হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসা
নতুন এমপিওভুক্ত আলিম স্তরে অধ্যক্ষের নিয়োগ বাণিজ্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৪:০৩:১৫ অপরাহ্ন

- # নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক এক সাথে দুই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত
নূর আহমদ::
মাছুম আহমদ, সহকারী শিক্ষক আইসিটি। এই পদে প্রায় ৮ বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন সুনামগঞ্জের ছাতকের বুরাইয়া কামিল মাদরাসায়। এই ব্যক্তি চলতি বছরের জুলাই মাসে এমপিওভুক্ত হওয়া সিলেট সদর উপজেলার হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসায় আরবি প্রভাষক হিসেবে পূর্ব থেকে কর্মরত রয়েছেন মর্মে পদ ভাগিয়ে নিয়েছেন। অথচ একদিনও এই মাদরাসায় তার পদচিহ্ন পড়েনি। অন্যদিকে, মাদরাসাটি নন এমপিও থাকা অবস্থায় মাওলানা কবির আহমদ নামের অপর এক শিক্ষক আরবি প্রভাষক পদে কর্মরত ছিলেন। এ শিক্ষকের ভাষ্য, এমপিওভুক্ত হওয়ার পর তাকে বাদ দিয়ে মাছুম আহমদকে আরবি প্রভাষক দেখানো হয়েছে। তার অভিযোগ, মাদরাসার অধ্যক্ষ বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এই অনিয়ম করেছেন।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাছুম আহমদ দুই জায়গায় জনতা ব্যাংকে একাউন্ট খুলেছেন। বুরাইয়া মাদরাসার সহকারী শিক্ষক হিসেবে জনতা ব্যাংক ছাতক শাখায় রয়েছে তার একটি একাউন্ট। আবার হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে একই ব্যাংকের সিলেটের জালালাবাদ শাখায় রয়েছে অপর একটি একাউন্ট। বেতন (স্যালারি) একাউন্ট হিসেবে যথারীতি কার্যকর রয়েছে দুই একাউন্টেই। নতুন কর্মস্থল থেকে বেতন না তুললেও কাগজপত্রে তিনি এখন দুই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক। মাওলানা কবির আহমদের অভিযোগ, এই অনিয়ম-দুর্নীতির মূলে মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজ আহমদ। যিনি আসল কাগজপত্র গায়েব করে জাল কাগজপত্র তৈরি করে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। বঞ্চিত করেছেন তাকে। সন্তান-সন্ততি নিয়ে চরম অর্থকষ্টে রয়েছেন বলে জানান তিনি।
সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়নের মোবারকপুর (মৌলভীরগাঁও) গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা কবির আহমদ ২০১৪ সালে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসার আরবি প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া অভিযোগপত্রে মাওলানা কবির আহমদ উল্লেখ করেন, নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি নিয়মিত মাদরাসায় যেতেন। কিছু দিন পর আর্থিক সংকট দেখিয়ে অধ্যক্ষ বেতন ভাতা আপাতত দেয়া যাবে না জানিয়ে মাঝে মাঝে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কবির আহমদ অধ্যক্ষের কথামতো মাদারাসার হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে যেতেন। এমনকি ২০১৮ সালে মাদরাসার আরবি প্রভাষক হিসেবে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন কবির আহমদ। যার কাগজপত্র তার কাছে রয়েছে। যখন অধ্যক্ষ ডাকতেন তিনি হাজির হতেন। যদিও তার সকল কাগজপত্র মাদরাসায় রক্ষিত নেই বলে অস্বীকার করছেন অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজ আহমদ।
অন্যদিকে, চলতি বছরের ৬ জুলাই হাউসা ফুরকানিয়া মাদরাসার আলিম স্তর এমপিওভুক্ত হওয়ার পর মাওলানা কবির আহমদ জানতে পারেন, তার স্থলে অন্য একজনের নাম পাঠানো হয়েছে মাদরাসা অধিদপ্তরে। সেই ব্যক্তি হচ্ছেন মাসুম আহমদ। যিনি বুরাইয়া কামিল মাদরাসায় আইসিটি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এবং তিনি ইনডেক্সধারী শিক্ষক। মাওলানা কবির আহমদ অভিযোগ করেন, তার কাগজপত্র গায়েব করে বড় অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মাসুম আহমদ পূর্ব থেকে মাদরাসায় কর্মরত দেখিয়ে অধিদপ্তরে কাগজপত্র প্রেরণ করেন। এমনকি মাসুম এখন কাগজপত্রে হাউসা ফুরকানিয়া আলিম মাদরাসার এমপিওভুক্ত শিক্ষক। মাসুম আহমদ এখনো বুরাইয়া কামিল মাদরাসায় এমপিওভুক্ত আইসিটি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সালাম। তিনি জানান, চার মাস আগে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেছেন। আসার পর থেকে মাসুমকেই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দেখছেন। গত মাসেও মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে বেতনাদি তুলেছেন। বুরাইয়া মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ফারুকী বলেন, বেশ কয়েক বছর থেকে মাসুম আহমদ তাদেরই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন।
মাসুম আহমদ দাবি করেন তিনি হাউসা ফুরকানিয়া মাদরাসা ননএমপিওভুক্ত থাকাকালে কোন দিনই কাজ করেননি। কখনো শিক্ষার্থীদের ক্লাসও নেননি। প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে তিনি দাবি করেন। হাউসা ফুরকানিয়া মাদরাসার আরবি প্রভাষক হিসেবে জনতা ব্যাংক জালালাবাদ শাখায় একাউন্ট খোলা, ব্যাংক থেকে বেতন উত্তোলনকারী শিক্ষকদের তালিকায় জুলাই ও আগস্ট মাসে নাম কিভাবে এলো এ প্রশ্নের জবাবে মাসুম আহমদ বলেন, আমি এই একাউন্ট থেকে কোন টাকা উত্তোলন করিনি। যা করেছেন মাদরাসার অধ্যক্ষ আজিজ আহমদ। মাসুম শুধু বুরাইয়া মাদরাসা থেকে বেতন উত্তোলনের কথা স্বীকার করেন।
সিলেট সদর উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা মো: গোলাম রব্বানী জানান, হাউসা ফুরকানিয়া মাদরাসা এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া তার মাধ্যমেই হয়েছে। আলিম শ্রেণিতে পাঠদানের অনুমতি পাওয়ার পর থেকে যারা কর্মরত ছিলেন; তারাই এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এমপিওভুক্তির জন্য যেসব প্রক্রিয়া অবলম্বন ও কাগজপত্র প্রদর্শন করা প্রয়োজন অধ্যক্ষ সব করেছেন। অধ্যক্ষ যদি তথ্য গোপন করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাউকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন, তবে এর জবাবদিহিতা তাকেই করতে হবে।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে হাউসা ফুরকানিয়া ইরফানিয়া আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজ আহমদ মাদরাসায় আলিম ক্লাস শুরুর পর অভিযোগকারী মাওলানা কবির আহমদ ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন মর্মে স্বীকার করেন। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ননএমপিওভুক্ত থাকাকালে তিনি কর্মরত ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি স্বীকার করেন, ওই শিক্ষক সপ্তাহে ২/৩ দিন আসতেন। ওই সময়ে মাদরাসা অধিদপ্তরে কর্মরত শিক্ষকের তালিকায় মাওলানা কবির আহমদের নামও পাঠিয়েছিলেন। তবে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাওলানা কবির আহমদকে ম্যানেজিং কমিটি রেজুলেশনের মাধ্যমে আরবি প্রভাষক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। তবে, অব্যাহতি দেয়া প্রসঙ্গে মাওলানা কবির আহমদ জানান, তিনি ঘুণাক্ষরেই এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। অধ্যক্ষ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে অব্যাহতি দেয়ার নাটক সাজিয়েছেন। হয়তো ভুয়া কাগজপত্র তৈরিও করতে পারেন বলে তার ধারণা।
অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজ আহমদ আরো জানান, ২০১৫ সালে আলিম শ্রেণির পাঠদানের অনুমতি পাওয়ার পর আরবি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন জানিয়ে মাসুম আহমদের নাম তিনি মাদরাসা অধিদপ্তরে পাঠান। ২০১৯ সাল পর্যন্ত যেখানে মাওলানা কবির আহমদ মাদরাসার শিক্ষকতায় সম্পৃক্ত ছিলেন; তখন মাসুম অন্য প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। সেই মাসুম আহমদের নাম কিভাবে মাদরাসা অধিদপ্তরে পাঠালেন জানতে চাইলে অধ্যক্ষ কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এছাড়া ২০২২ সালের জুলাই মাসে আলিম শ্রেণি এমপিওভুক্ত হওয়ার পরও যিনি একদিনের জন্যও মাদরাসায় উপস্থিত ছিলেন না, তাকে শুধু কর্মরত শিক্ষক নয়, তাকে এমপিওভুক্ত আরবি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেতে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে দিলেন কিভাবে জানতে চাইলে তিনি জানান, মাসুম আহমদ তাকে বিভ্রান্ত করেছে। তিনি জানান, মাদরাসার সুপার হিসেবে তিনি এবং সহ-সুপার মাওলানা আবু তোরাব মো: জসিম উদ্দিন এর স্তর পরিবর্তন করে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ হিসেবে পদায়নের জন্য দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মাসুম আহমদকে কেবল বাইরে থেকে আনা হয়েছিলো, তাকে পদত্যাগপত্র দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকার পরিদর্শক (সিলেট বিভাগ) ড. মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, খুব সম্ভব অধ্যক্ষ কারসাজি করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভুল তথ্য দিয়েছেন। একজন শিক্ষক এক সাথে দুই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারেন না। তিনি ভুক্তভোগীকে মহাপরিচালক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান।