জনসেবায় এগিয়ে আসুন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ৪:১২:৫০ অপরাহ্ন

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
কবির ভাষায় ‘সেজদা ও তাসবিহ দেখে খোদ এলাহি ভুলবে না / মানব সেবার কাঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দ্বার খুলবে না।’ মানব জীবনের ধন-সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু ধন-সম্পদের প্রকৃত গুরুত্ব নির্ভর করে মানব কল্যাণে ও সামাজিক অগ্রগতিতে তা কাজে লাগানোর ওপর। ধন-সম্পদ যদি অপরিমিত পরিভোগ ও বিপুল বিলাসিতায় ব্যয়িত হয় তবে অর্থ তার মৌলিক উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য হারায়। অপচয় না করে মানবকল্যাণে ও সামাজিক অগ্রগতিতে ব্যয় করতে পারলেই ধন-সম্পদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়। ধন-সম্পদের প্রকৃত তাৎপর্য তার সদ্ব্যবহারের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। আর সম্পদের সদ্ব্যবহারের সর্বোত্তম পন্থা হল তার জনসেবায় ব্যয় করা। সমাজের দুঃখী, পীড়িত, অনাথ, অসহায়, প্রতিবন্ধী, আতুর ইত্যাদির অভাব নেই। এসবের প্রতি লক্ষ্য রাখা জনসেবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিঃস্বার্থভাবে এসব অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসাই প্রকৃত জনসেবা। কবির ভাষায়, ‘আপনাকে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে / সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’
জনসভার মর্ম আমরা অনেকে বুঝি না বা বুঝার চেষ্টা করি না। যদি আমরা জনসেবার মর্ম বুঝতাম তাহলে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েও জনসেবায় মত্ত থাকতাম। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অনন্য উপায় হচ্ছে জনসেবা। জনসেবা মানেই আল্লাহর সেবা। জনসেবা করলে আল্লাহকে পাওয়া যায়। এজন্য ইসলামে জনসেবার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে ‘যারা ধন-সম্পদ রাতে ও দিবসে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের পুণ্যফল তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৭৪)। সমাজে অনেক অভাবগ্রস্ত রয়েছেন। অভাবের কারণে যাদের অন্তর হু-হু করে কাঁদছে। তাদের অভাবের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারছে না আবার সইতেও পারছে না। তাদের সেবায় ধন সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘ইহা প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের : যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে দেশময় ঘুরাফিরা করতে পারে না : যাচনা না করার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত বলে মনে করে : তুমি তাদেরকে লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট নাছোড় হয়ে যাচনা করে না। যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৭৩)। ধনীদের ধন-সম্পদে অসহায়-বঞ্চিতদের হক রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক’ (সূরা জারিয়াত : আয়াত-১৯)। জনসেবার জন্য দান-খয়রাত করতে অগণিত হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। হযরত আবু মুসা আশআরী (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসুল (সা:) এরশাদ করেন, ‘ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর, রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখাশোনা কর এবং বন্দিকে মুক্ত কর’ (বুখারী)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা দয়াময়ের ইবাদত করবে, অন্ন দান করবে এবং সালামের প্রচলন করবে এর কারণে তোমরা স্বচ্ছন্দে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (তিরমিজী ও ইবনে মাজাহ)।
মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী। মানুষের ধন-সম্পদও ক্ষণস্থায়ী। এই ধন-সম্পদ জনসেবায় ব্যয় না করার জন্যও মানুষ এক সময় খুব আফসোস করবে কিন্তু সেই আফসোস কোনো কাজে আসবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে : অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছুকালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সদকা দিতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। কিন্তু নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হবে, আল্লাহ কখনও কাউকে অবকাশ দিবেন না। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত’ (সূরা মুনাফিকুন : আয়াত ১০-১১)। এর জন্য জীনবকালে জনসেবা করার এবং জীবনকালে দান করার জন্য হাদীসে অত্যন্ত উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসুলেপাক (সা:) ইরশাদ করেন, ‘কারও জীবনকালে এক দিরহাম দান করা তার মৃত্যুকালে একশত দিনার দান করা অপেক্ষা অধিক উত্তম’। (আবু দাউদ)
জনসেবার প্রকৃত মূল্য শুধু অর্থ, সম্পদ দানের মধ্যে সীমিত নয়; বরং এর ক্ষেত্র আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। যেমন একটি কিশোর ছেলে সে ভিক্ষা করে খায়। তাকে ভিক্ষা না দিয়ে যদি কোন কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া যায় তাহলে এটাই হবে প্রকৃত জনসেবার পদ্ধতি। কাউকে খাদ্য দিয়ে সাময়িক সাহায্য করার চেয়ে তাকে উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করে দেয়ার মাধ্যমে স্থায়ী খাদ্যের ব্যবস্থা করে দেয়াটাই উত্তম। আর এটাই প্রকৃত জনসেবা। যারা সমাজের নিম্নস্তরে বসবাস করে, তারা সাধারণত মানবেতর জীবনযাপন করে। তারা রোগে চিকিৎসা পায় না, শীতে বস্ত্র পায় না, শিক্ষার সুযোগ তাদের নেই। তারা দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, মহামারী, প্লাবন, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতির সময় দলে দলে লোক বিনা চিকিৎসায়, না খেয়ে মারা যায়। এমন দুঃসময়ে নিঃস্বার্থভাবে এদের পাশে দাঁড়িয়ে এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করাই হচ্ছে প্রকৃত জনসেবা। সমাজের জনসেবকরা নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবায় করলে সামাজিক কোন সমস্যা, সমাজে কোন অসহায়-পীড়িত লোক থাকতে পারে না। সমাজ সেবকদের কণ্ঠে এটাই উচ্চারিত হোক-‘সবার সুখে হাসব আমি কাঁদব সবার দুখে / নিজের খাবার বিলিয়ে দেব অনহারির মুখে।’
যারা জনসেবায় ধন-সম্পদ ব্যয় করেন তাদের মহিমা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তাদের মহিমা বর্ণনা করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘যারা নিজেদের ধনৈশ্বর্য আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্য বীজ, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যকণা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৬১)। আল্লাহর সন্তুষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ জনসেবায় এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।