খোকনের ইশকুলে ফেরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২১, ৪:২২:২৭ অপরাহ্ন

সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী
খোকনের মুখে হাসির ঝলক যেন আকাশ থেকে মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। আগামীকাল থেকে আবারও শুরু হবে ইশকুল। বিশ্বব্যাপী করোনা-ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইশকুল বন্ধ থাকার দিনগুলো কী যে কষ্টের ছিল, তা শুধু খোকন জানে। টেলিভিশনে ইশকুল খুলে দেওয়ার ঘোষণা শোনার পরপরই আনন্দের পাশাপাশি ওর আব্বু-আম্মুর ব্যস্ততা ভীষণ রকম বেড়ে গেছে। ব্যস্ততার কারণ হচ্ছে – নতুন ইশকুল ড্রেস তৈরির জন্য দিয়েছেন পাড়ার একটি টেইলার্সে। সেখানেও ভীষণ ভিড়। সবারই ইশকুল ড্রেস ছোটো হয়ে গিয়েছে এই দীর্ঘ ছুটিতে। এছাড়া খাতা, কলমসহ ক্লাসে ব্যবহারের যাবতীয় জিনিসপত্র কেনা নিয়েও ব্যস্ততা বেড়েছে। এ ব্যস্ততায় কারও যেন ক্লান্তি নেই, এ যেন ইশকুলে ফেরার আনন্দের ব্যস্ততা।
কত দিন পর ইশকুল খুলবে, ভাবতেই কত ভালো লাগছে খোকনের। ক্লাসে বন্ধুদের সাথে দীর্ঘদিন পর দেখা-সাক্ষাৎ হবে। এইসব ভেবে রাতে বিছানায় শুয়ে খোকনের ঘুম আসে না। ভাবতে থাকে, কখন সকাল হবে। কখন ইশকুলের জন্য তৈরি হবে। সে আনন্দে হেলেদুলে ইশকুলে যাবে। ওর সাথে পাড়ার বন্ধুরা যাবে। দলবেঁধে ইশকুলে যাওয়ার কী যে মজা। এসব ভাবতে ভাবতেও সময় যেন ফুরাতে চায় না খোকনের।
মহামারী করোনা-ভাইরাসের কারণে ইশকুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবারই পড়ালেখায় ছেদ পড়েছিল। এ দলে খোকনও ছিল। বই নিয়ে বসা হয়নি অনেক দিন। এর মধ্যে পড়তে কি কারও মন বসে? টেলিভিশনে প্রতিদিন লাশের খবর শুনে চোখ জলে ভিজে যেতো। মন যেন কেমন উতলা হয়ে উঠতো। চারদিকে, চারপাশে শূন্যতা- এই বুঝি আমারও আপনজন করোনার ছোবলে বিদায় নিয়ে চলে যাবে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে দেখা নেই প্রিয়জনদের সাথেও। খোকন দীর্ঘদিন ধরে ওর আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যেতে পারে না। অনেককে সে ভুলে গেছে।
পরের দিন। খোকন সেই সাতসকালে বিছানা ছেড়ে ওঠে। ঘুম ভালো হয়নি ইশকুলে ফেরার আনন্দে। এ যেন আনন্দে নির্ঘুম রাত কেটেছে খোকনের। বিছানা ছেড়ে ওঠার পর বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুঁয়ে আসে। আম্মু এসে ইশকুল ড্রেস পরিয়ে দেয়। খোকন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে – কী সুন্দর লাগছে নতুন ড্রেসে। জীবনে প্রথম যেদিন ইশকুলে গিয়েছিল, ওই দিনটার কথা মনে পড়ে। আম্মুকে জিগ্যেস করে, ‘আম্মু, আমি এর আগে মনে হয় ইশকুলে যাইনি, আজই প্রথম যাচ্ছি, এমন মনে হচ্ছে।’
খোকনের আম্মু হাসতে হাসতে বলে, ‘ঠিকই বলেছ, খোকনসোনা। আমরা বেঁচে আছি বলে আবারও শুভ দিন পেলাম। আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
‘জি, আম্মু। আমি সবসময় মাস্ক পরে ইশকুলে যাবো।’
ইশকুলে ফেরার আনন্দে চোখেমুখে খুশির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে খোকনের। ইশকুল ড্রেস পরে বাবা-মার সাথে নাস্তা করে। তারপর বাবা-মাকে সালাম করে। বাবা-মা আদর দেয়, বুকে জড়িয়ে নেয় তাদের একমাত্র খোকনসোনাকে। অতঃপর ইশকুল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা হয় ইশকুলে। সতেজ সকালে হাঁটতে থাকে অলিগলি পেরিয়ে। ধিরে ধিরে ওর সাথে যোগ হয় অন্যান্য সহপাঠি। হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে এক সময় ইশকুলে পৌঁছে যায়। ইশকুলটাকে একটু অচেনা অচেনা লাগে। কতদিন পর দেখা! ইশকুলের স্যারদের অফিস কক্ষে দেখে মনের ভেতর আনন্দের বান বয়ে যেতে থাকে। ক্লাসে ঢুকে প্রিয় বন্ধুদের দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় খোকন। ক্লাসে অন্যরকম এক পরিবেশ হয়ে ওঠে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে- এসব লিখে দেয়ালে ছবি টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইশকুলে এমন নতুন নিয়ম দেখে বেশ ভালো লাগে খোকনের। ভাবে, নিয়ম মেনে চলি, তাও যেন ইশকুল আর বন্ধ না হয় কখনও।
দশটার ঘন্টা বাজতেই ইংরেজি ক্লাসে স্যার আসেন। ক্লাস নেন। এভাবে একে একে বাংলা ক্লাসে আসেন ম্যাডাম। এইভাবে অংক ও অন্যান্য বিষয়ের ক্লাস করে মন দিয়ে। দুইটা বাজতেই ইশকুলে ছুটির ঘন্টা বাজে টুংটাং শব্দে। কিন্তু আওয়াজটা আজ ভিন্নরকম লাগে। খোকন তাকিয়ে দেখে অন্য একজন বাজাচ্ছে। জানতে পারে- আগের বুড়ো দাদু নেই। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মাস ছয়েক আগে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর কথা শুনে খোকনের মন ভার হয়ে যায়। দপ্তরি দাদুকে নিয়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে ওর। খোশগল্পে কত কথা বলতেন দাদু। দাদু নেই, ইশকুল আছে। ইশকুল আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আবার ক্লাস শুরু হয়েছে, এই আনন্দ নিয়ে খোকন বাড়ি ফেরে।