সিআইডি'র তদন্তে রহস্য উদঘাটন
কানাইঘাটে হত্যাকান্ডের ১৩ বছর পর ঘাতকের স্বীকারোক্তি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২২, ৬:০৫:৩৬ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী
“একটি কলার ছড়ি ও চার-পাঁচটি বাঁশ কাটাকে কেন্দ্র করে তরিকত উল্যার (৪২) সাথে বিরোধ দেখা দেয়।এরপর থেকে তাকে হত্যা করতে পরিকল্পনা করা হয়।কিন্তু সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না।একদিন বাড়ির পার্শ্ববর্তী পাবিজুড়ি হাওরে কাজ করতে যায় তরিকৃত। সুযোগ বুঝে ভাইয়েরা মিলে তাকে জবাই করে হাওরের জঙ্গলে লাশ ফেলে দেয়া হয়। দুদিন পরে তরিকতের পরিবার সন্দেহ করলে আত্মগোপনে চলে যেতে সিদ্ধান্ত নেই। বাড়ি থেকে বের হয়ে জঙ্গলে চলে যাই। গিয়ে দেখি সেখানে তরিকতের লাশ নেই।কয়েকটি হাড্ডি পড়ে আছে”।
হত্যাকান্ডের ১৩ বছর পর সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার গনিকান্দির কৃষক তরিকত উল্যাহ খুনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে এভাবেই ঘাতক আলা উদ্দিন ওরফে আলাই (৩২) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সিলেটের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর হোসেন ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় গত ২৯ জুন আলা উদ্দিন ওরফে আলাইর জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
এর আগে গত ২৬ জুন রোববার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা বড়ছড়া কয়লার ডিপো এলাকা থেকে আলাউদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আশরাফ উজ্জামান সিলেটের ডাককে এতথ্য জানিয়েছেন।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে ,তরিকতকে চাচাতো ভাইরা মিলে হাওরে হত্যা করে। লাশ ফেলে দেয়ার পর ঘাতকরা নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছিল। ঘটনার পরদিন ঘটনাস্থলে রক্ত ও তরিকতের কোদাল পাওয়া যাওয়ার পর ঘাতকরা আত্মগোপনে চলে যেতে দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার এলাকায় তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠে। এখানে কয়েক দিন থাকার পরে আলা উদ্দিন ওরফে আলাই চলে যায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। সেখানকার একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা বড়ছড়া কয়লার ডিপোতে টানা ১৩ বছর ছিল। এর আগে আলাউদ্দিন ওরফে আলাইর সহোদর আব্দুল হালিমকে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে তরিকত হত্যাকান্ডের জট খোলে। ওই সময় নিশ্চিত হওয়া যায় তরিকতকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে তরিকত হত্যাকান্ডের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনী। ৫ সেপ্টেম্বর ঘাতক আব্দুল হালিম সর্বপ্রথম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
জানা গেছে, তরিকতের সাথে জায়গা-জমি নিয়ে চাচাতো ভাই মুজিবুর,আব্দুল হালিম ও আলাউদ্দিনের বিরোধ চলে আসছিল। বিরোধপূর্ণ জায়গার কলা গাছ থেকে একটি কলার ছড়ি ও চার-পাঁচটি বাঁশ কাটেন তরিকত। এরপর তাদের বিরোধের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। এ ঘটনার প্রায় ১৫ দিন পর ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর সকালে পার্শ্ববর্তী পাবিজুড়ি হাওরে কাজ করতে যান তরিকত। দিন শেষে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলেও তরিকত আর বাড়িতে ফিরে আসেননি।পরদিন সকালে স্বজনরা ওই হাওরের কাটাগাঙ্গের পাড়ে যেখানে কাজ করেছেন তরিকত; ওই স্থানের পার্শ্বেই তার কোদাল পড়ে আছে। এর সামান্য দূরে কয়েক স্থানে রক্তের দাগও রয়েছে। এরপর তরিকতের স্ত্রীসহ স্বজনদের যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।তরিকতের স্ত্রী আলফাতুন্নেছা বাদী হয়ে পরদিন জৈন্তাপুর থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। জৈন্তাপুর থানার মামলা নং-১৬, তারিখ-২৭/১০/০৯ ইং। ধারা- ৩৬৪/৩৪ দন্ড বিধি। মামলায় তরিকতের চাচাতো ভাই মুজিবুর রহমান(৩২),আব্দুল হালিম(৩৮) ও আলা উদ্দিন ওরফে আলাইকে (২৫) আসামি করা হয়।
ঘটনার পর জৈন্তাপুর থানা পুলিশ মামলার তদন্ত করে কোনো কূল কিনারা পায়নি। পরবর্তীতে মামলার তদন্তভার সিলেট জেলা গোয়েন্দা পুলিশে ন্যস্ত করা হয়। জেলা গোয়েন্দা বিভাগ এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তরিকতের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা উদঘাটন করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত জেলা গোয়েন্দা পুলিশ মামলার তদন্ত শেষে চুড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে।কিন্তু স্বামীর সন্ধান পেতে হাল ছাড়েননি স্ত্রী আলফাতুন্নেছা।তিনি গোয়েন্দা পুলিশের ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি দেন।আদালত নারাজি গ্রহণ করে অধিকতর তদন্তের জন্যে মামলাটি সিআইডিতে প্রেরণের আদেশ দেন।বিভিন্ন তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্ত শেষে দশম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক শামীম উর রশীদ পীর দন্ডবিধির ৩৬৪/৩৪ ধারায় ৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র
দাখিল করেন। আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেন ও বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।দীর্ঘ ১০ বছর পর আসামি আব্দুল হালিমকে গ্রেফতারী পরোয়ানা মূলে গ্রেফতার করে পুলিশ। আব্দুল হালিমকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলার প্রকৃত রহস্য তথা ভিকটিম তরিকত উল্লাহরর প্রকৃত অবস্থা জানতে চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো ধরনের তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি।পরে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়।দীর্ঘদিন পরে কোনো আসামি গ্রেফতার হওয়ায় মামলার বাদী বিচারিক আদালতে অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন।আদালত আবেদন মঞ্জুর করে আমলী আদালতে প্রেরণ করেন। আমলী আদালত
অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইকে নির্দেশ দেন।পিবিআই’র তদন্তকালে বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মামলার তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত করা হয়।পরে সিআইডি সিলেট অফিসের পুলিশ পরিদর্শক আশরাফ উজ্জামানকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বাদীসহ স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলেন।ওই সময় বিভিন্নভাবে তরিকত উল্যাহকে হত্যা করে লাশ গুম করার কথা উঠে আসে। এরপরে আব্দুল হালিমকে টানা ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি নতুন মোড় নেয়।এক পর্যায়ে আব্দুল হালিম হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে বলে,যে পূর্বশত্রুতার জেরে ভিকটিমকে হত্যা করে লাশ হাওরের জঙ্গলে ফেলে দেয়। লাশ শিয়াল খেয়ে ফেললে কেবল কংকাল পড়ে থাকে।পরে সে আদালতে জবানবন্দি দেয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডি সিলেট জোনের পুলিশ পরিদর্শক মো. আশরাফ উজ্জামান বলেন,এটি একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। টানা ১১ বছর অতিবাহিত হলেও তরিকতের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আব্দুল হালিম গ্রেফতারের পরও কোনো তথ্য বেরিয়ে আসেনি। সিআইডিকে মামলার তদন্তের দায়িত্বভার দেয়ার পর রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়। হত্যাকান্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে।তিন আসামির মধ্যে অনেক আগেই এক আসামি মারা গেছে। অন্য দু’জন গ্রেফতার হয়ে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে।দু’জনেই ঘটনার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।