জালালি কৈতর হত্যা মামলা হাইকোর্টে গড়িয়েছিল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জানুয়ারি ২০২১, ৩:৫৭:১৬ অপরাহ্ন

সেলিম আউয়াল::
ঝাঁকে ঝাঁকে কৈতর উড়ে দেখতে কি সুন্দর
জালালের জালালি কৈতর…
হযরত শাহজালালের (রহ.) স্মৃতি জড়ানো ‘জালালি কৈতর’ (কবুতর) হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলা সিলেট থেকে হাইকোর্র্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিলো। শেষ মেষ কবুতর হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবলের পাঁচ টাকা জরিমানা হয়। আইনজীবী ও সমাজসেবী শ্রীনগেন্দ্রনাথ দত্ত বিএল তার আত্মস্মৃতিতে ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেনÑ‘১৮৭২ ইংরাজীতে একজন ইংরাজ যুবক, যিনি সহরের সহকারী পুলিশ সাহেব ছিলেন, গুলি করিয়া সরকুম অর্থাৎ প্রধান সেবাইতের ভাঙ্গা দালানস্থিত একটী পায়রার প্রাণনাশ করেন। পরে তাহার বাড়ীর একদিকে ঢুকিয়া ঐ মৃত পায়রাটি হস্তগত করেন। এই ঘটনায় দরগাস্থিত মুসলমানগণের প্রাণে বড় আঘাত লাগে ও সরকুম সাহেব পুলিশ সাহেবের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আদালতে মোকদ্দমা রুজু করেন। কিন্তু স্থানীয় হাকিমের বিচারে মোকদ্দমা ডিসমিস হয় ও মিথ্যা মোকদ্দমা আনার জন্য সরকুম সাহেব অভিযুক্ত হন। মোকদ্দমা পরে হাইকোর্ট পর্য্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্ট আইনঘটিত দোষে ছানি বিচার জন্য ঐ মোকদ্দমা জিলা জজের নিকট প্রেরণ করেন। নবাগত জজ মস্প্রেট সাহেবের বিচারে পুলিশ সাহেবের ৫ টাকা জরিমানা হয়। আর সরকুম সাহেব বেকসুর খালাস পান।’
শ্রীনগেন্দ্রনাথ দত্ত আনুমানিক ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সেই সময়ের হবিগঞ্জ মহকুমার উচাইল পরগণার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের আশি^ন মাসে বাংলার ঢাকা বিভাগ থেকে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা দেন। সেই তার প্রথম সিলেট শহরে আসা। পরীক্ষা দিয়ে তিনি শহর ছেড়ে আবার নিজেদের গ্রামে চলে যান। দুমাস গ্রামে কাটিয়ে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে তার পিতার মৃত্যু হলে তিনি কলকাতা ছেড়ে সিলেট চলে আসেন এবং জুন মাসে শ্রীহট্ট জিলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্কুলটি তখন সিলেট শহরের চৌহাট্টায় মুনারায়ের টিলায় (বর্তমান জজের টিলা) অবস্থিত ছিল। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন এবং ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাস পর্যন্ত আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সিলেটের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। নগেন্দ্রনাথ দত্ত ‘শ্রীহট্টবাসী’ নামের পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সেই পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখার ‘অপরাধে’ তিনি ইংরেজ রাজ কর্মচারীর রোষানলে পড়েছিলেন। তিনি ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুনামগঞ্জে এক মাস মুনসেফের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সম্পাদনায় হবিগঞ্জ থেকে মাসিক মৈত্রী প্রকাশিত হয়।
শ্রীনগেন্দ্রনাথ দত্ত বিএল-এর আত্মজীবনী শ্রীভূমির-স্মৃতিকথা-এর একটি জরাজীর্ণ কপি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের পাঠাগারে পেয়েছি। বইটির প্রথম দিকের কয়েকটি পৃষ্ঠা না থাকায় প্রকাশকাল ও প্রকাশস্থল ইত্যাদি সম্পর্কে কোন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। প্রফেসর নন্দলাল শর্মা লিখেছেনÑ‘বিশ শতকের প্রথম দিকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সাহিত্য সংসদে রক্ষিত বইটির প্রথম দিকের দু চারটে পৃষ্ঠার পর পুরো বইটি পড়া যাচ্ছে। পুরো বইটিতে একজন অসাম্প্রদায়িক-উদার শ্রীনগেন্দ্রনাথ দত্তের ছবি ফুটে উঠেছে।
নগেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের সিলেট শহরের বর্ণনা দিয়েছেন। তখন সিলেটে সুউচ্চ ভবন ছিলো না। চৌহাট্টার মনারায়ের টিলাতে দাঁড়িয়ে পুরো শহর দেখা যেতো, শহরটা ছিলো ছবির মতÑ‘স্কুলটা তখন মনুরায় বা মনা রায় টিলার উপর ছিল। স্কুলের থাকা ঘরটা অনেক প্রকোষ্ঠে বিভক্ত ছিল। এই স্থানের প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোহর। ছেলেরা এই ক্ষুদ্র শৈলখন্ডের উপর থেকে সমগ্র সহরটার নয়নাভিরাম সকল দৃশ্য দেখিতে পাইত। বর্ষাকালে যজ্ঞোপবীতের ন্যায় সুরমাকে বহিয়া যাইতে দেখিত। আবার অদূরে সূর্য্যালোক প্রতিফলিত গিরিগাত্রবাহিনী নির্ঝারণীগুলি রজত রেখার ন্যায় কি অপূর্ব্ব শোভা সম্পদ লইয়াই তাহাদের চোখে পড়িত।’ তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, মনারায়ের টিলায় এক অংশে ছিলো জিলা স্কুল এবং অপর অংশে লংলার জমিদার আলী আমজদ খাঁর পাকা বাড়ি। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে সেই পাকাবাড়ি ও স্কুল ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। তখন ভূমিগ্রহণ বিষয়ক আইনের বলে সরকার সেই ভূমিটি নিয়ে নেন। উভয় স্থানে সরকারিভাবে দুটো বাংলো বানানো হয়। বর্তমানে আলী আমজাদের পাকা বাড়ির স্থানে সিলেটের জেলা ও দায়রা জজের বাংলো এবং স্কুলের স্থানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর বাংলো।
সরকার প্রতিষ্ঠিত জিলা স্কুলটিই ছিলো ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের একমাত্র এনট্রান্স স্কুল। তখন বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্ররা পড়াশোনার জন্যে সিলেট শহরে আসতো। সেই সময়টায় ছাত্রদের জন্যে আজকের মতো হোস্টেল ছিলো না। ছাত্রদের আবাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে নগেন্দ্রনাথ দত্ত আলোকপাত করেছেনÑ‘ছেলেদের মনে তখন খুব স্ফুর্তি ছিল। বাসায় বাসায় থাকিয়া তাহারা পড়াশুনা করিত। দূরবর্ত্তী আত্মীয়কেও তৎকালে বাসায় স্থান দিয়া খোরাকী খরচ দেওয়ার প্রথা ছিল। বড় বড় বাসায় অনাত্মীয় ছেলেও স্থান এবং খোরাকী পাইত। তখনকার দিনে বিদ্যাদানে অনাত্মীয়কেও সাহায্য করিয়া মধ্যবিত্ত অবস্থার লোক পূণ্য অর্জ্জন করিতে আগ্রহ প্রকাশ করিত ও সমাজে নির্ম্মল যশের অধিকারী হইত। যাহারা এইরূপ করিত না, সমাজে তাহাদের খুব নিন্দা হইত।’
নগেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮২ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত সময়ের সিলেটের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র তুলে ধরেছেনÑ‘জনকতক খৃষ্টশিষ্য বাদ দিলে হিন্দু মুসলমান লইয়াই সহর এবং সংখ্যায় উভয় ধর্মাবলম্বীগণের মধ্যে সামান্য ইতরবিশেষ হইতে পারে। বহু সংখ্যক দেবায়তন ও মসজিদ অতীতের গৌরবস্মৃতি বুকে লইয়া আজও হিন্দু মুসলমানের ধর্ম্ম ভাবের পরিচয় দিতেছে। সহরে একটা বিশেষ লক্ষ্য করার জিনিষ আছে। আখড়া, দেবালয়, মসজিদ, গোরস্থান সহরের বহুস্থলে কাছাকাছি বা পাশাপাশি দাঁড়াইয়া একটা উদার ধর্ম্মভাব ঘোষণা করিতেছে। কেহ কাহারও ধর্ম্মাচরণের প্রচলিত প্রথায় আজও বাধা দেয় নাই। বাঙ্গালার বা তথা ভারতের অন্যান্য স্থানের ন্যায় মসজিদের সামনে বাদ্যভাণ্ড লইয়া এই সহরে কোন গোলযোগ আজও ঘটে নাই।’
মুরগি খাওয়া নিয়ে একটি বিপত্তির ঘটনা নগেন্দ্রনাথ দত্ত তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেনÑ‘মুরগীর ত কথাই নাই। খাইলে সদ্যই জাতিপাত হইত। তৎকালের অবস্থা বুঝাইবার জন্য একটী ঘটনার সহিত যদিও আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে তাহা উল্লেখ না করিয়া পারিলাম না। আমরা চারিটি বন্ধুর (শশীন্দ্রচন্দ্র সিংহ, সতীশ চন্দ্র সেন, কালীকুমার দেব ও নগেন্দ্রনাথ দত্ত) তৎকালে একটা খেয়াল হইল যে সামাজিক কুসংস্কারে পদাঘাত করিয়া আমাদের একটা মুরগী খাওয়া উচিত। তৎক্ষণাৎ এক বুড়ো মুসলমান খলিফার মারফতে আমরা একটী মুরগী কাটাইয়া বাসায় আনিলাম। মুরগীটা রান্না হইলে আমরা একত্র বসিয়া খাইলাম। একে ত আমরা মুরগী কখনও খাই নাই। কেমন ঘেন্না করিতে লাগিল। তদুপরি তাড়াতাড়ি বশত: তরকারীতে নুনও দেওয়া হয় নাই। আমরা রাত্রে মুরগী খাই। পরের দিনই কথাটা সহরে রাষ্ট্র হইয়া পড়ে। আমরা নিজেরাই এত বড় একটা বীরত্বের কথা গোপন রাখিতে পারি নাই। সহরের ছেলে মহলেও তখন দুইটা দল ছিল। একদল হিন্দু সমাজের বাঁধন একদম ছিড়িয়া ফেলিতে উদ্যত। অপর দল অতটা সাহস প্রকাশ করিতে নারাজ। […] অনেক আলোচনা ও আন্দোলনের পর আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করাই অবধারিত হয় ও আমরা প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সমাজে থাকিয়া যাই। শশীন্দ্রচন্দ্র আমার মাতৃকুলের সন্তান থাকায় আমার অসম্পর্কিত ছিলেন না। এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই তাহার পিতা আসিয়া তাকে বাড়ী লইয়া যান ও অল্প বয়সেই এক ধনী কন্যার সহিত তাহার বিবাহ দেন। আমার আবাল্য বন্ধু কালীকুমার ভাল ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এই গোলযোগে তাহার পড়াটা বন্ধ হইয়া যায়।’
নগেন্দ্রনাথ দত্ত সিলেটের মুসলমানদের ইনার স্ট্রেংথ উদারচিত্তে উল্লেখ করেছেনÑ‘শ্রীভূমির মুসলমান সন্তানগণ যে কেবল সংখ্যায় অধিক তাহা নহে। সাহস, শক্তি, অধ্যবসায় ও শ্রমশীলতা গুণে তাহারা হিন্দু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আবার হিন্দুর মত বংশানুগত জাতিভেদ বা ধর্ম্মাচরণে বিভিন্ন শ্রেণীর বিভিন্ন লজ্জাকর অধিকারের বৈষম্য ইহাদের মধ্যে দৃষ্ট হয় না। এই শ্রীভূমির মুসলমান যুবকেরা ইংরাজের বাণিজ্যপোতে চাকুরী গ্রহণ করিয়া বাহির ও ভিতর দরিয়ায় যে শক্তি ও যোগ্যতার পরিচয় দিতেছে তাহা নিতান্তই প্রশংসনীয়। এই উপলক্ষে ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল সাগর উপসাগর ও বাণিজ্যস্থান এবং ব্যবসাক্ষেত্র ইহাদের পরিচিত। এইরূপ ক্রমাগত যাতায়াতে ইহারা যে অভিজ্ঞতা, শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করিতেছে তাহার মূল্য কম নহে। শ্রীভূমির হিন্দুদের মধ্যে এমন কোন শ্রেণী নাই যে এই ক্ষেত্রে তাহাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতে পারে।’
সিলেট অঞ্চলে ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। নগেন্দ্রনাথ দত্ত সেই সময় জাহাজে চড়ে সিলেট শহরে আসছিলেন। তিনি তখন জাহাজ থেকে বালাগঞ্জ বন্দরে নামেন এবং বালাগঞ্জের দূরাবস্থা দেখেন। সেই রাতটা তিনি বালাগঞ্জ থানার দারোগা অম্বিকাচরণ সেনের বাসায় কাটান। পরেরদিন সকালে নৌকাযোগে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছুটেন। সেইদিনের পরের দিন সকাল আটটায় তিনি সিলেট শহরে আসেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেদিন তিনি যা দেখেছিলেনÑ‘বন্দর বাজার নাই। ইটপাটকেলের ভগ্ন আবর্জ্জনার স্তুপ। আবর্জ্জনার ভিতর হইতে মৃতদেহ বাহির করার চেষ্টা তখনও আরম্ভ হয় নাই। দেওয়ানী কালেক্টরীর বৃহৎ ইমারতগুলি ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। নানাস্থানে ফাটল বুকে লইয়া নবনির্ম্মিত মোনসেফি আদালতটা মাত্র খাড়া আছে। দেওয়ানী ফৌজদারী সব আদালত এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ। বসুমতী তখনও কখন বা মৃদুভাবে কখন বা একটু জোরে কাঁপিয়া উঠিতেছেন। কালীঘাটস্থ আমার বাসাবাড়ী প্রায় ভূমিসাৎ। আসবাবপত্র ঘরের মধ্যেই, সম্মুখস্থ রাজবর্ত্ম পাতালের দিকে নামিয়া গিয়াছে। পুত্র কলত্র এই বিপদে নোয়াসড়কে ভায়রা ভাইর আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। কালীঘাট ও শেখঘাটের নানাস্থানে দেহ পড়িয়াছে। রাজপথ ফাটিয়া বিপদসঙ্কুল হইয়াছে। গাড়ী ঘোড়া বন্ধ। সঙ্গীন বিপদে চোরও ধর্ম্মের কাহিনী শুনিয়াছে। নহিলে প্রায় তিনদিন পরে আসবাবপত্র, আলমারিস্থিত একখানা একশত টাকার নোট আমি কিছুতেই উদ্ধার করিতে পারিতাম না। সহরে মৃতের সংখ্যা কত উঠিয়াছিল তাহা এখন মনে নাই; তবে ১২০ কি ১৫০ শতের কম হইবে না। মফস্বল লইয়া মনে হয় দেবী বসুন্ধরার নৃত্য-কম্পনে শ্রীভূমির অন্যুন ৫০০ শত নরনারী প্রাণ হারাইয়াছিলেন। আর ক্ষতির কথা বলিবার নহে। আট দশ লক্ষের কম নয়। সৌভাগ্যের কথা শ্রীহট্ট মাতার সুসন্তান ঁরাজা গিরীশচন্দ্র, রায়বাহাদুর সুখময় চৌধুরী সি,আই,ই ও রাজদৌহিত্র ঁপ্রফুল্ল রায় দালানের নীচে পড়িয়া আহত হইলেও প্রাণে রক্ষা পাইয়া দেশ সেবায় মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন।’
ছ বছর বয়সে প্রথম যে মৃত্যুর সাথে নগেন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে, সেটা ছিলো তার নানার মৃত্যু। তিনি লিখেছেনÑ‘আমার মাতামহ রাড়িশাল নিবাসী ঁগৌরকিশোর চৌধুরী মহাশয় আমাদের কলিকাতাস্থ বাসায় স্বীয় দেহ রক্ষা করেন। তখন তাঁহার বয়:ক্রম সত্তরের উপর ছিল। তিনি রাত্রে মারা যান। আসন্নকালের কিছু পূর্ব্বপর্য্যন্ত আমি নিদ্রিত ছিলাম। আমাকে ঘুম হইতে জাগাইয়া মাতামহের রোগ শয্যার পাশের্^ উপস্থিত করা হয়। গিয়া দেখি তাহার কপোলদেশে কুঙ্কুম ও ভস্ম লেপন করা হইয়াছে। আমি বলি চৌধুরী ঠাকুর দাদা বে সিন্দুর দিয়াছেন। এই কথা শুনিয়া তাহার বদন মণ্ডলে হাস্যরেখা প্রকটিত হইল। কিন্তু কি বলিব সেই হাস্য রেখা মিলাইতে না মিলাইতেই তাহাকে ঘরের বাহির করিয়া গঙ্গাতীরের দিগে লোক ছুটিল। আমি পরে অনেক লোক মরিতে দেখিয়াছি কিন্তু এমন হাসিমুখে আর কাহাকেও মরিতে দেখি নাই। পরে শুনিয়াছি দাদা মহাশয় পূর্ব্বেই গঙ্গায় অন্তর্জ্জলী (মুমূর্ষ ব্যক্তির পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য দেহের নিম্নাংশ গঙ্গার জলে নিমজ্জিত করার সংস্কার) হওয়ার ব্যবস্থা করিতে অনুরোধ করিয়া ছিলেন।’
উল্লেখ্য, অন্তর্জ্জলী বা গঙ্গাযাত্রা প্রসঙ্গে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেনÑ‘পীড়িত কোন ব্যক্তির মৃত্যু আসন্ন হইলে তাহাকে গঙ্গাতীরে নিয়া রাখা হইত। কোন কোন স্থলে মৃতপ্রায় ব্যক্তির দেহের নিম্নভাগ গঙ্গার জলে ডুবাইয়া রাখা হইত। কারণ, হিন্দুদের বিশ^াস ছিল যে, গঙ্গাতীরে মৃত্যু হইলে, বিশেষত: গঙ্গাজলের মধ্যে দেহত্যাগ করিলে, মৃত ব্যক্তির পুণ্য ও আত্মার সদ্গতি হয়। শিক্ষিত হিন্দুরা এই প্রথার তীব্র নিন্দা করিলেও আইন বা সরকারী হুকুমে ইহা রহিত করিবার পক্ষপাতী ছিলেন না। গভর্ণমেন্ট তদনুযায়ী ইহা বন্ধ না করিয়া আদেশ দিলেন যে কোন মৃত্যুপথযাত্রীকে গঙ্গাতীরে নিবার পূর্বে পুলিশকে জানাইতে হইবে যে রোগীর বাঁচিবার আর কোন আশাই নাই। রোগীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়েরা এই মর্মে পত্র দিবেন এবং সম্ভব হইলে এই মর্মে চিকিৎসকের সার্টিফিকেট দাখিল করিবেন।’ [সূত্র: মুনতাসির মামুন, উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র (১৮৪৭-১৯০৫), তৃতীয় খন্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৮৮]