কৃষক কল্যাণের স্বপ্ন থেকে প্রযুক্তিবিদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ অক্টোবর ২০২২, ৬:৪৪:১৩ অপরাহ্ন

ইউনুছ চৌধুরী
কৃষকদের হাতে স্বল্পমূল্যে লাগসই প্রযুক্তির কৃষি যন্ত্রপাতি তুলে দেয়ার স্বপ্ন থেকে নিজেই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করে কৃষি প্রযুক্তিবিদ হয়ে উঠেছেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই এলাকার আব্দুল হাই আজাদ বাবলা। কৃষক বান্ধব প্রযুক্তির স্বপ্ন থেকে তিনি নিজেই উদ্ভাবন করলেন নতুন নতুন কৃষি যন্ত্রপাতি। ইতোমধ্যে তাঁর উদ্ভাবিত বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি দেশব্যাপী সমাদৃত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ৩ বার জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। সর্বশেষ গত বুধবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-এ তিনি কৃষি প্রযুক্তি গবেষণা বিভাগে রৌপ্য পদকে ভূষিত হয়েছেন। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আরো টেকসই করে কৃষক পর্যায়ে পৌছে দিতে সরকারের সহায়তা কামনা করেন তিনি।
সিলেট পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন আব্দুল হাই আজাদ বাবলা। পরে বিএডিসি এর ড্রিলিং কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেন। এসময় তিনি লক্ষ্য করেন সরকারের নেয়া অনেক প্রকল্প ও প্রযুক্তি থেকে কৃষকরা পুরোপুরি সুবিধা নিতে পারেন না। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে কৃষকরা এসবের সুফল থেকে বঞ্চিত হোন। কৃষকদের কথা ভেবে ১৯৯৯ সালে কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজেই লাগসই প্রযুক্তির (যে প্রযুক্তি একটি দেশের আর্থ সামাজিক পরিবেশের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ) কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে আত্ননিয়োগ করেন। একে একে তাঁর হাত ধরে আবিস্কৃত হয় নতুন নতুন যন্ত্রপাতি। তিনি উদ্ভাবন করলেন ‘গরীব বন্ধু পাম্প’ ‘নিউ সিস্টেম শেলো টিউবওয়েল’, ‘স্বল্পমূল্যের ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র’ সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি। সর্বশেষ উদ্ভাবন করেন ‘কোকোডাস্ট’ প্রযুক্তি। নারিকেলের ছোবড়ার গুড়া নিয়ে চাষ সহায়ক মাটির সংমিশ্রণ তৈরি করার প্রযুক্তি। নতুন এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য তিনি এবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২৬ এর কৃষি গবেষণা বিভাগে রৌপ্য পদকে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া, গত ২০০৫ সালে ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র আবিস্কারের জন্য জাতীয় কৃষি পদক এবং ২০১৭ সালে ‘নিউ সিস্টেম শেলো টিউবওয়েল’ প্রযুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক অর্জন করেন। বর্তমানে জাতীয় ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প, উত্তর-পূর্ব ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের নিবন্ধিত প্রযুক্তিবিদ হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
‘কৃষকদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ কেন অসফল হয় এই চিন্তা থেকে দেশের কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ‘লাগসই প্রযুক্তি’র উদ্ভাবনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি’-বলেন কৃষি প্রযুক্তিবিদ আব্দুল হাই আজাদ বাবলা। তিনি জানান, ‘অনেক স্থানে পানির স্তর নিচে নেমে যায় অথবা গ্যাসের চাপের কারণে পানি উত্তোলন করা যায় না। কৃষকের এমন সমস্যা দূর করতেই তৈরি করেছি ‘নিউ সিস্টেম শেলো টিউবওয়েল’ ও ‘গরীব বন্ধু পাম্প’। বাজারে যেসব পাম্প রয়েছে সেগুলো বসাতে হলে কৃষকদের ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমার উদ্ভাবিত পাম্প আড়াই হাজার টাকায় বসানো যায়। এছাড়া, ভুট্টা চাষীদের জন্য হাত বা পা অথবা মেশিন চালিত ‘ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র’ উদ্ভাবনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ভুট্টা চাষীদের অনেকেই ভুট্টা মাড়াই নিয়ে বিপাকে পড়েন। বাজারে প্রচলিত একটি ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র ক্রয় করতে তাদের ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ভুট্টা চাষীর পক্ষে শুধু ভুট্টা মাড়াইয়ের জন্য এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র পাওয়া যাবে ১ হাজার ৫শ টাকা থেকে ৪ হাজার ৫শ টাকায়। বিদ্যুৎ না থাকলেও হাত বা পা চালিত যন্ত্রের মাধ্যমেও ভুট্টা মাড়াই করা যাবে।
‘ছাদ বাগানের বিষয়টি মাথায় রেখে এবং খরা থেকে গাছ রক্ষায় উদ্ভাবন করেছি ‘কোকোডাস্ট’ প্রযুক্তি–জানালেন আব্দুল হাই আজাদ বাবলা। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তিতে নারিকেলের ছোবড়া মেশিনে দিয়ে এর থেকে একদিকে ছোবড়া বেরিয়ে আসে যা তোষক বা সোফার গদি তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে বেরিয়ে আসে ছোবড়া থেকে পড়ে যাওয়া নারিকেলের ছোবড়ার গুড়া। এই গুড়ার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং ওজনে হালকা। তাই টবে মাটির সাথে এই গুড়া ব্যবহার করলে অধিক সময় পানি ধরে রাখে এবং ওজনে হালকা হওয়ায় টবের ওজনও কম থাকে। বিশেষ করে ছাদ বাগানে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব করে যাচ্ছি। উদ্ভাবন ও আবিস্কারের গবেষণা অনেক ব্যয়বহুল এবং যন্ত্রপাতি নির্ভর। যা ব্যক্তিগতভাবে নির্বাহ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতির উন্নয়ন ও নতুন আবিস্কারের জন্য একটি লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু আর্থিক কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি- বেসরকারি সহযোগিতা পেলে উদ্ভাবন আরো ফলপ্রসূ হতো।’ কৃষি প্রযুক্তিবিদ আব্দুল হাই আজাদ বাবলা আক্ষেপ করে বলেন, বয়স এখন প্রায় ৬৫ বছর। কিছুদিন পূর্বে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ায় শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। কৃষি যন্ত্রপাতির একটি ওয়ার্কশপ স্থাপন করে কৃষক পর্যায়ে লাগসই প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যাপকভাবে পৌছে দেয়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে চান তিনি।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর পরিচালক খন্দকার শিপার আহমদ বলেন, কৃষি প্রযুক্তিবিদ আব্দুল হাই আজাদ বাবলা নিজ উদ্যোগে যা করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এই উদ্ভাবন শুধু সিলেট নয়, পুরো বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী দেশের শীর্ষ একটি প্রতিষ্ঠান সিলেটের, যা আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে রয়েছে। কৃষি ব্যাংকসহ অন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গুলো এগিয়ে এলে তাঁর থেকে আরো উন্নত প্রযুক্তি পাওয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।