চোরের মায়ের বড় গলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৪:২১:১৯ অপরাহ্ন

আরিফুর রহমান সেলিম
সে দিন আমার বাড়ির পাশে পুকুর ঘাটে এক জোড়া মুরগি ঝগড়া করছে। মোরগ মুরগিকে বলছে জানিস এই পৃথিবীতে কার গলা সবচেয়ে বড়? মাথা খাটিয়ে বলতো। মুরগিটা হেসে হেসে বলছে সেটা কি আর বলতে হয়। আমার গলাই সবচেয়ে বড়। কেন মোরগ তুমি কি খেয়াল করনি যখন আমি ডিম পাড়ি কেমন কুক্কুরো কোক কুক্কুরো কোক করে ডেকে উঠি। আমার ডাকে আকাশ কাপে, ঘুমের বাচ্চা হুরমুর করে জেগে উঠে। আর বাড়ির বউয়েরা বলে দেখোনা একটা ডিম পেড়েই কি পাওয়ার দেখায়। মনে হয় স্বর্গ জয় করে ফেলেছে। তাহলে বুঝো একবার আমার গলার কত শক্তি।
মোরগ তখন বলে হায় হায় হায় তুমি আমার কথা না বলে নিজের কথাই বলে ফেললে। একবারও ভাবলে না আমার ডাক না শুনলে মানুষের তো ঘুমই ভাঙ্গে না। এমন কি তোমারও ঘুম ভাঙ্গে না। সেই তুমি বললে আমার চেয়েও তোমার গলার শক্তি বেশি। একটা পুরুষকেও তুমি সম্মান দিলে না। মুরগি বলে ধূর রাখো তোমার সম্মান আপনি বাঁচলে বাপের নাম। মোরগ তখন অভিমান করে বললো এত স্বার্থপর হওয়া কিন্তু ভাল নয়। খেয়াল করে দেখো আমি তোমার কত উপকার করি। মুরগি তখন হেসে হেসে বলে ওগো রাগ করছো কেন। আমার সম্মান মানেই তো তোমার সম্মান। মোরগ তখন বললো এ কথা মোটেও সত্যি নয়। সে রাগ করে জঙ্গলে চলে গেলো।
জঙ্গলে একা একা হাঁটছে মন খারাপ করে। সেখানে হঠাৎ দেখা একটা রাজহাঁসের সাথে। মোরগ জিজ্ঞাসা করলো কি ব্যাপার রাজহাঁস তুমি এখানে কেন? রাজহাঁস বললো, আর বলবেন না ভাই।এই যে দেখুন আমার বাচ্চাগুলো ভীষণ দুষ্টু।সারাক্ষণ একটা আরেকটার সাথে ঝগড়া করে। আমি চাই ওদের স্কুলে পাঠাতে যেন সভ্য, নম্র, ভদ্র হয় আর এরা কিনা চলে আসে জঙ্গলে, পুকুরে। বলেন তো কেমন মেজাজ হয়। কিন্তু এত্ত ছোট্ট তুলতুলে বাচ্চা তো তাই কড়া শাসন করতে পারি না। তা মোরগ ভাইয়া আপনার মন খারাপ কেন?
আর বলবেন না। আপনার ভাবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আচ্ছা বলতো কার গলায় জোর বেশি। সে বললো, তার গলায় নাকি জোর বেশি। সেটা প্রমাণের জন্য কুযুক্তি কতগুলো দেখালো। আচ্ছা আপনাকে বলি আপনি বলেন তো আপনার গলায় বেশি শক্তি নাকি আমার? রাজহাঁস এবার একটু ভাব নিলো। নিজের শরীরে দিকে একবার তাকালো। চারপাশের পরিবেশটাও দেখে নিলো। তারপর স্নিগ্ধ গলায় বললো, মোরগ ভাই আমার শরীরের দিকে একবার তাকান। দেখুন কি ধবধবে সাদা ত্বক, মোলায়েম পশম, চোখে কি সুন্দর কারুকাজ। আর আমার গলা সে তো স্পেশাল। যখন আমি প্যাক প্যাক করে শব্দ করে ডাকি চারপাশ কেমন নিরব হয়ে যায়। যেন সারা পৃথিবী আমার ডাক শোনার জন্য মগ্ন হয়ে থাকে। তাহলে নি:সন্দেহ বলতে পারেন আমার গলার শক্তিই বেশি।
রাজহাঁসের কথা শুনে মোরগের আরো মন খারাপ হলো। আস্তে করে সে বললো, রাজহাঁস তুমি একটা বাচাল। বড্ড বেশি কথা বলো। তোমার গলার শক্তি কতটুকু অন্য কোন পাখিকে জিজ্ঞাসা করো। সেই বলবে তোমার শক্তির কথা। আমি তাহলে এবার আসি বলেই কেটে পড়লো মোরগটা। রাজহাঁস তার বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে চললো।
নদীর ঘাটে গিয়েই বকের সাথে দেখা। রাজহাঁস তখন বককে বললো সে কি আপা তুমি কোথায় থাকো। কত দিন ধরে তোমায় দেখিনা। বক বললো, আর বলিস না। নানীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। নানী তো আমাকে দেখে পাগলপ্রায়। আমাকে কোথায় রাখবে, কি খাওয়াবে তা নিয়ে তাঁর রাজ্যের চিন্তা। সবচেয়ে আরামদায়ক স্থানে আমাকে থাকার জায়গা করে দিলো। যত রকমের মজার মজার খাবার আছে সবই খাওয়ালো। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানো আমি যে এতবড় হয়েছি তবু আমার মামারা আমাকে কোলে নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরতে গেলো। সবাইকে দেখিয়ে বললো, এই দেখো আমাদের একমাত্র ভাগনি। কি সুন্দর। মামাদের আর নানুর চুমু খেয়ে আমার গালটা কেমন তুলতুলে হয়ে গেছে। রাজহাঁস একটু ছোঁয়ে দেখো কেমন তুলতুলে।
রাজহাঁস অবাক হয়ে বকের দিকে তাকিয়ে রইলো। সত্যিই তো নানীর বাড়ির আদর পেয়ে বকটা কেমন নাদুস নুদুস হয়ে গেছে। রাজহাঁসের হঠাৎ মনে হলো মোরগের কথা। যে তাকে বাচাল বলেছে। রাজহাঁস এবার বককে বললো, আচ্ছা বক বলতো তোমার গলার শক্তি বেশি নাকি আমার।
বক তখন বললো, শোন এই কিছুদিন আগে হলেও বলতাম তোমার গলার শক্তি বেশি। কিন্তু এখন তো সেটা বলতে পারছি না। নানীর বাড়ির আদর যত্ন আর আমার তেল তেলে শরীর দেখে বুঝে নাও আমার গলায় কত শক্তি। এ কথা শুনে রাজহাঁস আর কথা বাড়ালো না। শুধু বললো, আমি পাখি দেখে এ কথা বলতে পারলে। সাহস থাকলে কোন পশুকে জিজ্ঞাসা করে দেখো কার গলায় জোর বেশি।বলেই রাজহাঁস সাঁতার কাটতে লাগলো বাচ্চাদের নিয়ে।
বক উড়ে উড়ে যাচ্ছে। হাট পেরিয়ে, ঘাট পেরিয়ে একটা সবুজ মাঠে গিয়ে দেখলো একটা চমৎকার গরু ঘাস খাচ্ছে। সাদা কালো মিশ্রিত রংয়ের গরুটি দেখতেও খুব সুন্দর। বক মনে মনে ভাবলো গরু তো বোকা শোকা গরুকেই কথাটি বলে দেখি। বক আস্তে করে গিয়ে গরুর পিঠে বসলো। শিং দুটোকে একটু ছোঁয়ে দিলো। একটু ভাব জমানোর পর বললো, আচ্ছা গরু তোমাকে একটা কথা বলি।গরু বললো বলতে পারো। তখন বক বললো, আচ্ছা তোমার গলায় শক্তি বেশী নাকি আমার। গরু তখন খিল খিল করে হাসতে লাগলো আর বললো আরে বোকা বক তুই কি দেখেছিস আমি কত কচি কচি ঘাস খাই আর সে ঘাসে আছে কত শক্তি। আমি যখন হাম্বা বলে ডাক দিবো ভয়ে তো তোর কলিজাই ফেটে যাবে। দেবো নাকি বলে একবার হাম্বা। বক তখন খুব ভয় পেলো আর বললো, আমাকে ছোট্ট পেয়ে এমন ভয় দেখালে সাহস থাকে তো তোমার চেয়ে দেখতে বড় প্রাণী জিরাফকে বলে দেখো তোমার গলায় জোর বেশি নাকি জিরাফের। বলেই কাঁদতে কাঁদতে বক উড়ে গেলো। আর কাঁদবেই না কেন বলো ভয় পেলে মানুষের বাচ্চারাও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয় আর সেতো একটা ছোট্ট বক।
গরুর মাথায় ঘুরছে কিভাবে জিরাফকে এ কথাটি বলা যায়। অনেক দিন পর হঠাৎ জিরাফের সাথে গরুর দেখা। গরু জিরাফকে দেখে বললো, আরে লম্বু ভাইয়া কেমন আছো তুমি? জিরাফ তখন গরুকে বললো, লম্বু বলে আমাকে খোঁচা দিবি না কিন্তু। বল তোর কি খবর। তখন গরু বললো, আচ্ছা একটি সত্যি কথা বলবে? বল কি বলবি আমি তো সব সময় সত্যি কথাই বলি। গরু বললো, আচ্ছা বলো তোমার গলায় জোর বেশি নাকি আমার। জিরাফ বললো, আমার গলা দেখে তুই বুঝিস না!এই পৃথিবীতে আমার গলাই সবচেয়ে বড়।গরু রেগে বললো, আমার গলায় সবচেয়ে বেশি জোর। তখনই সেখান দিয়ে যাচ্ছিল এক শেয়াল। তাদের ঝগড়া দেখে সে থামলো। গরু ও জিরাফ দুজনেই বললো, আচ্ছা শেয়াল তোমাকে তো বলা হয় তুমি সবচেয়ে পন্ডিত। তুমিই বলো কার গলায় সবচেয়ে বেশি জোর। গরু নাকি জিরাফের।
শেয়াল একটা হাসি দিলো। তারপর বললো, শোনো এই পৃথিবীতে গরু কিংবা জিরাফ কারো গলার জোরই বেশী নয় কিংবা বড় গলা নয়।এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গলা হলো চোরের মায়ের । হ্যাঁ চোরের মায়েরই সবচেয়ে বড় গলা। সেই গলায়ই সবচেয়ে বেশী জোর।
একজন চোরের মা মিথ্যাকথা, কটু কথা, নিচুকথা সব কিছু নির্লজ্জের মতো বলতে পারে। তাই বলা যায় চোরের মার বড় গলা। তখন জিরাফ ও গরু চুপ করে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইলো।