চেনা শহরে অচেনা মানুষ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২২, ৭:৩০:৩৯ অপরাহ্ন

সিরাজউদ্দিন আহমেদ
ঢাকা শহরে একজন অচেনা মানুষ ঢুকেছে। তার পোশাক-আশাক, চেহারা, বর্ণ সবকিছু আলাদা। কোন দেশের মানুষ তা বোঝার কোনো উপায় নেই। কথা বললে তার ভাষা, উচ্চারণভঙ্গি শুনে ধারণা করা যেত কোন অঞ্চল, রাষ্ট্র, ধর্ম, গোষ্ঠীর মানুষ। লোকটি কথা বলে, কী বলছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিস্ময়ের ঘটনা তার কথার কোনো উচ্চারণ নেই, ধ্বনি নেই, ভাষা নেই, কিন্তু বাণী আছে। যাকে বলছে সে খুব সহজে লোকটির কথা বুঝতে পারে। তার ভাষায় কথা বলে। লোকটিরও তার ভাষা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটে।
হাবিব মিয়ার একটা ছোটখাটো রেস্টুরেন্ট আছে। ফজরের নামাজ পড়ে দোকানের কাজ শুরু করতে হয়। কদিন ধরে তার মন উতলা হয়ে আছে। কাজে মন বসাতে পারে না। বিয়ের দশ বছর পর আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে সে বাবা হতে চলছে। তার স্ত্রীর শরীর কদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। ডাক্তারের হিসাব মতে তার শিশু জন্মাতে এখনও বিশ দিন বাকি। তার স্ত্রী প্রথম সন্তান মৃত প্রসব করেছে। সেই বিভীষিকা তাকে এখনও তাড়া করে ফিরে। এবার শিশু জীবিত হবে তো? এই টেনশনে ও সাতসকালে কাজের ব্যস্ততায় হাবিব মিয়ার ওপর একটা ছায়া পড়ল। হাবিব মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল-
কী খাইবেন?
কোনো উত্তর পেল না। লোকটি মনে হয় বিদেশি। যেমন সাদা ধবধবে। হাবিব প্রাইমারি পাস, টুকটাক ইংরেজি বলতে পারে। আবার জিজ্ঞেস করল-
হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? ব্রেকফাস্ট?
আপকো ব্রেকফাস্ট চাইয়ে?
এ তো ভারি মুশকিলে পড়া গেল! এ দেখছি ইংরেজি বাংলা-হিন্দি কোনোটাই বুঝে না।
একজন কর্মচারী জিলাপি ভাজছে। লোকটি খুব আগ্রহ নিয়ে জিলাপি তৈরি দেখছে।
হাবিব মিয়া স্পষ্ট শুনল, অচেনা লোকটি বাংলায় জিজ্ঞেস করল-
এটা কী?
জিলাপি।
জিলাপি খাব।
লোকটি হাসিমুখে হাবিব মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। হাবিব শুনতে পেল, লোকটি বলছে-
তোমার সুখবর আছে। তুমি ছেলের বাবা হয়েছ। অভিনন্দন।
হাবিব মিয়া অবাক হয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঘটনা কী? লোকটির ঠোঁট নড়ছে না, কথা বলছে না, কিন্তু তার কানে মনে এ কথা কে বলছে? হাবিবের ভয় ভয় করতে লাগল।
এমন সময় হাবিব দেখতে পেল তার ভাতিজা চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে-চাচাজান, চাচির পোলা হইছে।
হাবিব কী করবে, ভেবে পেল না। ভয়ে বিস্ময়ে একবার অচেনা লোকটির দিকে তাকাল। তারপর ছুটে গেল বাড়িতে।
ডিউটি পুলিশ অচেনা লোকটিকে আটকাল। লোকটির আচরণ সন্দেহজনক, বিদেশি মনে হচ্ছে। সিপাই ইংরেজি জানে না, তাই জিজ্ঞাসাবাদে না গিয়ে তাকে থানায় নিয়ে এসেছে।
ওসি সাহেব কড়া মেজাজের মানুষ। কথা কম অ্যাকশন বেশি। ওসি সাহেব অভিজ্ঞতায় দেখেছেন পুলিশের পেশায় বেশি কথা বলা মানুষ হচ্ছে দুর্বল অফিসার। কম কথা বলা ডাইরেক্ট অ্যাকশনে যাওয়া অফিসারকে সবাই ভয় পায়। না চাইতে টাকা চলে আসে। তার সুনাম ও গোপন সম্পদের কারণে সে ডিআইজিরও ঈর্ষার পাত্র।
সাতসকালে সাদা চামড়ার আসামি পেয়ে ওসির মেজাজ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। ব্যাটা নির্ঘাত মাদক চোরাকারবারি। মাদক কারবারি না হলেও অসুবিধা নেই। মাদক আসামি করার যাবতীয় তথ্য প্রমাণ তৈরি করা আছে। বনিবনা না হলে মাদক মামলায় জেলে পচবে।
ওসি কড়া সুরে ইংরেজিতে বলল-
আমি বেশি কথা পছন্দ করি না। তোমার পাসপোর্ট ভিসা ড্রাগের যে চালান এনেছ সব টেবিলে রাখো। আমার কথামতো কাজ করলে সহজে ছাড়া পাবে। তা না হলে সারাজীবন জেলে পচে মরতে হবে।
লোকটি মুখে কোনো কথা বলছে না। ওসির কান ও হƒদয় স্পষ্ট শুনতে পেল, বাংলায় কেউ বলছে-
আমি বিনা পাসপোর্টে বিনা ভিসায় বিশ্বভ্রমণ করতে পারি। আমার কাছে কোনো ড্রাগ নেই। কোথায় তোমার কোন এজেন্টের কাছে কত হাজার কেজি ড্রাগস স্টোরেজ করেছ এবং তোমার বিক্রির নেটওয়ার্ক আমার কাছে আছে। সেই প্রমাণ দিতে আমি এসেছি। তোমার বড় ছেলে রবিনের কথা এরই মধ্যে ভুলে গেছ?
ওসি সভয়ে বলল-
স্যার, আপনি কে? আমি বুঝতে পারি নাই। আমাকে মাফ করে দেন।
আমি কেউ না, আবার আমিই সব। আমি প্রতি মুহূর্ত অনুসরণ করি। সব কাজ রেকর্ড করি। প্রয়োজনমতো প্রকাশ করি।
এমন সময় রবিনের গলা শোনা গেল। করুণ স্বরে সে জিজ্ঞেস করল-
বাবা, কেন এমন হলো? বাইশ বছর বয়সে আমাকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে হলো। আমি ধরা পড়লাম। ফাঁস হওয়ার ভয়ে তোমার লোক দিয়ে আমাকে হত্যা করলে!
ওসি চিৎকার করে বলল-
মিথ্যে কথা বিশ্বাস কর তোকে আমি হত্যা করিনি। আমার নেটওয়ার্ক ভাঙার জন্য মিথ্যা গুজব ছড়িয়েছে আমার প্রতিপক্ষের দল। তোকে যে হত্যা করেছে, আমি তাকে হত্যা করেছি। প্রতিশোধ নিয়েছি।
তাতে কার কী লাভ হয়েছে? আমি কি জীবন ফিরে পেয়েছি? আমি ডাক্তার হয়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে চেয়েছি। তোমরা টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে দলে টেনে নিলে। দেশের যুবসমাজকে নেশার চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিলে। যত নেশা তত টাকা। বাবা হয়ে টাকার জন্য আমাকে নেশার কাছে বিক্রি করে দিলে? মাটির নিচে অন্ধকার এক জীবনে আমি চিরকালের জন্য ডুবে গেলাম। তোমাদের আর কত টাকা দরকার? দেশের আর কত সর্বনাশ করবে?
ওসি অচেনা লোকটির কপাল বরাবর পিস্তল উঁচিয়ে ধরল-তুই ভেবেছিস তোর বকবকানি শুনে আমি ভয়ে অস্থির হয়ে যাব। তুই জানিস আমাদের নেটওয়ার্কের শেকড় কত গভীরে? আমরা সবাই খেলোয়াড়। আড়াল থেকে খেলাচ্ছে অন্য কেউ। তোকে লাশ বানাতে আমার দু’মিনিট সময়ও লাগবে না। নেটওয়ার্কের সব ডকুমেন্ট টেবিলে রাখ। তোকে দু’মিনিট সময় দিলাম।
দু’মিনিট পর গুলির শব্দ শোনা গেল।
পরদিন জাতীয় পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলো ড্রাগ সিন্ডিকেটের চাঞ্চল্যকর খবর, ওসির আত্মহত্যা। আন্ডারওয়ার্ল্ডে ড্রাগ আমদানি ও মার্কেটিংয়ের গোপন নেটওয়ার্ক। চুনোপুঁটিসহ অনেক রাঘববোয়াল ধরা পড়ল। চারিদিকে হইচই, প্রতিবাদ মিছিল। মাদক সিন্ডিকেটের সবার ফাঁসি দাবি। জাতি স্তম্ভিত আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশ ও জাতি রক্ষা পেয়েছে।
চেনা শহরে কে এই অচেনা মানুষ?
আমাদের রক্ষা করতে আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছেন।তিনি আমাদের রক্ষাকর্তা। আল্লাহর দূত।
শহরে রহস্যময় আগন্তুক।
শত্রু রাষ্ট্রের গুপ্তচর নয়তো? যে তথ্য রাষ্ট্র জানে না, ভিনদেশি অচেনা মানুষটি জানে কী করে?
লোকটি দেখতে নীল। ভিনগ্রহের মানুষ হতে পারে।
লোকটি দেখতে স্বচ্ছ। চোখ কাচের মতো। কারও চোখে তাকালে তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব দেখতে পায়।
তিনি দুষ্টের দমন শিষ্টের বন্ধু।
ঘুষখোর, চোরাকারবারি, লুণ্ঠনকারী, গরিবের রক্তচোষা ধনী এবার সাবধান তোমাদের মৃত্যুদূত এসেছে। এ কালের দস্যু মোহন রবিনহুড চলে এসেছেন, বাঁচতে চাও তো ভালো হয়ে যাও।
পত্রপত্রিকা, টিভি, বিভিন্ন মিডিয়ায় শত শত লোক দাবি করল, অচেনা লোকটির সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে। অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে।
লোকটি ফর্সা সুদর্শন গরিবের বন্ধু।
একজন জানাল তার দুটি পাখা আছে। আকাশ থেকে তাকে নামতে দেখেছে। মাটিতে পা দেওয়া মাত্র পাখা দুটি লুকিয়ে পড়ে। মুহূর্তে সে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। আমি ভয়ে গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখেছি।
কারও সঙ্গে কারোর বর্ণনা মেলে না। মিডিয়ায় মুখ দেখানোর জন্য যে যেমন পারছে নানা গালগল্প চালিয়ে যাচ্ছে। যে মিডিয়ায় যত বেশি গালগল্প সে মিডিয়া পাবলিক তত বেশি খাচ্ছে।
স্কুল-কলেজ, রাজনীতিতে, ট্রেনে-বাসে, হাটে-বাজারে, নানা রূপকথার গল্প, আল্লাহর মাহাত্ম্য, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ধনীদের সম্পদ দখলে কমিউনিস্ট মতলববাজি- এমনই নানা বিশ্নেষণ ছাড়া শহরে জেলায় দেশে আর কোনো আলোচনা নেই।
সরকারও বসে নেই। রাষ্ট্রের সব গোয়েন্দা এজেন্সি পথে-ঘাটে নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নেমে পড়েছে। সরকার চিন্তিত, অচেনা লোকটি আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে দেশে বিভেদ সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মারাত্মক আকার ধারণ করার আগে রোধ করতে হবে। দেশের শিল্পপতি, ধনী সম্প্রদায় ভীত। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণি, ছাত্রসমাজ উল্লসিত। বিরোধী দলও বসে নেই। এ অবস্থায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলে তাদের পক্ষে কী কী সুবিধা নেওয়া যায় তার ছক কাটতে পার্টি সভা ডেকেছে। অতি উৎসাহীরা স্বপ্ন দেখছে এই বিশৃঙ্খল সময়কে আরও অস্থিতিশীল করে এবং রহস্যময় আগন্তুককে কবজা করে সরকার উল্টে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা।
অচেনা লোকটিকে পাওয়া গেলে সব রহস্য, দুশ্চিন্তার অবসান হতো। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তায় সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মাদক নেটওয়ার্কে তাদের দলের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে। এরপর আরও কোনো কেলেঙ্কারিতে যদি দলীয় লোক জড়িয়ে থাকে, মাথা ব্যথার কারণ হবে। নির্বাচনের বেশিদিন বাকি নেই। এ সময়ে দলীয় ভাবমূর্তি ক্লিন রাখতে না পারলে তরি ডুবে যেতে পারে। হাই কমান্ড থেকে সর্বোচ্চ জরুরি নির্দেশ, লোকটিকে গোপনে ধরা চাই। অচেনা লোকটির সঙ্গে সম্মানিত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে। নানা দিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে অচেনা মানুষকে নির্বাচনী জয়ের অনুকূলে ব্যবহার করা সম্ভব কিনা।
মন্ত্রীর পিএ বলল-
স্যার, সাধুবাবাকে নিয়ে এসেছি। বাবা ত্রিকালদর্শী। আপনার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব বলে দেবে। অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে।
মন্ত্রী বললেন-আমার অতীত, বর্তমান আমি জানি। আমার আগ্রহ ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমি এখন আর পার্টির সুনজরে নেই। শত্রুপক্ষ নানা অভিযোগ জমা দিয়েছে। কানকথায় নেতার কানভারী করেছে। আমি শঙ্কিত। আসছে নির্বাচনে আমি দলের নমিনেশন পাব কিনা জানতে চাই।
সাধুকে দেখে মন্ত্রী মহোদয় অবাক হলেন। সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকিরের যে সনাতনী চিত্র আমরা দেখি, এ সাধু তেমন নয়। বরং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শীর্ষ এক্সিকিউটিভ মনে হয়। অতি সুদর্শন স্যুট-টাই পরা একজন মার্জিত পুরুষ তার সামনে বসা। লোকটিকে দেখামাত্র মনের মধ্যে সম্ভ্রম ভাব জেগে ওঠে।
মন্ত্রী বললেন-
আমি শুনেছি আপনি নিখুঁত গণনা করতে পারেন। আগামী নির্বাচনে আমি কি দল থেকে নমিনেশন পাব?
লোকটি মৃদু হেসে বলল-আপনি এই সাতসকালে হুইস্কি পান করেছেন। রেড লেবেল। প্রতিদিন দুই পেগ খান, আজ চার পেগ খেয়েছেন।
আমার পিএ পরিবেশন করেছে। সে আপনাকে বলেছে। আমাকে ইমপ্রেসড না করে আমি নমিনেশন পাব কিনা সেটা বলুন।
পাবেন না।
কেন? মন্ত্রী রেগে গেলেন।
আপনার অতীত কার্যক্রম পরিচ্ছন্ন নয়। নারী ও টাকা কেলেঙ্কারির দুর্নাম আছে। পার্টির অনুগত পরীক্ষিত নেতা হিসেবে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। এবার অনুগত কার্ড কোনো কাজে লাগবে না। আপনি নমিনেশন পাবেন না। পার্টির সংস্কার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ইতিবাচক করতে আপনার দুর্নীতির বিচারও হতে পারে।
টাকা দিয়ে পাওয়া যায় না, পৃথিবীতে এমন কিছু আছে? যত টাকা লাগে আমি নমিনেশন কিনে নেব।
নমিনেশন পাওয়ার যোগ্যতায় পার্টি এবার দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেবে। সততা ও দক্ষতা। দুটির কোনটি আপনার নেই। সুইস ব্যাংকে বারো হাজার কোটি ডলার অবৈধ পাচার করেছেন। তার কিছু হিসাব পার্টির কাছে আছে। আমার কাছে পাবেন পুরো হিসাব। এই নিন সুইস ব্যাংকের আপনার হালনাগাদ অ্যাকাউন্ট সিট।
মন্ত্রী ভয়ে বিস্ময়ে অচেনা লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। কত কঠিন সময় তিনি পার করেছেন। সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। আজ তার কী হলো, মন কাঁপছে, আতঙ্কে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
আপনি কে?
আমি কেউ না। সবার মাঝে আছি, আবার কারও মাঝে নেই। গুরুত্বহীন। কেউ কেয়ার করে না, আমাকে নিয়ে ভাবে না। যে আমাকে নিয়ে ভাবে তার মাঝে ন্যায়-অন্যায় দ্বন্দ¦ তীব্র হয়ে ওঠে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ হয়। সে সুখী জীবনযাপন করে। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি আপনার বন্ধু।
মন্ত্রী স্বস্তিবোধ করেন, আপনি বাঁচালেন ভাই, থ্যাঙ্কস। এই রিপোর্ট যদি প্রকাশ পায় মানসম্মানের ভরাডুবি। রাজনীতি জীবন ইতি। দুর্নীতির জেলহাজত শুরু। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। পথের ফকির। এসব থেকে বাঁচতে সহজ পথ আত্মহত্যা।
এত ঝুঁকিপূর্ণ পথে চলেন কেন?
সংসার রে ভাই, ছেলেমেয়ে-স্ত্রী। তাদের চাহিদা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে হয়। দেশের অবস্থা কখন কী হয়, দেশ ছেড়ে পালাতে হবে কি হবে না, তা তো জানি না।
দেশের নেতা দেশে থাকবেন। এমন কাজ কেন করেন যে দেশ ছেড়ে পালানোর চিন্তা করতে হয়? ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছেন। ছেলে পড়াশোনা না করে ক্যাসিনো-মদ-নারী নিয়ে পড়ে থাকে। মেয়ে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে লিভ টুগেদার করে। কিছুদিন পরপর গাড়ির মডেলের সঙ্গে লাইফ পার্টনারও চেঞ্জ করে। স্ত্রীর মনোযোগ ক্লাব-পার্টি, বিদেশে শপিং। আপনার টাকার প্রতি তার আকর্ষণ যত তার এক ভাগ আকর্ষণ কি আপনার প্রতি আছে? আপনি না একজন আদর্শ স্কুলশিক্ষকের সন্তান?
মন্ত্রী আত্মগ্লানিতে ঘৃণায় বিব্রত হয়ে বলল-
আপনার কাছে কী লুকাব, আপনি সব জানেন। অর্থহীন আমার জীবন। মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।
আপনার জীবনকে আমি পরিপূর্ণ আনন্দময় করে তুলতে পারি। সম্মান নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবেন। দেশ ছেড়ে পালানোর দুশ্চিন্তা আপনাকে কখনও তাড়া করে ফিরবে না।
ভয়ের জীবন, মুখোশ পরা জীবন আমি আর চাই না। সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই।
মুখোশ খুলে ফেলুন। মানুষকে ভালোবাসুন। সুইস ব্যাংকের টাকায় স্কুল কলেজ হাসপাতাল করুন। নারীশিক্ষা উন্নয়ন, বেকারত্ব দূর করতে এলাকায় কলকারখানা গড়ে তুলুন। ছেলেমেয়ে-স্ত্রীর টাকার পাইপলাইন বন্ধ হয়ে গেলে ছেলেমেয়ে রাজকীয় ভোগের জীবন ছেড়ে রোজগারে নামবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি নেতা থেকে জননেতায় পরিণত হবেন। ভাড়া করে লোক জড়ো করতে হবে না। আপনার এক ডাকে হাজার লোক জড়ো হবে।
মন্ত্রীর চোখে পানি, আমাকে আর স্বপ্ন দেখাবেন না।
আমার পরিকল্পনা যদি মেনে নিতে পারেন আপনি এবারও দলের নমিনেশন পাবেন। গতবারের চেয়ে বেশি ভোটে পাস করবেন। মন্ত্রী হবেন। রাজনীতি করবেন মানুষের জন্য। নিজের জন্য নয়।
এবার থেকে তাই হবে।
এত বছর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আনন্দে আবেগে মন্ত্রী শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। পিএ সভয়ে ছুটে এলো-
স্যার, কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন? লোকটি কোথায়?
মন্ত্রী বললেন-আমাকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছেন।
সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তদন্ত এজেন্সি, পেপার ও ডিজিটাল মিডিয়ার সাংবাদিক, কৌতূহলী জনতা ব্যাপক অনুসন্ধান করেও চেনা শহরে অচেনা লোকটিকে খুঁজে পায়নি। ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এলো অচেনা লোকটির গল্প। মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের আড্ডায়, ঢাকা শহরের চায়ের দোকানে, সাধারণ মানুষের গল্পে অচেনা রহস্যময় লোকটির গল্প উঠে আসে। তখনও তর্ক জমে ওঠে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে লোকটি সত্যি সত্যি এসেছিল। কেউ বলে হুজুগে বাঙালির ¯্রফে গাঁজাখুরি গল্প। মন্ত্রী, দোকানদার, সেই থানার দুজন সিপাই ও মৃত ওসির ছেলেমেয়ে জানে তাদের চেনা শহরে অচেনা মানুষটি সত্যি এসেছিল। এখন সে হয়তো অন্য কোনো শহরে অন্য কোনো খানে আছে। সময় হলে সে আবার তাদের শহরে আসবে।