জীবনের পরাজয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২২, ৭:২৭:৩২ অপরাহ্ন

সরদার আজিজুর রহমান
তোমার সেই ভাই এর সন্ধান পেলে? আমার স্ত্রী একটু তিরস্কারের সুরে জিজ্ঞেস করে-বলতেই থাকলো, কোথায় কার কোন ভাই এসে বললো-আমি আপনার চাচাতো ভাইয়ের খালাতো ভাই, তার ফুফাতো ভাই, তার মামাতো ভাই, তার তালতো ভাই আমাকে দশ হাজার টাকা ধার দিন, আমি আস্তে আস্তে দিয়ে দেবো। ব্যাস, আর কোন কথা নাই, তাকে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলে। আট মাস হয়ে গেলো তো আট পয়সা কি দিয়েছে? যতো সব ছোট লোকের দল এখানে এসে মরে। আরো তো কতো মানুষ এই অভাবের দিনে ভাত না খেয়ে কষ্টে আছেÑতাদেরকে কিছু কিছু দিয়ে দাও। আর কিছু না হোক সওয়াব তো হবে, চাকরি তো তোমার আছেই চিন্তা কি আর।
ঘটনা যা ঘটেছে সকল স্ত্রীই স্বামীকে এমন তিরস্কার করতেই পারে। বিষয়টা আপনাদের খুলেই বলি। সে দিন ছিলো শুক্রবার। আমার অফিস নাই, দুটো ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সকালের নাস্তা খেয়ে গল্প করছি। দরজায় ঠক ঠক শব্দ হলো ডাকলো ভাইজান, আমি হাবিব। আমি দরজা খুললাম, দেখে পরিচিত মনে হলো। ভিতরে এসে বসতে বললাম। এসে বসলো।
Ñ কি ব্যাপার, কে তুমি, কেন এসেছো? তার পরিচয় দিলো,Ñবললো আমি সওকত ভাইয়ের অমুক ভাইয়ের তমুক ভাই। ভাইজান, আমি বড় বিপদে পড়ে একটা কাজে আপনার কাছে এসেছি।
Ñ বেশ, বলো, কি কাজে এসেছো? বলতে ইতস্ততঃ করছে বললাম বলো সমস্যা নাই বলো, কি কথা তোমার?
Ñ সে তার গল্প শুরু করলো, আমি ঢাকায় এসেছি গত ছয় বছর হয়ে গেছে। মিরপুর এক নম্বরে একটা গলির মোড়ে ছোট একটা মুদির দোকান দিয়েছিলাম। ভালোই চলছিলো। আমার বৌ-বাচ্চা নিয়ে ভালোই ছিলাম। করোনায় সব বন্ধ হয়ে গেলো। ছোট একটা ঘরে ভাড়া থাকতাম, ঘর ভাড়া, চারজন মানুষের খাবার জোগাড় করতে পারি না-কোন আয় নাই। গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। প্রায় দেড় বছর পরে গত মাসে ঢাকায় এসেছি। আগে যেখানে ছিলাম তার কাছেই এক রুমের ছোট্ট টিনের ঘর ভাড়া নিয়েছি। মাসে চার হাজার টাকা ভাড়া। দোকানটা মালিক অন্য লোককে ভাড়া দিয়েছে। দোকানে কিছু মাল-পত্র ছিলো ভাড়ার দায়ে সেগুলো মালিক নিয়ে গেছে। দোকান দেওয়ার মতো ঘর পাচ্ছি না। আর টাকা পয়সাও নাই, মনে করছি ভ্যান গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করবো। গত মাসের বাসা ভাড়া দিতে পারি নাই। ঘরে খাবার নাই। বাচ্চা দুটো ক্ষুধার কষ্টে আছে। তাই আপনার কাছে এসেছি। আমাকে দয়া করে যদি একটু সাহায্য করেন। আমি আপনাকে আস্তে আস্তে শোধ করে দেবো।
Ñ কতো টাকা হলে তুমি এখন সবজির ব্যবসা করতে পারবে?
Ñ ভাইজান আমাকে দয়া করে দশ হাজার টাকা দেন। আমি আপনাকে মাসে মাসে দিয়ে পাঁচ-ছয় মাসে শোধ করে দেবো। আপনাদের পাশের গ্রামে বাড়ি, আপনারা আমাদের আত্মীয়, এই আশা করে এসেছি ভাইজান। বাচ্চারা দুই দিন থেকে না খেয়ে আছে। অনেক কষ্ট নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, একটু দয়া করেন ভাইজান।
Ñ ওর কথায়-ওর কষ্ট আমার মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকলো। আমি দুর্বল হয়ে গেলাম। ওকে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলাম। ও বললো-খুব খুশী হলাম ভাইজান। আপনার উপকারের কথা সারা জীবন মনে থাকবে।
সেই যে গেলো আট মাস হয়েছে সে আসে নাই। আমার স্ত্রী তো এ ঘটনায় একটু তিরস্কার করতেই পারে। আমি তাকে খোঁজাখুঁজি করি না যে ঠিকানার কথা বলেছিলো সেখানেও কোন দিন যাই নাই। কারণ হয়তো দেখবো সে ঠিকানায় নাই। অথবা এখন এমন কষ্টে আছে যা দেখে শুনে আরো কিছু টাকা তাকে দিতে হবে। সে তো ভালো মানুষের ভালো ছেলে ছিলো, নিশ্চয় কোন বিপদে আছে-অসুখ-বিসুক, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই কতো রকমের বিপদ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যাকগে ওসব চিন্তা করে কষ্ট পেতে চাই না। দেখা যাক পাশের গ্রামের লোক যখন দেখা একদিন হবেই।
এবার দ্বিতীয় পর্বের কথা বলিÑ
ঐ যে লোকটা, মানে ছোট লোকটা দশ হাজার টাকা নিয়ে এলো তার নাম হাবিব আগেই বলেছি। হাবিব তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে গত মাসের ঘর ভাড়া চার হাজার টাকা দিয়ে দিলো। নিজে ঘরে দুই হাজার টাকার খাবার কিনলো। একটা রিকসা ভ্যান গাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য ঐ ভ্যান এর মালিকের কাছে দুই হাজার টাকা জমা রাখতে হলো। আর প্রতিদিন ভ্যান-এর মালিককে দুইশত টাকা ভাড়া দিতে হবে। মেরামত, যন্ত্রাংশ কেনা নিজের খরচ-এই চুক্তিতে একটা ভ্যানগাড়ি ভাড়া নিলো।
মিরপুর এক নম্বর বাজার থেকে দুই হাজার টাকার সবজি (তরকারি) কিনলো। মাজার থেকে ভিতর দিকে আবাসিক এলাকায় ঘুরে ঘুরে তরকারি বিক্রি করে। প্রথম দিনে পাঁচ শত টাকা লাভ হলো। ভ্যানের ভাড়া দেয় দুইশত টাকা। দুইশত টাকা ঘরে জমা রাখে। একশত টাকা নিজের খরচ হয়। কোনদিন একটু বেশি মাল আনে, বেশি লাভ হয়। এই রকম সপ্তাহ খানেক পার হলো। একদিন বিকেলে এক মহল্লার পাঁচ-ছয় জন ছেলে হাবিবকে ঘিরে ধরলো, বললো তুই কতোদিন থেকে এই মহল্লায় ব্যবসা করছিস?
Ñহাবিব বললো, এই ছয়-সাত দিন হলো।
Ñ ছেলেদের নেতা বললো-ছয় সাত দিন এই মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করছিস আমাদের চোখে পড়লিনা। তুই তো খুব চালাক। দে এক হাজার টাকা দে। আর প্রত্যেক দিন ঐ দোকানে (একটা স্থায়ী দোকান দেখিয়ে) দুইশত করে টাকা আমাদের চাঁদা দিবি। একদিনও যেন ভুল না হয়। ভুল হলেই তোর গাড়ি-টাড়ি ভেঙ্গে, তোর একটা ঠ্যাং ভেঙ্গে তোকে বিদায় করবো। ভুল করবি না। অন্য একজন বললো-আমাদের বড় ভাই খুব রাগী মানুষ। ভালোর ভালো খারাপের খারাপ। ভুল করিস না যেন, প্রত্যেক দিন সন্ধ্যার মধ্যে এই দুইশত টাকা দিয়ে দিবি। এখন এক হাজার টাকা বড় ভাইয়ের হাতে দে-এখনি দে, দেরি করিস না, দিয়ে দে। চিন্তা করার কিছু নাই। এ মহল্লায় ব্যবসা করলে সবাইকে চাঁদা দিতে হয়।
হাবিব বললো-ভাইজান! এই তরকারি বেঁচে সারা দিনে তিন-চারশ’ টাকা লাভ হয়। এতে সংসারই চলে না। আপনাদের দিলে আমার বৌ-বাচ্চা কি খাবে ভাইজান।
ওমনি একজন জোরে একটা থাবা মেরে দিলো হাবিবের গালে। হাবিব অবস্থা বেগতিক দেখে বললো-ভাইজান আমাকে একটু দয়া করেন এখন পাঁচশত টাকা দিচ্ছি। আর প্রত্যেক দিন একশ’ টাকা দেবো। আমার জন্য একটু দয়া করেন ভাইজান। আমি খুব গরিব মানুষ। আপনাদের পাড়ায় আছি। আর যায় কোথাÑওমনি আরেকজন হাবিবের দুই গালে দুই থাবা মেরে বললো-শালা এই মহল্লায় ব্যবসা করে খাও, আমাদের চাঁদা দিতে ক্যাকানি করো, তাড়াতাড়ি ফ্যাল এক হাজার টাকা। আর বড় ভাইয়ের কথা মতো প্রতিদিন দুইশ’ টাকা করে দিবি। না হলে তোর বিপদ আরো বাড়বে মনে রাখিস।
অবস্থা বেগতিক বুঝে হাবিব এক হাজার টাকা দিয়ে দিলো। যাবার সময় একজন হাবিবের পিঠে থাবা মেরে বললো-যা যা ভালো ভাবে ব্যবসা কর, আমাদের খরচা দিতে ভুলবি না।
হাবিব চিন্তায় পড়ে গেলো কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলোÑ কোন উপায় নাই, এখানে এই ব্যবসা করতে হলে এদের টাকা দিতেই হবে। অনেক ভেবে চিন্তে বাড়িওয়ালার একটা ছেলে কলেজে পড়ে তার সাথে আলাপ করলো। তাকে বুঝালো, ভাইজান আমি গরিব মানুষ ওদের আমি রোজ একশ’ করে টাকা দেবো। আপনি যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন, তা হলে আমার খুব উপকার হতো।
ছেলেটা হাবিবের বৌ-এর দিকে চেয়ে বললো-ঠিক আছে আমি ওদের বলবো আশা করি আমার কথা শুনবে। ঠিকই তারা রাজী হলো।
হাবিব তরকারি ফেরি করে বিক্রি করে। রোজ গড়ে পাঁচশ টাকা লাভ হয়। একশ’ টাকা পাড়ায় চাঁদা দিতে হয়। দুইশত টাকা ভ্যান ভাড়া দিয়ে দুইশত টাকা থাকে। তা দিয়ে কোন রকমে সংসারে চাল, ডাল খাবার ব্যবস্থা করা যায়। আগের মতো মাছ-গোস্ত খেতে পারে না। বাচ্চা দুটোর মনে সব সময় কষ্টবোধ থাকে।
এক সময় হাবিব অসুস্থ হয়ে পড়লো, বর্ষাকাল বৃষ্টিতে ভিজে ফেরি করা শরীরে কুলায় না, জ্বর কাশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। একদিন আর রাস্তায় বেরুতে পারলো না। ঘরেই শুয়ে আছে। দুপুরে বাচ্চাদের নিয়ে খেতে বসলো। সবজি ভাজি আর ডাল। গত কয়েকদিন এই রকম চলছে। বড় ছেলেটার বয়স দশ বছর হয়েছে ও সবই বোঝে-আগের চেয়ে থাকা-খাবার পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়েছে। ছেলেটা বললো-মা আমরা গরিব হয়ে গেছি তাই না।
চিন্তা করো না আর দুই তিন বছর পরে আমিও কামাই করতে পারবো। তখন আমাদের অভাব থাকবে না। অনেক ভালো বাসায় থাকবো। ভালো জিনিষ খাবো। হাবিবের জ্বর বেড়ে গেলো। পাড়ার দোকান থেকে ওষুধ এনে খেয়েছে। শরীর ভালো হচ্ছে না, আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঘরে খাবার নাই। সামান্য যা পুঁজি আছে তা যদি ঘরে বসে শেষ করে, তার পর কি করবে। তাই তিনদিন পরে অনেক কষ্টে ঝুকে ঝুকে ভ্যান গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরোলো। ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। সেই বড় ভাইদের সাথে আবার দেখা হয়ে গেলো। তারা ঘিরে ধরলো কিরে গত তিন দিন ফাঁকি দিয়েছিস শালা-আমাদের ফাঁকি দিয়ে যাবি কোথায়। আজ এই চার দিনের চারশ’ টাকা দিবি। দে, টাকা দে তাড়াতাড়ি দে আমাদের কাজ আছে।
Ñহাবিব মিনতি করে বললো, ভাইজান আমার শরীর খুব খারাপ জ্বর-কাশি। গত তিন দিন ঘরে শুয়ে ছিলাম। আজই রাস্তায় নেমেছি। একটু দয়া করেন ভাইজান, আমি খুব কষ্টে আছি।
Ñ সাথে সাথে একজন চড় মেরে দিলো গালে।
Ñ হাবিব কেঁদে কেঁদে বললো আমার গায়ে খুব জ্বর, আমারে মারেন না ভাইজান। আমি আজকের টাকা দিয়ে দিচ্ছি।
Ñএকজন কপালে হাত দিলো-সত্যিইতো তোর জ্বর, আচ্ছা যা বাকি টাকা মাফ করে দিলাম। একজন একটু দরদ দেখিয়ে বললো ওষুধ পত্র খেয়েছিস কিছু? আয়, আমাদের সাথে আয়, ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। কাছেই একটা ওষুধের দোকানে নিয়ে গেলো। দুই পাতা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দিয়ে দিলো।
হাবিব প্যারাসিটামল খায় আর ভ্যান গাড়িতে তরকারির ব্যবসা চালায়। শরীর দুর্বল হতে থাকে। ব্যবসার পুঁজি কমতে থাকে। তবুও একসময় পাড়ার এক ডাক্তারের কাছে যায়, তাকে তিনশ’ টাকা ভিজিট দেয়, প্রেসার, রক্ত পরীক্ষা করায়। ডাক্তার বললো জন্ডিস হয়েছে। বিশ্রামে থাকতে হবে, কোন রকম পরিশ্রম করা চলবে না। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, তরল খাবার, ওষুধ সময় মতো খেতে হবে। খরচ হয়ে গেলো হাজার টাকার বেশি। এখন পুঁজি পাঁচশ টাকাও নাই। শরীরে শক্তি নাই ভ্যান গাড়ি চালাবার মতো। দশ বছরের ছেলেটাকে সাথে রাখে ভ্যান গাড়ি চালাতে সাহায্য করার জন্য। সে বলে আব্বা আমার গায়ে অনেক শক্তি আছে। হাবিবের হৃদয় নিরবে কাঁদে। এই রকমভাবে মাসখানেক চললো-হাবিব বিছানায় পড়ে গেলো, ওষুধ কেনার টাকা নাই। মহাজনের কাছে দেনা হয়েছে। ঘরে খাবার নাই। ভ্যান গাড়ি মালিককে ফিরিয়ে দিয়েছে। হাবিবের বৌভাবে আর উপায় নাই আমাকেই এখন কিছু করতে হবে। পাড়ার এক মহিলা দোকানির সাথে পরামর্শ করলো, বললো কষ্টের কথা, এখন শুধুই না খেয়ে থাকা। মহিলা দোকানি বললো ইট-পাথর বইতে পারবি। যদি পারিস তাহলে ঐ বাড়ি (পাশের বাড়ি দেখিয়ে) মহিলার কাছে যা সে দালানের কাজে যায়। তার সাথে গেলে কাজ করতে পারবি নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। রোজ চারশ’ টাকা করে পাবি। রোজের টাকা রোজ দিয়ে দেয়। পারবি তো! হাবিবের বৌ হাবিবকে না বলে শুধু বড় ছেলেটাকে বলেÑআমি তোদের জন্য খাবার আনতে যাচ্ছি, পাঁচটা-ছয়টার সময় আসবো। ঐ দোকানি থেকে আটটা বনরুটি এনে নিজে দুটো খেলো, আর ঘরে হাবিব ও দুই ছেলের জন্য ছয়টা রুটি দিয়ে চলে গেলো কাজে। প্রায় সাতটার সময় চারশ’ টাকা নিয়ে ফিরে এলো ঐ দোকানি মহিলার কাছে। দুই কেজি চাল, কিছু কিছু ডাল, মরিচ, পিঁয়াজ, তেল, লবণ, জ্বালানি কাঠ নিয়ে ঘরে এলো। রান্না করে সবাইকে খাওয়ালো। এইভাবে কয়েকদিন গেলো। একদিন রাত্রে বাড়ির মালিক মহিলা এলেন হাবিবের ঘরে।
Ñ কি ব্যাপার দুই মাসের ভাড়া বাকি পড়েছে। টাকা দিচ্ছো না কেনো। ঘর ভাড়ার টাকা মাসে মাসে না দিলে ঘর ছেড়ে দিতে হবে।
Ñ হাবিবের বৌ বললো, খালাম্মা একটু বসেন। দেখেন কি অবস্থায় আছি। উনি বিছানায় পড়ে আছেন গত এক মাসের বেশি হচ্ছে। ঘরে খাবার নাই, ওষুধ কিনতে পারিনা।
Ñ বাড়ির মালিক হাবিবকে দেখে বুঝলেন ও বিছানা থেকে উঠতে পারে না। খুব কাতর দেখাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে?
Ñ হাবিবের বৌ বললো জন্ডিস হয়েছে। ওনার খাবার, ওষুধ কিনতে পারছি না কষ্টে আছি খালাম্মা। আমি সপ্তাহ খানেক হচ্ছে এক বিল্ডিং এ পাথর-ইট বওয়ার কাজ করি। রোজ যা পাই কোনো রকম দু’বেলা খাই আর ওনার ওষুধ কিনি। এই মাসে দেবো খালাম্মা। আস্তে আস্তে সব শোধ দিয়ে দিবো। একটু দয়া করেন খালাম্মা।
Ñবাড়ির মালিক মহিলা বললেন, তা তো বুঝলাম। শোনো তুমি কাল থেকে আমার ঘরের কাজ করবে। সকালে থালা-বাসন ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেওয়া-মোছা., কাপড়-চোপড় ধোয়া। আর রাত্রে একবার এসে থালাবাসনগুলো ধুয়ে দেবে। তোমার ঘর ভাড়া এক হাজার টাকা কেটে দেবো। কি বলো পারবে তো?
Ñ হাবিবের বৌ রাজি হয়ে যায়। সকালে উঠে নিজের ঘরের কাজ শেষ করে বাড়ির মালিকের ঘরের কাজ করে। নয়টার মধ্যে বিল্ডিং এর কাজে যায়। সন্ধ্যায় এসে নিজের ঘরের রান্না করে বাড়ির মালিকের ঘরে থালাবাসনগুলো ধুয়ে দিয়ে আসে। তার পরে বাচ্চাদের খাওয়ায়, হাবিবকে খাওয়ায়, নিজে খায়, ঘরের কাজ করে।
একদিন রাত্রে বাড়ির মালিকের দালানে যায় থালাবাসনগুলো ধুয়ে দেবার জন্য। বাড়ির মালিক খালাম্মা বাড়িতে নাই। কোন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছে। ওনার কলেজে পড়ুয়া ছোট ছেলেটা একা আছে।
হাবিবের বউ এর বয়স ত্রিশ বছরের বেশি হবে না। চেহারা ছবি বেশ ভালো সুন্দর বলা যায়। হাবিবের বৌকে একা ঘরে পেয়ে ঐ ছেলের লোভ হয়। আগে থেকেই কথা বলাবলি হতো। আজ একা পেয়ে ডাকলো ওর রুমে। ডুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলো। হাবিবের বউ বলে কি করেন ভাইজান। আমার জীবনটা নষ্ট কইরেন না। আপনার আল্লার দোহাই লাগে।
বাঘের ক্ষুধা কি আর ধর্মের কথা মানে, বাহুতে জড়ায়ে ধরে। ঝাকি দিয়ে খাটের উপর শোয়ায়ে তার কাজ-সাধ সমাধা করে হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে দেয়Ñআর বলে কাউকে কিছু বলবে না। আমার কথা শুনলে আমি তোমাকে অনেক টাকা দেবো। তোমার স্বামীর চিকিৎসা করাবো। আমার কথা না শুনলে বিপদ হবে। তোমার স্বামী মরবে, ছেলেদের হারাবে, তোমার জীবন অনেক কষ্টের হবে। যাও চিন্তা করে দেখো।
হাবিবের বৌ সারা দিন পাথরের বোঝা বয়, আরভাবে কি করবে। এখানে থাকলে তো এই শয়তানটার কথা শুনতেই হবে। স্বামী বিছানায় কাতরাচ্ছে। তার ওষুধ তার খাবার জোগাড় করতে পারি না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। পরান মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে সন্ধ্যায় ঘরে আসে আরভাবে ঐ দোকানি মহিলার সাথে কি পরামর্শ করবে! আবারভাবে এসবকথা অন্যকে বলা সমাজেও ইজ্জত হারাতে হবে। যা আছে নিজের মধ্যেই থাক। না হলে নিজের স্বামী-সন্তানদের কাছেও হয়তো ছোট হতে হবেÑহয়তো তাদের হারাতে হবে তারা আমাকে ঘৃণা করবে। না কাউকে কিছু বলবো না। নিজেই আস্তে আস্তে একদিন এর অত্যাচার থেকে সরে আসবো। আল্লা’র কাছে মাফ চাইবো। আল্লা আমাকে মাফ করবে। আমিতো স্বামী সন্তানের কষ্টে, এই ছেলের কথায় রাজি হয়েছি। আল্লা আমার কষ্টের কথা বুঝবে। আমাকে ক্ষমা করে দেবে।
এই বাড়ির মালিক মহিলার অনেক আত্মীয়-স্বজন এই শহরে আছে। প্রায়ই তিনি এখানে ওখানে বেড়াতে যান। সেই সুযোগে হাবিবের বৌয়ের সাথে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে থাকে। হাবিবের বৌ এখন সহজেই ঐ ছেলের হাতে ধরা দেয়। টাকা দেয় কিছু উপহার দেয় মাঝে মাঝে। সম্পর্ক ভালোই হলো দু’জনার। মন নয় শুধু শরীরে শরীরে এই সম্পর্ক। দিন যায়-রাত পোহায় হাবিবের শরীর খারাপ হতে থাকে। হাবিবের বৌ ঐ ছেলেটাকে অনুরোধ করে হাবিবের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য। ছেলেটা রাজি হয়।
ছেলেটা চিন্তা করে, হাবিবকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে দেবে। আর দশ বছরের ছেলেটাকে বাইরে কোথাও কাজে দেবে। আট বছরের ছেলেটাকে তার বাবার কাছে রাখবে হাসপাতালে। ফলে দীর্ঘ সময় সে হাবিবের বৌকে কাছে পাবে।
এক সময় সেই সুযোগ হয়ে গেল। হাবিবের দশ বছরের ছেলেটাকে পাড়ার এক চায়ের দোকানে মেসিয়ার হিসাবে ঠিক করে দিলো। হাবিবকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে দিলো। ছোট আট বছরের ছেলেটাকে তার বাবার কাছে থাকতে বললো।
হাবিবের ঘর ফাঁকা। খেলার সাথী দু’জনার এখন সকালে রাতে দীর্ঘ সময় খেলা করার সুযোগ হয়। ভালো লাগা হয় কিন্তু ভালোবাসা নয়।
হাবিবকে হাসপাতাল থেকে যে খাবার দেয় ওষুধ দেয়, তাই খায়। ছোট ছেলেটা আশে পাশের রোগিরা, তাদের স্বজনরা যে খাবার দেয় তাই খায়। হাবিবের বৌ দিন রাত কাজে ব্যস্ত। হাসপাতালে প্রতিদিন যেতে পারে না, তিন-চার দিন পর একদিন যায়। শুধু দেখে আসে। ডাক্তার বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বলে, ওষুধ কেনা হয় না। বলেÑআমরা গরিব মানুষ কাজ করে খাই। ওষুধ কিনবো টাকা পাবো কোথায়। কোন কোন সময় পাশের কোন রোগির স্বজন কিছু ওষুধ কিনে দেয়। তাই খায়। তাতো অনিয়মিত। তাতে কি আর অসুখ ভালো হয়।
এক দুই করে তিন মাস পার হয়ে যায়। হাবিবের বৌ-এর দিন একইভাবে চলছে। তবে কাজ একটা ভালো করে হাবিবের বৌ। ভাইজানের দেনা শোধ দিতে হবে। টাকা গোছায়, প্রতিদিন টাকা গোছায় দশ হাজার কবে হবে। এক সময় দশ হাজার টাকা যোগাড় হয়ে যায়।
হাবিবকে একদিন মেডিকেল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বের করে দেয়। হাবিব শুকায়ে কাঠের কঙ্কাল হয়ে গেছে। লাঠি ভর দিয়ে ধীরে ধীরে একটু দাঁড়াতে-হাঁটতে পারে। ডাক্তার বলেছে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলে গায়ে শক্তি হবে ভালো হয়ে যাবেন। বাসায় নিয়ে এলো হাবিবকে। বিছানায় শুয়ে থাকে বৌ যা আনে যা দেয় তাই খায়। ওষুধ ঠিক মতো খাওয়া হয় না।
ঐ ছেলের সাথে হাবিবের বৌ-এর লীলাখেলা চলছে সময়ে-অসময়ে, যখনি সুযোগ-সুবিধা হয়। তবে ছেলেটা টাকা দেয়, ভালো ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে হাবিব এবং ছেলেদের জন্য ভালো খাবার কিনে দেয়।
হাবিবের বৌ একদিন ভাবলো ভাইজানের বাসায় যাবে। তার টাকাগুলো দিয়ে আসবে। হাবিবের সঙ্গে পরামর্শ করলো।
Ñহাবিব বললো তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে? আর কারো কাছ থেকে ধার-টার করো নাই তো?
Ñহাবিবের বৌ বললোÑনা ধার করি নাই। তুমি আর ছোট ছেলে হাসপাতালে। বড় ছেলেটা চা-এর দোকানে। আমি যা পেয়েছি খেয়ে-না খেয়ে গোছায়ে রেখেছিÑহয়ে গেছে দশ হাজার টাকা।
Ñতুমি যেখানে কাজ করো তারা তোমাকে রোজ কতো টাকা করে দেয়?
Ñআমাকে এখন তারা পাঁচশ টাকা করে দেয়। আগামী মাস থেকে আরো একশ’ টাকা করে বাড়ায়ে দেবে। কারণ আমি একটু লেখা-পড়া জানি, হিসাব রাখতে পারি, তাই তারা বলেছে আমাকে ছয়শ’ টাকা করে হাজিরা দেবে।
Ñ হাবিব বললো তা হলে চলো একদিন রিকসায় করে যেয়ে ঐ ভাইজানের টাকা দশ হাজার দিয়ে আসি।
হাবিব দুর্বল হাত দিয়ে তার প্রিয় বৌ’কে বুকে জড়িয়ে ধরে। মুখে চুমু খায়Ñতুমি কতো কষ্ট করছো অথচ আমি বেঁচে আছি। আমার এখন মরে যাওয়াই ভালো। তোমার মুখের দিকে চাইতে পারি না। বুকটা ব্যথা করে ওঠে। তোমাকে আদর করতে পারি না, শরীরে শক্তি নাই। এই বেঁচে থাকার কি অর্থ আছে বলোÑতুমি আমার জন্য আর কোন ওষুধ কিনবে না।
আমি মরে যেতে চাই। এই পৃথিবীর আলোয় আমার জীবন আর সাঁতরাতে পারছে না। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চাই। তোমার বোঝা হয়ে তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাই না।