টেকসই অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মার্চ ২০২১, ৪:২৬:২০ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম
২০২০ সালটি একটি ঐতিহাসিক বছর। এই ইতিহাস কত দীর্ঘ হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। একটি ভাইরাসের তা-বে বিশ্ববাসী আজ অসহায়। গত ১০০ বছরের ইতিহাসে এ রকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিশ্ব কখনো পড়েনি। ১৯৩০ সালের পর এই প্রথম ভয়াবহ মন্দায় পড়ছে বিশ্ব। আইএমএফের মতে, ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি ২৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতি সঙ্কুচিত হবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বহু কাক্সিক্ষত টিকা মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়েছে। তবে ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ও কোথাও কোথাও নতুন স্ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে জীবন ও জীবিকা নিয়ে জনমনে আবারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মহামারী দীর্ঘায়িত হলে এই মন্দাও দীর্ঘায়িত হবে এবং কোন আকৃতিতে পুনরুদ্ধার হবে তা সঠিক করে বলা মুশকিল। বিশ্বজুড়ে পুরো বছরটি অভিশপ্ত। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণমুখী দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জিংও বটে। বাংলাদেশ এক দশকব্যাপী ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৮-১৯ সালে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়েছে। যা এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বচ্চ। তবে করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। উল্লিখিত সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। আশার কথা হলো, জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কম অর্জিত হলেও ইতিবাচক ধারা বজায় রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। বিশ্বায়নের এই যুগে যখন প্রতিটি দেশ পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই গত বছরের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক করোনা ভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো মহামারী হিসেবে ঘোষণার পর পরই বিশ্ববাসী বিশ্বকে দেখল এক নতুনরূপে। এ যেন এক ভিনগ্রহ। বাস্তবতা হচ্ছে, এই নিউ নরমাল জীবনে বিশ্বায়নের গতি থমকে যাবে। এই মহামারীকে বিশ্বায়নের কফিনে শেষ পেরেক বলে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ। ইতিহাসবিদ ইয়োভাল নোয়া হারারির মতে, করোনা ভাইরাস-পরবর্তী বিশ্বে আরেকটি বড় প্রবণতা হবে কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান। প্রত্যেকটি দেশ নিজেকে সুরক্ষিত করতে চাইবে অন্যের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে। এরই মধ্যে এ রকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। ইতালি তো সরাসরি অভিযোগ করেছিল, তার দুর্যোগের দিনে অন্য ইউরোপীয় দেশ পাশে দাঁড়ায়নি। সর্বোপরি গরিব দেশগুলোর কথা চিন্তা না করে ধনী দেশগুলোর করোনা পরীক্ষার কিট ও ভ্যাকসিন কেনাই এর বড় উদাহরণ। এই মহামারী জাতীয়তাবাদকে আরও উসকে দেবে।
করোনা-পরবর্তী বিশ্ব হবে আগের চেয়ে কম খোলামেলা, কম সমৃদ্ধ এবং কম স্বাধীন। করোনা ভাইরাস খুব শিগগিরই যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তা হলে ধরে নেওয়া যায় এই একলা চলা প্রবণতা অব্যাহত থাকবে এবং স্বাভাবিক কারণে বিশ্ববাণিজ্য হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রাক্কলন অনুসারে, এ বছর বিশ্বের পণ্য বাণিজ্য ১৩ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার রপ্তানি সবচেয়ে বেশি কমবে বলে ধারণা করছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। এর মধ্যে আবার এলডিসি থেকে উত্তরণও এই সময়ে নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উত্তরণ ঘটলেই রাতারাতি বাজারসুবিধা হারিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে রপ্তানিকারকদের।
গত ১০ বছরে পশ্চিমা দেশে পোশাকের ধরন ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। এর সঙ্গে আমরা তাল মেলাতে পারিনি। শুধু পোশাকের ব্যবসা করলে হবে না। বহুমুখী ব্যবসায় যেতে হবে। নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ করোনায় লাইফ স্টাইলের যে পরিবর্তন হয়েছে, সেটি বেশ কয়েক বছর অব্যাহত থাকবে। গবেষণা করে দেখতে হবে কোন ধরনের পোশাকের চাহিদা বাড়বে। শুধু পোশাক নয়। আমাদের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য- চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, মৎস্য, ওষুধ ও সিরামিক পণ্যে বিশেষ নজর দিতে হবে। এর বাইরে রয়েছে অনেক অপ্রচলিত পণ্য, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমান। দিন দিন এই অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি ঝুড়ি বড় হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়ছে, অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও। আরও বিশদ গবেষণা করে, প্রয়োজনে প্রণোদনা ও ভর্তুকি বাড়িয়ে এই পণ্যগুলো রপ্তানি বাড়াতে হবে। অর্থাৎ রপ্তানি বাণিজ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে প্রতিযোগ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় রপ্তানি ঝুঁকি বেড়ে যাবে। শুধু এক পণ্যের ওপর নির্ভরতা এই কোভিডকালীন অথবা পরবর্তীকালে রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস দেখা দিতে পারে। আমাদের অর্থনীতির আরেকটি নির্ভরযোগ্য খাত হচ্ছে প্রবাসী আয়। এটি বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম বড় খাত, যার ওপর ভর করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০০৯-১০ সালে ছিল ১০ বি. ডলার। মার্চ ও এপ্রিলে রেমিট্যান্সে ব্যাপক পতন হয়। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে দেশের ইতিহাসে সর্বচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে। সদ্যসমাপ্ত বছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার। যেখানে ২০১৯ সালে আসে ১ হাজার ৬৮৯ কোটি ডলার। এই করোনাকালে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসা প্রবাসীদের করোনা আতঙ্ক অথবা টাকা পাচারকারীদের আগের পাচারকৃত অর্থ কিনা সেটি ভেবে দেখার বিষয়।
করোনার মধ্যে রেমিট্যান্স উচ্চ ধারায় থাকলেও নতুন করে শ্রম রপ্তানি একেবারে বন্ধ। কোভিড-পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্সের এই ধারা অব্যাহত রাখতে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির বিকল্প নেই। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮ সালে প্রবাসে ৩ লাখ ১৭ হাজার দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি হলেও ২০১৯ সালের শেষে এসে এই সংখ্যা ৩ লাখ ৪ হাজারে এসেছে। সেই সঙ্গে স্বল্পদক্ষ জনশক্তি প্রেরণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৩ হাজার থেকে কমে ১ লাখ ৯৭ হাজারে নেমে এসেছে। ভবিষ্যতে প্রবাসে শ্রমবাজার তথা কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স ঠিক রাখতে আমাদের শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। কারণ বৈশ্বিক এই সঙ্কুচিত অর্থনীতিতে ভবিষ্যতের শ্রমবাজার হবে দক্ষ শ্রমনির্ভর বাজার। বৈদেশিক মুদ্রার বড় দুটি খাত- তৈরি পোশাক রপ্তানি ও অভিবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স দুটিই পরনির্ভর, যে কোনো সময় এর ভালো-মন্দের হেরফের ঘটতে পারে। করোনাকালে কর্মসংস্থান, দরিদ্রতা, আয় বৈষম্য নিরসন ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি করতে গ্রামীণ অর্থনীতি গতিশীল করতে হবে। বিদেশে ফিরতে না পারা প্রবাসী কর্মী ও শহুরে কর্মসংস্থানহীন বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরে এসেছে। এই বৈপরীত্য আগে কখনো দেখা যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের সময় এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও গতিশীল ও সম্প্রসারণ করে সেখানে কর্মসংস্থান বা আয় সংস্থান আরও বাড়ানো। গ্রামীণ অর্থনীতি বলতে শুধু শস্য উৎপাদন নয়। কৃষি খাতের অন্য উপশাখা যেমন- মৎস্য, পশুপালন, পোলট্রিশিল্পেও মনোযোগ দিতে হবে। জিডিপিতে এর অবদান ১৮-১৯ শতাংশ। কৃষিপণ্য আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। আবাদি জমি বাড়িয়ে কৃষিতে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত জনশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু কৃষি উৎপাদন নয়, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে জোর দিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে গ্রামে শাখা খুলে অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি আমাদের অর্থনীতির রক্ষাকবচ। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হলে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দরিদ্রতা হ্রাস পাবে। করোনা ভাইরাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, শুধু সস্তা পণ্য রপ্তানি ও সস্তা শ্রম তথা পরনির্ভরশীলতার ওপর ভর করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। তাই অর্থনীতির এই নড়বড়ে অবস্থা থেকে মুক্ত করতে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ ও দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা ও বৈষম্য দূর করে একটি টেকসই অর্থনীতি গঠনে ভূমিকা রাখবে।
এই বাংলার মানুষ আদিকাল থেকে প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থেকেছে- এগিয়েছে। সাধারণ মানুষ বরাবরই সংগ্রামী, তারা বিরূপ বাস্তবতার আঘাতেও ভেঙে পড়ে না, হাল ছাড়ে না; বরং সব সময় উদ্যমী, পরিশ্রমী। দুর্যোগে-দুর্বিপাকে টিকে থাকার এক অসম্ভব অমিত শক্তি তাদের আছে। তারা জানে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। করোনার বিরুদ্ধে আমরা শুধু টিকে থাকছি না, আমরা ভালো করছি। তাই তো এত বৈরিতার মধ্যেও প্রত্যাশার স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াবে এই বীরের জাতি। এটাই হোক আমাদের নতুন বছরের প্রত্যয়।
লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।