি। আমার জন্য চিন্তা করিস নে। কিন্তু কয়েক দিন হয়ে গেল ব্যাঙের সাড়া শব্দ না পেয়ে মাগুর মশাই, নাওয়া, খাওয়া বাদ দিয়ে কেমন অচেতন হয়ে পড়ল। বোধ শক্তি লোপ পেতে লাগলো।
এহেন অবস্থায় ডোবার মাছেরা বোর্ড বসিয়ে ভাবলো বৈদ্য ডাকতে হবে। কিন্তু এত ছোট ডোবা এখানে আবার বৈদ্য কোথায় পাবে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনেক চিন্তা ভাবনা পর হঠাৎ খলসে বলল, কেন? কাঁকড়া মশাই তো ব্যাঙ মামার থেতলে যাওয়া ঠ্যাং ভাল করল? পুঁটি তাহলে তোমরা এত্ত ভাবছো কেন কাঁকড়া মশাইকে ডাক। ব্যাঙের চেঁচামেচিতে ডোবায় থাকা মুশকিল ছিল। এখন তো ও কাঁকড়া মশাইর সংঘ পেয়ে অনেক ভালো হয়ে গেছে। মনে হয় বিলে চলে গেছে। এবার মাছেরা সবাই বলল, কোথায় সে কাঁকড়া মশাই তাহলে ওকে ডাক। কাঁকড়া মশাইকে ডাকা হল, উনি এসে হাজির।
কি খবর মাছেরা, কোন দুঃসংবাদ নাকি? আমাকে ডেকে পাঠালে যে। তো শুনি কি হয়েছে? মাছেরা বলল, মশাই কি আর বলব? ব্যাঙ এর চিন্তায় চিন্তায় মাগুর মশাই অচেতন হয়ে পড়েছে। দেখেন তো কি করা যায়? কি আর করা যাবে পাঠিয়ে দিন আমার গর্তে ওখানে ভালো জলের ব্যবস্থা আছে আবার ব্যাঙের সাথে দেখা হবে মামা ভাগ্নে একসাথে থাকলে মন ভাল হয়ে উঠবে। ‘মনরোগ’ হয়েছে বুঝলে মাছেরা মনরোগ হয়েছে। ভেবো না ভালো হয়ে যাবে। আমি তো আবার উভচর, জলেও থাকি আবার ডাঙ্গায়ও পা রাখি। বলছি তো মাছেরা ভেবো না, মাগুর মশাইকে সুস্থ করে ব্যাঙের বিলে পাঠিয়ে দেব। দুজন একসাথে থাকলে ভালই থাকবে। দুর্বুদ্ধি কাঁকড়া মহা- খুশি, মনে মনে ভাবে, এ তো দেখছি, আমার ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হয়েছেন। এখন থেকে খাবার জোগাড়ের জন্য বেরুতে হবে না। খাবার জোগাড় করে ওরা নিজে থেকেই এনে দেবে। আর আমার যা পেট অল্পতেই ভরে যায়। এ মাগুর মশাই তো অনেক ফ্যাটি।
এটাতেই এ বর্ষা কাটিয়ে উঠতে পারব। যাক্ বাবা ভালোয় ভালোয় মাগুর মশাইকে গর্তে ঢুকাতে পারলেই হল। একেই বলে বুদ্ধি, জব্বর বুদ্ধি! আমি তো দেখছি ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’ হয়ে আছি। ‘বুদ্ধি খাটালে খেটে খেতে হয় না’