ডাহুকের সংসার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মার্চ ২০২১, ৫:৪৫:১৪ অপরাহ্ন

জসীম আল ফাহিম
শ্যামল গাঁয়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে সরু মেঠোপথ। পথের দু-ধারে ঘন ঝোপঝাড়। ঝোপের পাশে এঁদো ডোবা। ডোবার জল কুচকুচে কালো। সেই কালো জলে কলমিলতা, হেলেঞ্চালতা, কচুরিপানা, শ্যাওলা ও বিচিত্র জলজ উদ্ভিদ মাথা তোলে আছে। ডোবার জলে বিভিন্ন প্রজাতির ছোটো ছোটো মাছ বসবাস করে। আপনমনে তারা জলের ভেতর সাঁতরে বেড়ায়। সেই ডোবায় আরও কিছু প্রাণী বসবাস করে। একটি ঢোঁড়া সাপ, যার গায়ে হলুদের ওপর কালো কালো ডোরা। একটি শোল মাছ, যার কালচে নীল রঙের শরীর। তবে ওর চোখ দুটো টকটকে লাল। একটি সোনাব্যাঙ, যার গাবদা-গোবদা হলদে শরীর। হলুদের ওপর আবার কালো কালো রেখা। আর বাস করে রং-বেরঙের পাখাঅলা কয়েকটি প্রজাপতি। বেশকটি বন্দুক ফড়িং। কয়েকটি গাঙফড়িং ও একটি ফিঙে পরিবার।
প্রজাপতিরা ঘাসফুলে আপনমনে ওড়াউড়ি করে। ফড়িংয়েরা জলের ওপর উড়ে উড়ে নিজেদের ছবি দেখে ঘুরে বেড়ায়। শোল মাছটি দর্পভরে ডোবার জলে সাঁতার কাটে। আর খিদে পেলে ছোটো ছোটো মাছ ধরে খায়। ঢোঁড়া সাপটি কচুরিপানার ফাঁক-ফোকর দিয়ে অবাদে বিচরণ করে। ইচ্ছে হলেই সে ব্যাঙ, ঘাসফড়িং, ছোটো মাছ ও পোকামাকড় ধরে খায়। ডোবার ঠিক মাঝখানে একটি মাথাভাঙা খুঁটি রয়েছে। মন চাইলে ফিঙেরা উড়ে এসে লেজ দুলিয়ে সেই খুঁটিতে বসে। লেজ নাড়িয়ে তারা আপনমনে গান করে।
সেই ডোবায় একদিন একজোড়া বুনো ডাহুকের আগমন ঘটল। পাখি দুটো দেখতে খুবই সুন্দর! জলচর পাখি। খুবই ভীরু। মাঝারি আকারের পাখি। বড়ো লাজুক স্বভাবের। ছোটো লেজ। চিকন লম্বা পা। পায়ের আঙুলও বেশ লম্বা। পিঠের রং ফ্যাকাশে কালো থেকে খয়েরি-কালো। মাথা ও বুক সাদা রঙের। লেজের নিচের অংশে লালচে আভা। হলুদ রঙের ঠোঁট। ঠোঁটের ওপর লাল রঙের একটি ছোট্ট দাগ।
ডোবার আশপাশে ঝোপঝাড় ও ছোটোবড়ো গাছপালা থাকায় ডাহুকদের কাছে জায়গাটা নিরাপদ বলে মনে হলো। জলের মধ্যে ছোটো ছোটো মাছ থাকায় এখানে কোনো খাদ্য সমস্যাও নেই। কাজেই বাসা বানানোর জন্য এটা একটা উপযুক্ত স্থান। ভেবে ডোবার জলে কচুরিপানার ঝোপের ভেতর তারা সুন্দর একটা বাসা বানাল। লতাপাতা আর ঘাস দিয়ে তৈরি বাসা। বাসা তৈরির পর ডাহুকেরা আপনমনে ডোবার আশপাশে ওড়াউড়ি শুরু করে দিলো। উড়ে উড়ে তারা প্রাণ খুলে গান করে। আর ইচ্ছে হলেই উড়ে এসে বাসাটিতে বসে। নিজের বাসায় শুয়েবসে তারা বিশ্রাম নেয়।
ডাহুক পাখিদের এমন ওড়াউড়ি কিন্তু ফিঙে পাখিদের মোটেও ভালো লাগল না। তাই পাখিরাজ ফিঙে একদিন গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কেন এখানে এসেছ? এটা তো আমাদের জায়গা। জলদি বিদায় হও।’
ফিঙের কথার জবাবে ডাহুক বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘পাখিরাজ! অনেকদূর থেকে আমরা এসেছি। তাই আমরা খুব ক্লান্ত। এটা আপনাদের জায়গা মানছি। তবু অন্তত দুটো দিন এখানে একটু থাকতে দিন। একটু বিশ্রাম নিতে দিন।’
ডাহুকের কথায় সাঁই দিয়ে ডাহুকিও বলল, ‘হ্যাঁ পাখিরাজ। এখানে আমাদের দুটো দিন থাকতে দিন।’
ওদের এমন কাকুতি মিনতি শুনে ফিঙে পাখি আর বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘ঠিক আছে। থাকো তাহলে দু-দিন।’
পরদিন ঢোঁড়া সাপ ডাহুকদের বাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ওদের দেখে সে মাথা তুলে দাঁড়াল। তারপর তার দু-ভাগ জিহ্বাটা একবার বের করল, আরেকবার ভেতরে নিল। ডাহুকদের উদ্দেশ্য করে সে বলল, ‘নতুন এসেছ বুঝি? চারপাশে নানা বিপদ ওত পেতে আছে। সাবধান থেকো।’
ঢোঁড়া সাপের কথা শুনে ডাহুকি কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। ডাহুক তখন তাকে সান্ত¦না দিয়ে বলল, ‘মিছেমিছি ভয় পেয়ো না। ওর কথা তো সত্যি না-ও হতে পারে।’
ঢোঁড়া সাপ তখন নিজের কথার সাফাই গেয়ে বলল, ‘আমার কথাই সত্যি। ডোবার জলে একটা মস্ত শোল মাছ আছে। বড়ো বজ্জাত সে। তাছাড়া পাখিরাজ ফিঙেও মাঝেমধ্যে ডোবার খুঁটিতে এসে বসে। দুজনের কেউ অন্যের ভালো দেখতে পারে না। নিজের মনে করে কথাটা তোমাদের বললাম।’
ঢোঁড়া সাপের এরূপ কথা শুনে ডাহুক মৃদু হাসল। বলল, ‘সকলেই কমবেশি বজ্জাত। তবু নিজ থেকে তুমি আমাদের সাবধান করেছ বলে ধন্যবাদ।’
ডাহুকের কথা না-শোনার ভান করে ঢোঁড়া সাপ হিসহিস করে কী যেন বলল। কিছুই বোঝা গেল না। তারপর বুকের ওপর ভর করে সে চলে গেল।
পরদিন সকালবেলা। ডাহুকেরা বাসা থেকে বেরিয়ে মাথাভাঙা খুঁটিটির ওপর গিয়ে বসল। ভোরের সূর্যটা কেবল উঁকি দিয়েছে। মৃদু বাতাস বইছে। ডাহুকি আপন স্বরে হঠাৎ গান গেয়ে ওঠল। ওর গান শুনেই কি না কে জানে। শোল মাছটি ভুস করে পানির ওপর একবার ভেসে ওঠল। শোল মাছকে দেখে ডাহুকি তার গান থামাল। ডাহুক তখন নিজ থেকেই বলল, ‘তুমিই বুঝি সেই শোল মাছ? সেদিন ঢোঁড়া সাপ যার কথা বলে আমাদের সাবধান করে গেল।’
জবাবে শোল মাছ বলল, ‘শুনেছই যখন তাহলে আর এখানে বসে আছো কেন? অন্যত্র চলে গেলেই তো পারো।’
ডাহুকি প্রশ্ন করল, ‘তুমি আমাদের চলে যেতে বলছ কেন ভাই? আমরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি।’
‘ক্ষতি করোনি এ কথা অবশ্য ঠিক। আমি জানি, তোমাদের প্রিয় খাবার মাছ। তাই তোমাদের বিশ্বাস নেই। যেকোনো সময় হয়তো আমাকে ছুঁ মারতে পারো।’ বলল শোল মাছ।
ওর এরূপ কথা শুনে ডাহুক প্রতিবাদ করে ওঠল। ‘না। তোমার কথা আমরা মানতে পারছি না। কারণ নিতান্ত খিদে না-লাগলে আমরা কখনো মাছ শিকার করি না। আর শিকার করলেও একটি কী দুটি করি। বেশি শিকার করি না। তাও আবার ছোটো ছোটো মাছ। এই যেমনÑমলা, ডেলা ও দারকিনা এইসব।’
শোল মাছ বলল, ‘নিজের মনে করে তোমাদের একটা ভালো পরামর্শ দিলাম। তোমরা নিলে না। আবারও বলছি জায়গাটা আসলেই নিরাপদ নয়। এখানে ফিঙে, ঢোঁড়া সাপ এবং মানুষ ছাড়াও আরও অনেক শত্রুর নিত্য আনাগোনা।’
শোল মাছের কথার পর ডাহুকি বলল, ‘আগাম সাবধান করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার কথা আমাদের মনে থাকবে।’
সেদিনই ফিঙের বাসা থেকে একটি ছোটো ছানা খেলা করতে করতে হঠাৎ নিচে পড়ে গেল। ছানাটির নাম লুই। ফিঙের বাসাটি ছিল ডোবার এক কোণে, একটি মেহগনি গাছের আগায়। ছানাটি পড়তে পড়তে এসে ডোবার শ্যাওলার ওপর পড়ল।
অমনি তাকে ধরার জন্য পানির নিচ থেকে শোল মাছ আর ঝোপের ভেতর থেকে ঢোঁড়া সাপ ব্যস্ত হয়ে ছুটে এল। ছানাটির কাছাকাছি এসে শোল মাছ বলল, ‘আমি এটাকে আগে দেখেছি। তাই এটা আমার শিকার। আমি এটাকে খাব।’
ঢোঁড়া সাপ বলল, ‘না। আমি আগে দেখেছি। এটা আমার শিকার। তাই আমিই এটাকে খাব।’
ডাহুকেরা নিজেদের বাসায় থেকে শোল মাছ আর ঢোঁড়া সাপের কথা কাটাকাটি সবই শুনল। পরে তারা আর দেরি করল না। উড়ে এসে ফিঙেছানা লুইকে শ্যাওলার ওপর থেকে তুলে নিল। নিয়ে একেবারে ফিঙের বাসায় পৌঁছে দিলো।
ফিঙেরা সে সময় বাসায় ছিল না। দূরে কোথাও হয়তো খাবার খুঁজতে গিয়েছিল। ফিরে এসে নিজের বাসায় ডাহুক পরিবারকে দেখে ফিঙের মনমেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘এখনো তোমরা বিদায় হওনি? দু-দিন তো সেই কবেই পার হলো। তারপরও বসে আছো কেন? আর কতদিন তোমরা এখানে থাকতে চাও?’
ফিঙের কথা শুনে ডাহুকের মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলÑআমরা ওর ছানাকে বাঁচিয়ে দিলাম। কোথায় সে আমাদের পুরস্কার দেবে। ধন্যবাদ দেবে। তা নয়। বরং তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। জগৎ বড়োই আজব জায়গা!
পরে ডাহুকি শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমরা আজই চলে যাব পাখিরাজ। অনেকদূরে কোথাও চলে যাব। কথা দিচ্ছি কাল থেকে আপনি আর আমাদের দেখতে পাবেন না।’
ডাহুকও বলল, ‘হ্যাঁ ডাহুকি। দেরি করো না। চলো আমরা এখুনি এখান থেকে চলে যাই।’
ডাহুকদের কথাবার্তা নিচ থেকে উঠে আসা ফিঙেছানা লুই সবই শুনল। পরে সে বলল, ‘বলো কী তোমরা! চলে যাবে কেন? তোমরা না-থাকলে যে এতক্ষণে আমি শোল মাছ আর ঢোঁড়া সাপের পেটে চলে যেতাম। তোমরা আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছ। কাজেই তোমরা যেতে পারো না। কোত্থাও যেতে পারো না তোমরা।’
ছানা লুইয়ের কথা শুনে ফিঙে এবার নিজের ভুল বুঝতে পারল। পরে সে মুখে একটু কাচুমাচু ভাব এনে বলল, ‘ডাহুক পরিবার! তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। শোল মাছ আর ঢোঁড়া সাপ সেদিন তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কাছে অনেক নালিশ করল। তাই আমি তোমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেছিলাম। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও। আমার ছানাকে বাঁচিয়েছ বলে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। আমি তোমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তোমরা চলে যেও না। তোমাদের যতদিন ইচ্ছে হয়, এই ডোবায় বসবাস করো। আমি তোমাদের কিছুই বলব না। আমি তোমাদের ছায়ার মতো আগলে রাখব।’
ডাহুকেরা তখন সমস্বরে বলল, ‘পাখিরাজ! আপনি অনেক দয়ালু। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি যখন এত করে বলছেনÑআপনার কথা কি আমরা ফেলতে পারি? আপনার কথা ফেললে যে আমাদের অন্যায় হবে। আমরা অন্যায় করতে চাই না পাখিরাজ।’
সেই থেকে ডাহুকেরা নিশ্চিন্ত মনে এঁদো ডোবায় বসবাস করতে থাকে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে তারা আপনমনে কোয়াক কোয়াক গান করে। ইচ্ছেমতো ওড়াউড়ি করে। আর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। তাদের এমন আনন্দ দেখে শোল মাছ আর ঢোঁড়া সাপ সারাক্ষণ শুধু হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরে।