জৈন্তাপুরের প্রবল স্রোতে নৌকা ডুবির ঘটনায় যুবক নিখোঁজ
টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সিলেট এবং সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ মে ২০২২, ৬:৩৫:২৫ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার : টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সিলেট এবং সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। লোকালয়সহ বিভিন্ন রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সিলেটের জৈন্তাপুরের নয়াগাং নদীর শুক্কুরের ভাঙ্গা নামক স্থানে প্রবল স্রোতে নৌকা ডুবির ঘটনায় এক যুবক নিখোঁজ হয়েছেন। সিলেট জেলা সদরের সাথে গোয়াইনঘাট সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের সাথে প্রত্যন্ত এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় পানিবন্দী লোকজন বিপাকে পড়েছেন।
জৈন্তাপুর ঃ জৈন্তাপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, জৈন্তাপুর উপজেলায় টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে বন্যায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সারী ও বড় নয়াগং নদীর পানি বিপদ সীমার .৪৯ সেন্টি মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, গত তিন দিনে টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলে পানি বন্দী হয়ে পড়েছে নিজপাট, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের অনেক পরিবার। বন্যায় আটকে পড়া লোকজনকে নৌকা অথবা বেলায় করে উঁচু স্থানে আশ্রয়ের জন্য ছুটতে দেখা গেছে ।
বন্যা কবলিত এলাকা নিজপাট ইউনিয়নের মেঘলী, বন্দরহাটি, লামাপাড়া, ময়নাহাটি, মোরগাহাটি, জাঙ্গালহাটি, মজুমদারপাড়া, নয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, গোয়াবাড়ী, তিলকৈপাড়া, বড়খেল, ফুলবাড়ী, বন্দরহাটি, ডিবিরহাওর, ঘিলাতৈল, মাস্তিং, হেলিরাই, জৈন্তাপুর ইউনিয়নের মুক্তাপুর, বিরাইমারা, বিরাইমারা হাওর, লামনীগ্রাম, কাটাখাল, খারুবিল, চাতলারপাড়, ডুলটিরপাড়, ১নং লক্ষ্মীপুর, ২নং লক্ষ্মীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, কাঠালবাড়ী, নলজুরী হাওর, বালিদাঁড়া, রামপ্রসাদ, থুবাং, বাউরভাগ উত্তর, বাউরভাগ দক্ষিণ।
উপজেলা সারীনদী ও বড় নয়াগাং নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সারী নদীর পানি বিপদসীমার .৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান সারী-গোয়াইন বেড়ীবাঁধ প্রকল্পের কর্মকর্তা মো. আলা উদ্দিন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমদ আরো জানান, তিনি বন্যা প্লাবিত এলাকাগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ খবর রাখছেন। বন্যা কবলিতদের সহায়তার জন্য স্থানীয় মন্ত্রীসহ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জরুরী প্রয়োজন দেখা দিলে আশ্রয় কেন্দ্র চালু করা হবে।
এদিকে, গতকাল সকাল ১১ টায় বড় নয়াগাং নদীর শুক্কুরের ভাঙ্গা নামক স্থানে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৫ নৌকা আরোহী প্রবল স্রোতে তলিয়ে যান। স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে দ্রুত দুই শিশুসহ ৪ জনকে উদ্ধার করেন। গতকাল শুক্রবার রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ গড়েরপার গ্রামের ফুল মিয়ার ছেলে আলমগীর মিয়া (২৮) এর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
নৌকা ডুবির সংবাদ পেয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল বশিরুল ইসলাম, জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফখরুল ইসলাম, জৈন্তাপুর মডেল থানার পুলিশসহ নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ফায়ার সার্ভিসের সদস্য নিয়ে তারা নিখোঁজ আলমগীরের সন্ধান চালাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল বশিরুল ইসলাম জানান, বন্যা প্লাবিত এলাকার খবর রাখা হচ্ছে। ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম পুলিশদের বন্যা পরিস্থিতিতে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নৌকা ডুবির ঘটনায় উদ্ধার কাজ চলছে। উদ্ধার হওয়া শিশুসহ বাকীদের জৈন্তাপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
গোয়াইনঘাট ঃ গোয়াইনঘাট থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ভেসে গেছে পুরো গোয়াইনঘাট উপজেলা। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ধান জমি। ইতোমধ্যে সিলেট সদরের সাথে যোগাযোগের উপযোগী একমাত্র রাস্তা সারি-গোয়াইনঘাট রাস্তার বিভিন্ন অংশ পানিতে ডুবে গেছে। যার ফলে সিলেটের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, চরম শংকায় রয়েছেন গোয়াইনঘাটবাসী। উপজেলার পূর্ব জাফলং, মধ্য জাফলং, পূর্ব আলীরগাঁও, পশ্চিম আলীরগাঁও, পশ্চিম জাফলং, রস্তমপুর, ডৌবাড়ী, তোয়াকুল ইউনিয়নসহ সবক’টি ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কৃষি, মৎসসহ ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে গোয়াইনঘাট-রাধানগর রাস্তা। পিরিজপুর সোনার হাট রাস্তায় উনাই ব্রীজ নির্মাণ কাজ চলার কারণে তৈরিকৃত বাইপাস (ডাইবারসন) রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় গোয়াইনঘাট সদরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন দুটি ইউনিয়নের মানুষ।
বন্যার ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে জানতে চাইলে গোয়াইনঘাট উপজেলা কৃষি অফিসার রায়হান পারভেজ রনি জানান, আমাদের হাওর অঞ্চলের বোরো ধান উঠে গেছে। তবে আউশ ধানের বীজতলা নিয়ে শংকা রয়েছে। পানি এভাবে বাড়তে থাকলে বীজতলা ডুবে ক্ষতি হতে পারে। সর্বোপরি গোয়াইনঘাটের ১০টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জ ঃ কোম্পানীগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গ্রামীণ অনেক রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। গবাদিপশু নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। কিছু কিছু এলাকার আউশধানের বীজতলা ডুবে গেছে। তবে, হাওরাঞ্চলের বোরো ধান শতভাগ কাটা হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রায়হান পারভেজ রনি বলেন, হাওরাঞ্চলের শতভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। কিছু এলাকার আউশধানের বীজতলা ডুবেছে। তবে তা ৫ শতাংশের বেশি হবে না।
দক্ষিণ রনিখাই ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ওই ইউনিয়নের হাওর ও নন-হাওর এলাকার শতভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, কোম্পানীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করে নাই। পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
দোয়ারাবাজার ঃ দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, দোয়ারাবাজারে টানা ৩ দিন ধরে অঝোরে বৃষ্টিপাত ও মেঘালয় থেকে নেমে আসা আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে উপজেলার নিম্নাঞ্চল ও লোকালয়সহ বিভিন্ন রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন মাঠে পড়ে থাকা অবশিষ্ট পাকা বোরো ধান। একদিকে, শ্রমিক সংকট, অপরদিকে, আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে শঙ্কা কাটছেনা বিপাকে পড়া হাওরপাড়ের ভুক্তভোগী কৃষকদের। সুরমা, চেলা, মরা চেলা, চিলাই, চলতি, কালিউরি, ধূমখালি ও ছাগলচোরাসহ বিভিন্ন হাওর, খাল-বিলের পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যার আশঙ্কা করছেন উপজেলাবাসী। সীমান্তবর্তী বাংলাবাজার, লক্ষ্মীপুর, বগুলা, নরসিংপুর, সুরমা, দোহালিয়া, পান্ডারগাঁও, মান্নারগাঁও ও দোয়ারা সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন রাস্তা, মাঠঘাট, আউশ জমিতে পানি ঢুকছে। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে মাঠের অবশিষ্ট বোরো ফসল ও রবিশস্য উৎপাদন অনিশ্চিতের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। মাঠ ও গোচারণ ভূমিতে পানি উঠায় গো-খাদ্য সংকটসহ মৎস্য খামারিরাও রয়েছেন চরম শঙ্কায়। কেননা গত বছর চার দফা বন্যায় ভেসে যায় শতাধিক খামারের কোটি কোটি টাকার মাছ ও মাছের পোনা ও রেনু। এ প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাংশু কুমার সিংহ বলেন, পানি বাড়লেও কোথাও ক্ষয়ক্ষতির খবর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রশাসনিক তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।