গান্ধীর সিলেট সফর ও আব্দুল্লাহ বিএল-এর দিনপঞ্জিকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৪:১৯:২৯ অপরাহ্ন

রফিকুর রহমান লজু
মহাত্মা মোহনচান করমচান গান্ধী একাধিকবার সিলেট সফর করেছেন। প্রায় শত বছর আগে ১৯২১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি প্রথম সিলেটে পদার্পন করেছিলেন। স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলনের নেতা ছিলেন মহাত্মাগান্ধী। তিনি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী করার জন্য স্বরাজ ও অসহযোগ আন্দোলনকে খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা জরুরী। সে সময় সিলেটে খেলাফত আন্দোলন জোরদার ছিলো। এজন্যে তিনি সিলেটকে হিসাবের মধ্যে রেখেছিলেন। তাই উত্তর-পূর্ব ভারত সফর করে গান্ধীজী সিলেট চলে এসেছিলেন। আসার পথে বদরপুর এক সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।
সে সময় সিলেটে রাজনীতিবিদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আব্দুল হামিদ, সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া, আব্দুল মতিন চৌধুরী, জিতু মিয়া, আবুল হাসান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রমুখ। গান্ধীজীকে যথাযোগ্যে ভাবে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। অভ্যর্থনা কমিটির সচিব করা হয় আবুল হাসান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিএলকে। সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে গান্ধীজীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়।
সিলেটে খেলাফত আন্দোলনে সামনের সারির নেতা ছিলেন আব্দুল্লাহ বিএল। তাঁর হাওয়া পাড়ার বাসায় খেলাফতের অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। সিলেটে ভাষা আন্দোলনেও তিনি সম্মুখসারিতে ছিলেন।
মহাত্মাগান্ধী সিলেটে একটি জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন। আব্দুল্লাহ বিএল ও অন্যরা জনসভার আয়োজন করেছিলেন।
গান্ধীজী সিলেটে এসেছিলেন ২৯ আগস্ট ১৯২১ সালে। ওই দিন তিনি সিলেটে অবস্থান করেন। ৩০ আগস্ট মঙ্গলবার বিকেলে ট্রেন যোগে গান্ধীজী চট্টগ্রাম চলে যান।
মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিএল মহাত্মা গান্ধীর সিলেট আগমন উপলক্ষে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে, তাঁকে সংবর্ধনা দিতে কয়েকটা দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছেন।
আব্দুল্লাহ্ বিএল দিনপঞ্জিকাতে লিখেছেন মহাত্মাকে আমন্ত্রণ করার জন্য আব্দুল হামিদ সাহেব যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষে তিনি যেতে অপারগতা দেখালে মাওলানা সখাওয়াতুল আম্বিয়া সাহেবকে গৌহাটি পাঠানো হয়। এ সময় আব্দুল্লাহ্ বিএল পরপর এগার দিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট, ১৯২১ বৃহস্পতিবার থেকে ৩০ আগস্ট ১৯২১ মঙ্গলবার গান্ধীজী ফিরে যাবার দিন পর্যন্ত দিনপঞ্জিকা লিখেছিলেন যা পরে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
আমার লেখার পাঠকবৃন্দের জন্য দিনপঞ্জিকাগুলো হুবহু তুলে ধরলাম।
মরহুম আব্দুল্লাহ তাঁর দিনপঞ্জিকাতে লিখেছেন মহাত্মাকে আমন্ত্রণ করার জন্য আব্দুল হামিদ সাহেব যাওয়ার কথা ছিল। তিনি অপারগতা দেখালে মৌলানা সখাওয়াতুল আম্বিয়া সাহেবকে গৌহাটি পাঠানো হয়। ইংরেজিতে লিখা তাঁর অপ্রকাশিত দিনপঞ্জিকার অনুবাদ আগ্রহী পাঠকদের জন্য নিম্নে তুলে ধরা হলো :
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৬, ১৯২১ : খুব ভোরে সাইকেল চালিয়ে মৌলভী আব্দুল হামিদ সাহেবের বাসায় যাই। সেখান থেকে হামিদ সাহেবের সাথে সুপানিঘাট, মজুমদারি ও দরগা মহল্লা যাই। হামিদ সাহেব অনেক বাসায় যান এবং নাস্তা গ্রহণ করেন। বেলা ১টায় বাসায় ফিরে আহার করি। প্রথমে কথা ছিল মৌলভী আব্দুল হামিদ সাহেব গৌহাটি গিয়ে মহাত্মা গান্ধীকে সিলেট আসার আমন্ত্রণ জানাবেন। কিন্তু তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে এক ধরণের ব্যাকুলতা অনুভব করি।
বুধবার আগস্ট ১৭, ১৯২১ : প্রতিদিনের কাজ সারি। সখাওয়াতুল আম্বিয়া সাহেবকে গৌহাটি পাঠানো গেল। মাথা কোনো কাজ করছে না- একাকিত্ব অনুভব করছি।
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৮, ১৯২১ : সমগ্র বিকেল বেলা জুড়ে সংবর্ধনা কমিটির সভা ছিল। মহাত্মা গান্ধীর আগমন উপলক্ষে কিভাবে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে সে বিষয়ে। আমাকে সংবর্ধনা কমিটির সচিব বানানো হয়।
শুক্রবার, আগস্ট ১৯, ১৯২১ : যেথা পূর্বং। মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে খবর আসলো তিনি এই মাসের ২৮ তারিখ আসবেন।
শনিবার, আগস্ট ২০, ১৯২১ : মোহাম্মদ আলী খবর পাঠালেন তিনি সময়মত পৌঁছাবেন। আমাদের উৎসাহ বেড়ে গেল।
বুধবার, আগস্ট ২৪, ১৯২১ : সারাদিন একাধিক টেলিগ্রাম লিখায় ব্যস্ত ছিলাম।
শুক্রবার, আগস্ট-২৬, ১৯২১ : ভোরবেলা চট্টগ্রাম কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল বাবু নৃপেন্দ্র ব্যানার্জি দেখা করলেন। তিনি নিজে একজন অসহযোগী। বিকেল বেলা তিনি জাতীয় বিদ্যালয়ে ভাষণ দেন।
শনিবার, আগস্ট-২৭, ১৯২১ : মহাত্মাজি আর তার দলবলের আগমন উপলক্ষে আগাম টেলিগ্রাম গ্রহণ করি।
রবিবার, আগস্ট-২৮, ১৯২১ : এটা নিশ্চিত যে মহাত্মা আগামীকাল ভারতের শিলচর থেকে বিশেষ ট্রেনে সিলেট পৌঁছাচ্ছেন। সংবর্ধনার কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু আবহাওয়া বেশ প্রতিকূল।
সোমবার, আগস্ট-২৯, ১৯২১ : সারারাত ধরে প্রবল বৃষ্টি ছিল। ভোর বেলা রেলস্টেশনে যাই। বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও প্রায় ১০ হাজার মানুষ রেলস্টেশনে উপস্থিত হয়েছেন। ট্রেন স্টেশনে আসলে মহাত্মা গান্ধীকে একটি আলাদা নৌকায় করে আনা হয়। মোহাম্মদ আলী ও অন্যরা একটি শোভাযাত্রা নিয়ে উপস্থিত হন। গান্ধী যে বাসায় ছিলেন সেই বাসার সামনে জনতার উপস্থিতি সারাদিন ছিল। বিকেলে মোহাম্মদ আলী ও সুভাষিনী ঈদগাতে এক সভায় বক্তব্য দেন। সন্ধ্যা বেলা ঈদগাতে একটি বড় সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে মহাত্মা গান্ধী বক্তব্য দেন। রাতে মহিলাদের দুটো সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মঙ্গলবার, আগস্ট-৩০, ১৯২১ : ভোরে ঈদগাতে আরেকটি সভা হয়। ফেরার পথে মোহাম্মদ আলী আমার বয়ন বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। দুপুরে মহাত্মার সঙ্গে দেখা হয় এবং দীর্ঘ আলোচনা হয়। বিকেলে মহাত্মা আমার বয়ন বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। আমি ক্লান্তিতে অসুস্থ বোধ করি। বিকেল ৬টার সময় তারা রেলগাড়িতে চট্টগ্রাম চলে যান।