কোল্ড ড্রিংকস নয়, পানিই সেরা পানীয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ মে ২০২২, ৭:১৭:৩৩ অপরাহ্ন

গোলাম সারওয়ার
ফ্রিজে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় যে কোনো তরল পদার্থ জমে যায়। কিন্তু কোমল পানীয় বা কোল্ড ড্রিংকস জাতীয় সকল এনার্জি ড্রিংকস জমে না। কারণ এতে রয়েছে এন্টি ফ্রিজার ইথিলিন গ্লাইকল। শুধু ৪ ডিগ্রি নয়, মাইনাস ৩৭ ডিগ্রি হলেও এটি জমতে দেয় না। এটি মানবদেহের জন্য স্বল্প মাত্রার আর্সেনিকের মতোই একটি বিষ। এটি মূলত শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। এ নিয়ে হাইড্রোলিক ব্লেকের জন্য ফ্লুয়িডস তৈরী হয়। স্টাম্প প্যাডের কালি, বল পয়েন্টের কালি, এনামেল পেইন্ট, প্লাস্টিক সামগ্রী এবং কমসেটিকস ইত্যাদি তৈরীতে এটি মূলত ব্যবহৃত হয়। অথচ স্বল্প, বর্ণহীন এবং গন্ধহীন এই উপাদানটি বিভিন্ন কোল্ড ড্রিংকসে এন্টি ফ্রিজার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে হরদম। গবেষকদের মতে, ইথিলিন গ্লাইকল মানবদেহে নীরব বিষক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম।
কোমল পানীয় তথা কোল্ড ড্রিংকসে আরো মেশানো হয় কৃত্রিম রঙ। যেমন-টারট্রাজিন, কারমোসিন, ব্রিলিয়ান্ট ব্লু, সালফেট ইয়েলো ইত্যাদি। নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এগুলোর বিক্রয় অনেক আগে থেকেই নিষিদ্ধ। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই উপাদানগুলো ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এছাড়াও কোমল পানীয়তে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয় সোডিয়াম বেনজুয়েট বা বেনজয়িক এসিড। এ উপাদানটি কারো কারো ক্ষেত্রে হাঁপানী ও চর্মরোগের হুমকি স্বরূপ।
কোমল পানীয়তে ঝাঁঝালো স্বাদের জন্য মেশানো হয় ফসফরিক এসিড, যা ইতিমধ্যেই দাঁতের এনামেল এবং শরীরের হাঁড়ের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোমল পানীয়ের বোতলে একটি দাঁত ফেলে রেখে দিলে তা ১০ দিনের মধ্যে পুরোপুরি গলে যায়। বৃটিশ ডেন্টাল এসোসিয়েশনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রতিবার কোমল পানীয় গ্রহণের প্রায় ১ ঘন্টা পর্যন্ত দাঁদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বজায় থাকে এবং এাই ক্ষতিকর আবরণকে অকার্যকর করতে মুখের লালার প্রায় ১ ঘন্টা সময় লাগে! কোমল পানীয়ের আরেকটি উপাদান হলো-কার্বন-ডাই-অক্সাইড। যা আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শরীর থেকে বর্জ্য হিসেবে বের করি। অথচ কোল্ড ড্রিংসক বা এনার্জি ড্রিংকসের মাধ্যমে এটি খুব সহজেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে!
প্রতি বোতল এনার্জি ড্রিংকসে আর কি মেশানো হয়? গ্লুকোজ, সুক্রোজ, ফ্রুক্টোজ, স্যাকারিন ইত্যাদি। ১ বোতল বা ১ ক্যান ড্রিংকসে ক্যালরির পরিমাণ হয় ১০ চামচ চিনির সমান। এই পরিমাণ ক্যালরি পোড়াতে একজন মানুষকে ভারী ব্যায়াম বা ভারী শ্রম করতে হবে সপ্তাহে ৪ ঘন্টারও বেশি। না হলে মেদস্থূলতার কারণ হবে। আর মেদস্থূলতার পরিণতি হচ্ছে ডায়াবেটিস, মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টরল, গলব্লাডারে পাথর, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, রক্তনালীর সংকোচন, স্ট্রোক অথবা অকালমৃত্যু। চিনির মাত্রাধিক্যের কারণে সিঙ্গাপুর সরকার ১৯৯২ সালে কোকাকোলা পেপসিসহ সকল ধরনের কোমল পানীয় স্কুল পর্যায়ে বিক্রয় পুরোপুরি নিষেধ করেছে।
খাবার সবচেয়ে ভাল হজম হয় যখন পাকস্থলীর তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেন্ডিগ্রেড থাকে। কিন্তু ভরপেট খাওয়ার পরই আপনি যখন আপনার পাকস্থলীতে শূন্য থেকে ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রার কোমল পানীয় ঢেলে দেন তখন স্বাভাবিকভাবেই হজমের পুরো প্রক্রিয়াটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হজমের বদলে পাকস্থলীতে থাকা খাবার তখন গাঁজন প্রক্রিয়ায় পঁচতে শুরু করে। খাবার হজমের লক্ষণ মনে করে আপনি যে তৃপ্তির ঢেঁকুরটি তোলেন, তা আসলে খাবার পচনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস!
সুস্থ আর তারুণ্যদীপ্ত থাকতে চান সব সময়? ক্লান্তি জয় করে সতেজ হতে চান? তাহলে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। সারাদিন আপনি থাকবেন ঝরঝরে, থাকবেন মানসিক চাপমুক্ত। আমাদের শরীরে শতকরা ৬০ ভাগই পানি। পেশিতে শতকরা ৭৫ ভাগ, হাড়ে ২২ ভাগ আর রক্তের ৮৩ ভাগই হলো পানি। মানবদেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মূল উপাদানই হচ্ছে পানি। অতএব, বুঝাই যাচ্ছে, শরীরটাকে স্বাভাবিকভাবে চলমান রাখার জন্য পানি একটি অপরিহার্য উপাদান। কেবল তৃষ্ণা মেটাতে নয়, বরং সুস্থ জীবনের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরি।
ত্বকের সুস্থতার জন্য নামীদামী ব্রান্ডের প্রসাধনীর চেয়ে পানি পানের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছেন এখন বিজ্ঞানীরা। ত্বকের বিভিন্ন রোগ যেমন-একজিমা, ত্বকে ভাঁজপরা, অনাকাংখিত দানা দূর করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি পান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিদিন নিয়ম করে পানি পান করলে রক্তের মাধ্যমে প্রতিটি দেহকোষে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছার প্রক্রিয়াটি আরো ত্বরান্বিত ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে আপনি হয়ে উঠবেন সতেজ আর তারুণ্যের অধিকারী।
মাথা-ব্যথার প্রাকৃতিক চিকিৎসা হচ্ছে পানি। মাথা-ব্যথা হতে পারে অনেক কারণেই। যার মধ্যে পানিশূন্যতা অন্যতম। তাই নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পানি পান করে আপনি মুক্তি পেতে পারেন যন্ত্রণাদায়ক মাথা-ব্যথা থেকে। সাধারণ মাথা-ব্যথাই কেবর নয়, মাইগ্রেনজনিত মাথা-ব্যথা উপশমেও প্রচুর পানি পানে উৎসাহ জুগিয়েছেন-এখন বিজ্ঞানীরা।
ভারী পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে থাকলে বা অতিরিক্ত ব্যায়াম করতে থাকলে শরীরে পানি শূণ্যতার সৃষ্টি হতে পারে। মাসল ক্র্যাম্প বা তীব্র যন্ত্রণাদায়ক পেশি সংকোচনের শিকার হতে পারেন কেউ কেউ। গবেষকেরা বলছেন, ভারী পরিশ্রম বা ভারী ব্যায়ামের আগে-পরে যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান করলে ক্লান্তি দূর হওয়ার পাশাপাশি অযাচিত পেশি-সংকোচনের ঝুঁকি কমে।
পানি পানে স্ট্রেস কমে, রীতিমত গবেষণায় প্রমাণিত। মাত্র হাফ লিটার পানির ঘাটতি হলেই শরীরে স্ট্রেস হরমোনের প্রবাহ বেড়ে যায়। ফলে দেহ-মন-স্ট্রেসে আক্রান্ত হতে পারে। দেহে পািনশূন্যতা দেখা দিলে যেমন স্ট্রেস সৃষ্টি হয়, তেমনি স্ট্রেসের কারণেও দেহে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। সত্যি এ এক দুষ্টচক্র বটে। আর পানি পান হতে পারে এ দুষ্টচক্র ভাঙ্গার সহজ উপায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে অবশ্যই পানি। যথেষ্ট পরিমাণ পানির অভাবে কোলনের ভেতরটা শুকিয়ে যায়, ফলে বর্জ্য ঠিকমত নির্গত হয় না। সারাদিনে একটু একটু করে পর্যাপ্ত পানি পান না করলে কোলন ও মূত্রথলিতে ক্যান্সারের আংশকা থেকেই যায়। তবে প্রতিদিন টয়লেট ক্লিন থাকলে সে আশংকা থাকে না। প্রতিদিন টয়লেট ক্লিন রাখবেন কিভাবে? খাবারে প্রতিদিন আঁশযুক্ত সবজি রাখবেন। মাছ-মাংস অনেকটা এড়িয়ে যাবেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মূত্র ত্যাগ করার পর ২-৩ গ্লাস কুসুম গরম পানি খেয়ে একটু পায়চারী করুন। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে আশা করি টয়লেট ক্লিনের ডাক পড়বে। তা না হলে সকালের হাঁটায় বেরিয়ে যান। ২০-৩০ দানা কালিজিরা মুখে নিয়ে চিবাতে বিচাতে হাঁটতে থাকুন। ২০-৩০ মিনিট বা ১ ঘন্টা হা্টুঁন। ঘরে এসে আবার ২-৩ গ্লাস পানি পান করুন। চাইলে ইসবগুলের ভূষি মিশ্রিত পানিও পান করতে পারেন। তবে সকালের মত আর কুসুম গরম জল পান করার প্রয়োজন নেই। আশা করি, প্রকৃতির ডাক শুনতে পাবেন।
গ্যাস্ট্রিক? খাওয়ার আধঘন্টা আগে টেবলেট খেতে হচ্ছে? আর টেবলেট খাওয়ার দরকার নেই! খাওার আধ ঘন্টা আগে এবং খাওয়ার আধ ঘন্টা পরে বরং ১ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করুন। টেবলেটের প্রয়োজনই হবে না। এতে নিশ্চিত গ্যারান্টি দেয়া যাচ্ছে কিন্তু তবে ভাজা-পোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। বিড়ি-সিগারেট বন্ধ করতে হবে। কুসুম গরম দুধ খাবেন, কিন্তু দুধওয়ালা চা-কফি বর্জন করতে হবে। কারণ, চা-কফির সাথে দুধের মিশ্রণ হজমে গন্ডগোল হয়। সারাদিন একটু একটু করে বিশুদ্ধ পানি খেলে আশা করা যায় গ্যাস্ট্রিক-আলসার চিরতরে বিদায় নেবে।
তৃষ্ণা পেলে কোল্ড ড্রিংসক বা এনার্জি ড্রিংসক নয়, পানিই পান করুন। কারণ, পানিই সেরা পানীয়। তবে পানিটা যেন হয় বিশুদ্ধ। ঠান্ডা পানি নয় বরং স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিই স্বাস্থ্যকর। আর বোতলজাত পানি যতটা সম্ভব। এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, বোতলজাত পানিকে তরতাজা রাখার জন্য প্রিজারভেটিভ দেয়া হয়। ইথিলিন গ্লাইকলও দেয়া হয়, যে কারণে ফ্রিজে ৪ ডিগ্রি সেন্ডিগ্রেড তাপমাত্রার নীচে থাকলেও জমে যায় না, বরফ হয় না! সব সময় টিউবওয়েলের পানি পান করুন। তবে অবশ্যই আর্সেনিকমুক্ত টিউওয়েলের পানি হতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের বা পৌরসভার সরবরাহকৃত পানিও পান করতে পারেন। অবশ্যই ছেঁকে নিতে হবে ভালো ফিল্টার দিয়ে। অথবা পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। ফুটালে একটাই সমস্যা, পানির গুণাগুণ চলে যেতে পারে। উল্লেখ্য, হার্ট ফেইলিউর, কিডনি ও লিভার সমস্যার রোগী, পেট কিংবা পা ফোলা রোগে যারা ভুগছেন, তারা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পানি পান করবেন।
লেখক : কলামিস্ট।