নজরুলের কাব্যে মানবতাবাদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জানুয়ারি ২০২২, ৪:২৮:১৫ অপরাহ্ন

বেলাল আহমদ চৌধুরী
কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় মানবতাবাদ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আগে মানবতাবাদ কী- এ বিষয়টি জানতে হলে প্রথমেই হাদিসের কথায় বলতে হয়, মানবতা হলো, যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়। সেই মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর, যার মধ্যে মানবতা বোধ নেই, সে মানুষ নামের অযোগ্য। যে মানুষকে ভালবাসে এবং মানবতার কল্যাণ কামনা করে সেই মানবতাবাদী। তাছাড়া আরও বলা যায় মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ, লাঞ্ছিত-নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কল্যাণকামী দর্শনই হচ্ছে মানবতাবাদী দর্শন অর্থাৎ মানব জাতির কল্যাণকামী চিন্তা, চেতনাকেই বলা হয় মানবতাবাদী।
জাতীয় কবির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যায় যে, তিনি মানুষের কবি, শিল্পী, সংগ্রামী ও সাধক। তিনি লাঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কবি। তাঁর সাহিত্য অঙ্গনে মানবতার জয়গান শুনা যায়। কবি শুধু সত্য ও সুন্দরের সেবক- সত্য মুক্ত স্বাধীন। যার কোন সীমা নেই। কবির সমগ্র রচনাবলীর মূল সুরই ছিল বিশ্বভ্রাতৃত্ব, প্রেম ও মানবতা। তাঁর হৃদয়বৃত্তির মাধুর্য আলোর মতো একটি শক্তি, মানবতাবাদী চিন্তা চেতনা তথা দর্শন। মানুষ মানুষ হিসাবেই সম্মানই মানবতার এই সম্মান নির্বিশেষ- পার্থক্যহীন। মানুষ মানুষে নেই কোনরূপ তারতম্য। মহাকবি চন্ডিদাশ বলেন, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। সব মানুষই আদম ও বিবি হাওয়া (আ.) এর বংশধর।
কবি নজরুলের সাথে এই উপমহাদেশে নিদারুণভাবে দানা বেঁধে উঠে মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে, ভাষা, স্বদেশিকা, আঞ্চলিকা, ধর্মে ধর্মে অনক্য আর বিবেদ বিদ্বেষ। এসব অবস্থা নজরুলকে বিচলিত করে তোলে। নজরুলের মতে এহেন অবস্থা অনাকাক্সিক্ষত। মুসলমান-হিন্দু, বাঙালি অবাঙালি, অভিজাত অপজাত ধনী-গরীব প্রভু-ভৃত্য বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে মানবজাতির অখন্ডতাকে অস্বীকার করা অমার্জনীয় অপরাধ।
তাইত মানব ঐক্যের কবি নজরুল তাঁর ‘সাম্যবাদ কাব্যে’ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন- গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
সেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান।
নজরুলের চিন্তায় ও চেতনায় ধর্মের কথাই বলি আর দর্শনের কথাই বলি। যাই বলি না কেন সর্বত্র মানুষকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় আনতে হবে। সমাজের সব মানুষই সমান মর্যাদা ও অধিকার পাওয়ার যোগ্য। তাই নজরুলের উদাত্ত আহ্বান মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে মানুষের মর্যাদায়, গ্রহণ করতে হবে আশরাফুল মখলুকাত হিসাবে। এক্ষেত্রে এক আল্লাহ জিন্দাবাদ কবিতায় মানবতার পূজারী কবি নজরুলের বলিষ্ঠ উচ্চারণ:ুুু
ভেদ বিভেদের কথা বলে যারা, তারা শয়তানের চেলা /আর বেশি দিন নাই শেষ হয়ে এসেছে তাদের খেলা।
নজরুল আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী কবি। তিনি যখন জাতিতে জাতিতে, এক সম্প্রদায়ের সাথে আরেক সম্প্রদায়ের, এক ধর্মাবলম্বির সাথে আরেক ধর্মাবলম্বির এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের হানা-হানি প্রত্যক্ষ করে বিচলিত হয়ে পড়েন। কারণ, তিনি সব সময় প্রত্যাশা করতেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তাঁর এই প্রত্যাশার বহিপ্রকাশ পাওয়া যায় পুতুলের বিয়ে কবিতায়:
মোরা এক বৃন্তে দু’টি ফুল হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তার প্রাণ।
এই কাব্যে বাঙালি ও দুই সহোদর হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃত্বের গৌরবদীপ্ত ঐক্যের কথাই ফুটে উঠেছে। কবি নজরুলের মানবতাবাদী চিন্তাতে শুধুমাত্র ব্যক্তি মানুষের মনিষা সংরক্ষণে সচেষ্ট ছিল তা কিন্তু নয় বরং বলা চলে তিনি ছিলেন সমাজ, রাষ্ট্র তথা একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকারের উদ্দীপ্ত কবি। খাটি মুসলমান হিসাবে তাঁর ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধকে আন্তরিকতার সাথে লালন করেছেন। এক কথা সত্য কিন্তু তাই বলে ধর্মানূতার থুপকাষ্টে তার মানবীয় সত্তাকে বলি দেননি। তিনি আপাদমস্তক ছিলেন অসম্প্রদায়িক, যে কারণে ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধে তথা মুসলমান হিন্দুর মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাকল্পে ‘কান্ডারী হুশিয়ার কবিতায় বলিষ্ট কন্ঠে বলেন-
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,/কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃ মুক্তিপণ।/‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী। বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।
শ্রমজীবি মানুষের প্রতি নজরুলের ছিল অগাধ ভালবাসা আর অফুরান দরদ। শ্রমিকের গানে কবি বলেন;
ও ভাই দালান-বাড়ি আমরা গড়ে/রইনু জনম ধূলায় পড়ে/বেড়ায় ধনী মোদের ঘাড়ে চড়ে রে।/আমরা চিনির বলদ চিনি নে স্বাদ/চিনি বওয়াই সার কেবল/ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল।
কবিকে দেখা যায় হৃদয়হীন অকৃতজ্ঞ, তথাকথিত অভিজাত শ্রেণীর মানুষের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণে-
প্রার্থনা কর যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মানুষের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।
কবি নারীজাতির মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। নারীরা কেবলই নারী নন। কবি বলেন- সেদিন সুদূরে নয়/ যেদিন ধরনী পুরুষের সাথে গাইবে নারীরও জয়। কবি পুরুষ শাষিত সমাজে নারীর প্রতি অত্যাচার নিপীড়ন পরাধীনতার চক্রান্ত থেকে নিজেদের মুক্ত করে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে ‘আলেয়া’ কবিতায় নারীদের প্রতি আহ্বান করেন-
‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা/জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত টীকা।/ধু ধু জ্বলে উঠ ধূমায়িত অগ্নি/জাগো মাতা কন্যা বধূ জায়া ভগ্নি/পতিতোদ্বারিণী স্বর্গ স্থলিতা/জাহ্নবী সমবেগে জাগো পদ-দলিতা।
কবি নারীকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে ‘নারী’ কবিতায় বলেন-
সাম্যের গান গাই-/আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই/বিশ্বে যা কিছু মহান, সৃষ্টি চির কল্যাণ কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নজরুল লাঞ্চিত, নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত সর্বহারা শোষকের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে-ই এটাও ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস তাই; কবি তাঁর ‘ফরিয়াদ’ কবিতায় এই বিশ্বাসের দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছেন-
‘ঐক্য দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহিকো আর।/মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে ‘মার মার’।
রক্ত যা ছিল করেছে শোষণ/নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ’/শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান,-/জয়-নিপীড়িত জনগণ জয়। জয় নব উত্থান।
নজরুল সর্বহারাদের জয়েই কেবল তুষ্ট ছিলেন না বরং যতদিন সর্বহারা বিজয়ের মাধ্যমে তামাম মানবতার বিজয় না হবে ততদিন তিনি থাকবেন সর্বহারাদের নৃত্যসঙ্গী হয়ে। কবির এহেন তেজোদীপ্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়।
মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপান ভীম রণভূমে রণিবে না-/বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত।
বর্তমান বিশ্বে মানব পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে কুলষিত, শুভ বুদ্ধির অবলুপ্ত হয়ে মানুষ আজ লিপ্ত হয়েছে পারস্পারিক শত্রুতা ও হিংসা বিদ্বেষ। বিশ্বমানব বিভ্রান্তিকর সন্দেহে সন্দিহান। এ শত্রুতা ও হিংসা বিদ্বেষ ভুলে সকলকে আজ উদ্বুদ্ধ হতে হবে বিশ্বমানবতার কল্যাণের পথে। মহাকবি চন্ডিদাশ বলেন, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। কবি এই জয়গান মানবতাবাদী দর্শনেরই জয়গান। বিদ্রোহী কবি নজরুলের কন্ঠে ‘মানুষ’ কবিতায় সেই জয়গান ধ্বনি হয়েছে।
গাহি সাম্যের গান-/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদাভেদ ধর্ম জাতি,/সবদেশে, সবকালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
পরিশেষে বলতে চাই- বর্ণিল ও বাঁধন হারা জীবন ছিল কাজী নজরুলের। তাঁর কর্ম ও জীবন সাহিত্যের মানবতাবাদ পরিস্ফুটিত হয়েছে। কবি মধ্যে মানুষের প্রতি তথা মানবতার প্রতি তাঁর মমত্ব ও সম্মান বোধের সর্বশ্রেষ্ঠ উপমা বিদ্যমান। কবি তাঁর হৃদয়ের আখরে মানব জাতির ঐক্যের জয়গান করে মানবতার পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এই জন্য কবি নজরুল মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনন্য। সেই হেতু কবি নজরুল বিশ্বমানবতার কবি।