ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ আগস্ট ২০২২, ৬:৩৮:৪১ অপরাহ্ন

রফিকুর রহমান লজু
ছাত্র এবং শিক্ষক। দুটি পৃথক শব্দ। দুটি শব্দ একত্র করলে হয় ছাত্র-শিক্ষক। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক। এরকম মধুর সম্পর্ক আর কারো মধ্যে হয় না। মাতা-বা পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক জন্মগত। যেখানে স্নেহের আতিশর্যই প্রধান। পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ঘরে-বাইরে পরিব্যাপ্ত। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক স্কুলে-কলেজের মধ্যে বা ক্লাস রুমে সীমাবদ্ধ ছিল, সুসম্পর্কের বন্ধন ছিল।
এক সময় ছাত্রদের পড়ালেখা শেষ হয়ে যায়। শিক্ষকগণ শিক্ষকতায়ই থাকেন। ছাত্ররা সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করে। তারাও পিতা হয়। দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে। তখন তারা দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধের চেতনা দ্বারা পরিচালিত হয়। এই মূল্যবোধ সমাজকে, জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজ হয় শান্তির আবাস। এক সময় এই মূল্যবোধের উচ্চমূল্য ছিল সমাজে। সবাই নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতো। ক্লাস রুমে বা স্কুল-কলেজের বাইরেও তাদের মধ্যে মান্যতার ও পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ ছিল।
শিক্ষকগণ ছাত্রদের ক্লাসরুমে শুধু পাঠদান করেন না, তাদের শিষ্ঠাচার শিখান, প্রয়োজনে শাসনও করেন। পিতা-মাতা সন্তানদের শিশুকাল থেকে লালন করেন, সঙ্গ দেন, ভরণ-পোষণ করেন, বেড়ে ওঠতে সহায়তা করেন। শিশু সন্তান বয়োপ্রাপ্ত হলে পিতামাতার আর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তারা নিজেদের মতো করে চলতে চায়। পাড়ার পরিবেশের প্রভাব পড়ে তাদের ওপর। তা সত্ত্বেও পারস্পরিক সম্মানবোধ শান্তি-সহনশীলতার লালন করতো। এসব মহৎ অনুভবের সবচেয়ে বড় জায়গা ছিল ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মধ্যে।
শিক্ষাঙ্গন এখন আর আগের শিক্ষাঙ্গন নেই। নোংরা, বেয়াড়া ও ঘৃণিত পরিবেশ প্রবেশ করেছে শিক্ষাঙ্গণে। যৌক্তিক কারণেও শিক্ষকগণ ছাত্রদের শাসন করতে পারেন না, বেত্রদণ্ড হাতে নিতে পারেন না। এসব এখন নিষিদ্ধ। ছাত্ররা দুষ্ঠুমি করে শাস্তির ভয় করে না, শিক্ষককে গুরু মনে করে না, উল্টা গুরু ছাত্রকে ভয় পান। শাসন এবং শাস্তি থেকে স্বাধীন হয়ে ছাত্ররা শুধু বেআদব নয়, উগ্র হয়ে ওঠেছে, বেয়াড়া হয়ে ওঠেছে। তারা শিক্ষকদের ওস্তাদদের নানাভাবে নাজেহাল ও অপদস্থ করে ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা শিক্ষকদের প্রাণ নাশেরও কারণ হচ্ছে।
একটি ঘটনা বিগত ২৫ জুনের (২০২২)। ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় ঘটেছে একটি নৃসংশ হত্যাকাণ্ড। হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আশরাফুল আহসান জিতু ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে কলেজ শাখার শিক্ষক উৎপল কুমারের মাথায় আঘাত হানে। তিনি মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারান। সাথে সাথে তাকে হাসপতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাতে তার জ্ঞান ফিরে আসেনি। পরদিন শিক্ষক উৎপল কুমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এমন একটি জঘন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে ওই বেয়াড়া ছাত্র জিতু।
শিশুরা, ছাত্ররা স্কুলে-কলেজে সুরক্ষিত। শিক্ষকরাই তাদের নিরাপদ রাখেন, সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। শিক্ষকরা সুরক্ষিত না থাকলে শিশুরা-ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন শিক্ষকের অসুবিধা হলে কোনো অঘটন ঘটলে স্কুল বা কলেজের সমূহ ক্ষতি হয়। কিন্তু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। প্রিয় শিক্ষককে হারিয়ে ছাত্ররা শোকাবিভূত হয়, বিষণ্ন হয়। পড়ালেখায় মন বসে না। এতে আরো হিংসার জন্ম হতে পারে। কোনো ছাত্র তার প্রিয় শিক্ষকের হত্যার প্রতিশোধ নিতে উদ্যোগী হতে পারে। মূল্যবোধ এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মূল্যবোধ ভালো বা উত্তম সবকিছুতে অবদান রাখে। মূল্যবোধ মন্দ বা খারাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
নানা কারণে সমাজে মূল্যবোধের চেতনায় ধস নেমেছে। সমাজে অহরহ নানা অঘটন ঘটছে, অকল্যাণ ঘটছে।
এদিকে আরেকটি দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষক মশিউর রহমানকে সন্ত্রাসীরা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেছে। শিক্ষক মশিউর রহমান একটি দুতলা বাসার ফ্ল্যাটে থাকেন এবং ছাত্র পড়ান। বাড়ির মালিকের ছোট ভাই অপু তাকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়। তিনি ভয়ে বাড়ির বাইরে চলে যান। রাতে বাড়ি ফিরলে অপু তাকে চার তলায় ডেকে নিয়ে হাতুড়ি ও বাঁশ দিয়ে পেটায়। তাঁর মাথা ফেটে রক্ত বের হয় এবং তিনি ফ্লোরে পড়ে থাকেন। তাঁর মাথায় ৭টি সেলাই লেগেছে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি ঘটনা ঘটেছে খুলনার কয়রায় মাদ্রাসার ‘পরিচালন পর্ষদ’ গঠনকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমানকে পেটানো হয়েছে। কয়রায় সদর ইউপি চেয়ারম্যান বাহারুল ইসলামের নির্দেশে তার লোকজন বিগত ৮ জুলাই দুপুরে মাদ্রাসায় ঢুকে অধ্যক্ষকে বেদম প্রহার করে। এরপর তাঁকে চেয়ারম্যানের কক্ষে নিয়ে আবার পেটানো হয়। এতে তিনি চোখে, ঘাড়ে, কানে গুরুতর জখম হন।
চেয়ারম্যান বাহারুল ইসলাম পুনরায় ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য এভাবে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেছে।
কিছু কিছু লোক সমাজে নানা অপকর্ম করে ভয়-ভীতি-ত্রাস সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এরা সমাজে, এলাকায় অশান্তির সৃষ্টি করে, বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। আসলে এরা মুখোশ পরা সমাজবিরোধী লোক। এদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের আওতায় আনা দরকার। প্রশাসনের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমূহ এদের সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখলে জনগণ উপকৃত হবে, সমাজ সুস্থ থাকবে। শান্তির বাতাস বইবে সর্বত্র।
লেখক : সিনিয়র কলামিস্ট।