ক্রীতদাসের হাসি : সমানুসন্ধানের ষাট বছর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০২২, ৬:১৭:২৪ অপরাহ্ন

মামুন রশীদ
শওকত ওসমান মূলত গদ্যশিল্পী। পুরো নাম শেখ আজিজুর রহমান। কিন্তু শওকত ওসমান নামের আড়ালে যেমন হারিয়ে গেছে পারিবারিক নাম। তেমনি সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করলেও হারিয়ে গেছে অন্যান্য পরিচয়। প্রধান হয়ে উঠেছে তার গদ্যশিল্পী পরিচয়। অথচ লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, কবিতা, রাজনৈতিক ভাষ্যসহ নানা বিষয়ে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও শতাধিক। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মাঝে রয়েছে- উপন্যাস : জননী, ক্রীতদাসের হাসি, রাজা উপাখ্যান, জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরণ্য। গল্পগ্রন্থ : জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, জন্ম যদি তব বঙ্গে। প্রবন্ধগ্রন্থ : সং¯ৃ‹তির চড়াই উৎরাই, মুসলিম মানসের রূপান্তর। নাটক : আমলার মামলা, তস্কর ও লস্কর, বাগদাদের কবি। স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ : মুজিবনগর, মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা ইত্যাদি। শওকত ওসমান বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদের মধ্য দিয়েও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য অনুবাদের মাঝে রয়েছে- নিশো, লুকনিতশি, টাইম মেশিন, নাটক বাগদাদের কবি, লিও টলস্টয়ের পাঁচটি কাহিনী, স্পেনের ছোটগল্প, মলিয়ারের পাঁচটি নাটক ইত্যাদি। কবিতাও লিখেছেন। সাহিত্য জগতে প্রবেশও কবিতার হাত ধরে। আমৃত্যু তিনি কবিতা লিখেছেন। জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছেও কবিতাকে ছাড়েননি। সমাজ, রাজনীতি, পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে লিখে গেছেন ‘শেখের সম্বরা’। সেই সঙ্গে প্রিয়জনের ব্যক্তিগত ডায়েরি, অটোগ্রাফের খাতা, বই উপহার দেবার সময়ে বইয়ের পাতায় কয়েক লাইনের কবিতা লিখেছেন অজস্র। সেসবের অধিকাংশই হারিয়ে গেছে, সংরক্ষিত হয়নি। এতসব লেখালেখি, পরিচয়, অধ্যাপনার খ্যাতি পেরিয়েই তিনি গদ্যশিল্পী। ‘বনি আদম’ নামে উপন্যাসটির কিছু অংশ প্রথম ছাপা হয় ১৯৪৬ সালে দৈনিক আজাদের ঈদসংখ্যায়। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসটিকেই তিনি খোলনলচে পাল্টে নতুন করে লেখেন, যা ১৯৯০ সালে প্রকাশ পায়। শওকত ওসমানের বই আকারে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘জননী’। এটি প্রকাশ পায় ১৯৬১ সালে। এর পরের বছরেই (১৯৬২) প্রকাশ পায়, তার সাড়া জাগানো উপস্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’। প্রকাশের পর থেকেই উপন্যাসটি নানাভাবে ঘুরেফিরে যেমন আলোচনায় আসতে থাকে তেমনি প্রকাশের ষাট বছর পর, আজও উপন্যাসটি সমান আলোচিত এবং প্রাসঙ্গিক। শওকত ওসমান যখন উপন্যাসটি রচনা করেন, তখন পৃথিবীর মানচিত্রে আজকের বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়নি। পাকিস্তানে তখন চলছে সামরিক শাসন। ক্ষমতায় জেনারেল আইয়ুব খান। সেই দুঃসময়ে, দুঃসহ পরিবেশে যখন মানুষের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর স্তব্ধ, বাঙালির কথা বলার অধিকার নেই, সামরিক শাসনের সেই দুর্বিষহ সময়ে, আমরা দেখি খলিফা হরুন-অর-রশিদের হাবশি গোলাম তাতারী আর তার হারেমের বাদী মেহেরজানের উচ্ছলিত হাসি। যে হাসি গোলামির, কিন্তু সেই হাসির মধ্যেও রয়েছে শেকল ভাঙার সচেতন প্রয়াস। তাই শত নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও হাবশি গোলাম তাতারী বলতে পারে, ‘দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বাঁদি কেনা সম্ভব-! কিন্তু-কিন্তু-ক্রীতদাসের হাসি-না-না-না-না-।’
ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে, আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশিদের খেলাফতকালকে ধরে। নিজের বোন ও উজিরকে হত্যার আদেশ দেওয়া আমিরুল মোমেনিন হারুন-অর-রশিদ তার অস্থির মনের শুশ্রƒষার জন্য বাগানে হাঁটতে আসেন। রাতের অন্ধকারে বাগানে হাঁটার সময়ে খলিফা শুনতে পান একজোড়া মানব-মানবীর অস্পষ্ট হাসি। এমন প্রাণখোলা সজীব হাসি তো খলিফা হাসতে পারছেন না। অথচ তার রয়েছে অঢেল সম্পদ, রয়েছে অগণন দাস-দাসী, রয়েছে ক্ষমতা। তাই হাসির উৎস খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন খলিফা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এই হাসির উৎসে রয়েছে হাবশি গোলাম তাতারী ও তার স্ত্রী হারেমের বাঁদি মেহেরজান। খলিফা তাদের মুক্ত করে দেন। কিন্তু সেই মুক্তি আসলে আরও অধিক শৃঙ্খলিত জীবন। দাস জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে মেহেরজানের স্থান হয় খলিফার হারেমে। আর তাতারীকে অনেক অর্থ আর দাস দিয়ে জানানো হয়, বিনিময়ে তাকে শোনাতে হবে সেই উদ্দাম, উচ্ছল হাসি। কিন্তু বন্দিজীবনে সেই হাসি কোথায়? মনের আনন্দ হারিয়ে যাওয়ায় হাসতে ভুলে যায় তাতারী। শত প্রলোভনেও তাতারী হাসে না। খলিফা হেরে যেতে থাকেন, বাড়তে থাকে জেদ। তাতারীর ওপর চলল অমানুষিক নির্যাতন, তবুও তার মুখে হাসি নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে নিয়ে আসা হলো তার প্রেমিকা মেহেরজানকে। যে এই চার বছরে ভুলে গেছে তাতারীকে। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আভিজাত্য তার জীবনে প্রতিফলিত হওয়ায়, ভুলে গেছে পেছনের পথ। তাতারীর জন্য নেই তার চোখে সেই ব্যগ্রতা, সেই আকুলতা। কিন্তু তাতারী তার অতীতকে ভোলেনি, ভোলেনি ভালোবাসার মানুষকে। তাই শেষাবধি তাতারীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, শৃঙ্খলিত মানুষের জয়গান, সম্পদের তুচ্ছতা, মুক্তিসংগ্রামের মেহনতি মানুষের প্রেরণা ও সাহস জোগানো উক্তি। আমিরুল মোমেনিনের উদ্দেশে তাতারী চিৎকার করে জানিয়ে দেয়, দিরহামের বিনিময়ে ক্রীতদাস কেনা যেতে পারে, কিন্তু তার হাসিকে নয়।
শওকত ওসমানের সবচেয়ে আলোচিত এবং সাড়া জাগানো এই উপন্যাসটি স্বকালে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিল, সেই খ্যাতি আজ প্রকাশের ষাট বছর পরও সমান। একজন লেখক মানুষকে উদ্দীপ্ত করেন, উদ্বুদ্ধ করেন, স্বপ্ন দেখান। আশি বছরের জীবনের ষাট বছরেও বেশি লেখার জগতে কাটানো শওকত ওসমান তার লেখার মধ্য দিয়ে সেই কাজটিই করেছেন। আর তাই তার হাবশি গোলাম মুখোশের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখেনি, লোভের ফাঁদে পড়েনি। স্পষ্ট প্রতিবাদী কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছে, ক্রীতদাস কেনা যায়, কিন্তু তার হাসি নয়। তাতারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে বন্দিজীবনের, দাসত্বের শৃঙ্খল পরানো মানুষের যে আর্তনাদ শওকত ওসমান তুলে ধরেন, তা মুক্তিসংগ্রামের শক্তিরই প্রতীকায়ন।
ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাস, অথচ এটি ঠিক টানা গদ্যে, উপন্যাসের প্রচলিত ফর্মে লেখা হয়নি। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলের, তারই বিরোধিতা করে লেখা উপন্যাসটিতে যে প্রতীকায়ন করা হয়েছে, তেমনি করা হয়েছে নিরীক্ষাও। পুরো উপন্যাসটিই নাটকের মতো সংলাপধর্মী, যা মঞ্চস্থও হয়েছে। আবার এই উপন্যাসটির জন্য ১৯৬২ সালেই শওকত ওসমান অর্জন করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। আর সেই পুরস্কারটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন স্বয়ং আইয়ুব খানের হাত থেকে। এ প্রসঙ্গে তিনি পুঁথিঘর লিমিটেড থেকে ১৯৯৫ সালে পুনর্মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’র ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘জুয়াড়ির মতো আমি দান ধরেছিলাম। হয় জয়, অথবা সর্বনাশ সুনিশ্চিত। জিতে গিয়েছিলাম শাসকশ্রেণির মূর্খতার জন্য। বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরস্কার পায় ক্রীতদাসের হাসি।’
জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতাও বন্দি করেন। ক্ষমতা গ্রহণ থেকে উপন্যাসটির রচনাকালের মাঝে সময় চার বছর। আরব্যরজনীর গল্পের রূপকে ক্রীতদাসের হাসির নায়ক তাতারীও খলিফার হাতে বন্দি চার বছর। এ সময়ে তার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য খলিফার প্রাণান্ত চেষ্টা, ব্যর্থতা, ক্ষোভে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠা সময় প্রতীকায়িত হয়ে তৎকালীন সময়কেই উপস্থিত করেছে। লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হাবশি গোলাম তাতারীর মুখে উচ্চারিত বাক্য ‘হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি’, এর মধ্য দিয়ে শওকত ওসমান নিপীড়িত, প্রবঞ্চিত মানুষের জীবনে অনিবার্য হয়ে ওঠা জাগরণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তীক্ষè অনুসন্ধানী জীবনদৃষ্টির অধিকারী শওকত ওসমান সচেতন ছিলেন জীবনের গভীর স্তরগুলোর বিষয়ে। দুরারোগ্য অসুখকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন সামাজিক সুস্থতার জন্য, এ ক্ষেত্রে লেখকের স্বাধীনতায় সমাজের যে অস্বীকৃতি তার বিরুদ্ধেও স্পষ্ট প্রতিবাদ বিধৃত হয়ে আছে তার লেখা। শওকত ওসমানের রচনায় সমাজ অনুসন্ধানের প্রয়াস যে তা শুধু ক্রীতদাসের হাসিতেই নয়, ছড়িয়ে রয়েছে তার প্রতিটি রচনাতে, রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সুপরিণত মনের প্রকাশ। যার স্পর্শে জেগে ওঠে চেতনা, উৎসারিত হয় মানবপ্রেম।