নতুন স্বপ্ন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ২:২২:০৩ অপরাহ্ন

পরিতোষ ঘোষ চৌধুরী
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রীলে দুটি হাত রেখে, রাস্তার দিকে চেয়ে মেয়েটি অনবরত কাঁদছে। তার সামনে আজ যেন সমস্ত অন্ধকার যতটুকু চোখ যায়, শুধু অন্ধকার, আর অন্ধকার কোথাও আলোর দেখা মিলছে না। পৃথিবী কাঁপছে মেঘ উড়ছে- বাতাস বইছে- নদীর স্রোত নৌকা চলছে- করোনা ঝড়ে যেন মেয়েটির জীবন ওলট পালট করে দিচ্ছে। এ ঝড় থামবে কবে।
আজ সকালেই কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে বিভাগীয় হাসপাতালে আইসোলেশনে ভর্তি হয়েছে মেয়েটি। গরীব ঘরের মেয়ে। বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন ঘরে। দু’জনই ডায়াবেটিস রোগী, প্রায় বিছানায়। তাদের একমাত্র উপার্জনশীল মেয়ে সুচনা। বাবার পেনশনের টাকা আর নিজে টিউশনি করে সংসার চালায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশুনা করে। সুচনা দেখতে মন্দ নয়, শ্যামবর্ণ, ডানচোখটা একটু টেরা- সবাই থাকে লক্ষèী টেরা বলে।
করোনার কারণে লক ডাউনের সময়ও বাজার করা, ঔষধ কেনা সুচনাকেই করতে হয়। একদিন হাসপাতালে নিকট আত্মীয় এক রোগীকে দেখতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হবে- সেকি জানতো সুচনা?
পুরুষ ইউনিট থেকে একটি ছেলে আস্তে আস্তে হেঁটে সুচনার থেকে অন্তত পাঁচ হাত দূরে এসে দাঁড়ালো- ছেলেটিকে দেখে সুচনা কান্না থামালো- চোখের জল মোছলো- যখন বুঝলো ছেলেটি কিছু বলতে চায়- তখন সুচনা নিজ ইউনিটে চলে যায়। ছেলেটির নাম শুভ, পুরা নাম শুভেন্দু কুমার শুভ। একই শহরে দু’জনের বাস- অথচ কেউ কাউকে চেনে না। শুভ নিম্ন মধ্যবিত্তের সন্তান। নারায়ণগঞ্জ গার্মেন্সে চাকুরি করে। লকডাউনের প্রথম দিকে নারায়ণগঞ্জেই থাকে- যখন দেখলো লকডাউনের মেয়াদ বাড়ছে- তাছাড়া বাংলাদেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তখন মা-বাবা, ভাই বোন জন্ম শহরের টানে লুকিয়ে বাড়িতে এসে নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়। যেদিন সুচনা করোনা পজেটিভ হয়ে আইসোলেশনে আসে- সেদিন শুভও আসে। দু’জন আছে দুই ইউনিটে মহিলা ইউনিট নিচ তলায় পুরুষ ইউনিট দু’তলায়। শুভ অনেকটা আনন্দে আছে- সে করোনাকে পাত্তা দিতে রাজি না। ডাক্তার নার্সদের সাথে আনন্দ করে দিন কাটায়। শুভ সুচনা যেদিন আসে সেদিন আরও কয়েকজন রোগী আসে। সবমিলিয়ে রোগী আছে নিচে ৭ জন উপরে ৮ জন। হাসপাতালে এ দু’জন বাদে সব রোগীই ৬০ বছরের উপরে। দু’তিনদিন পর সুচনার মোবাইলে ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে- মোবাইলের চার্জও যায় যায়। হাসপাতালে আসার সময় চার্জারও আনে নাই তাই মহিলা ইউনিটে রোগীদের নিকট চার্জার না পেয়ে উপরের ইউনিটের ডাক্তার বা নার্সের নিকট চার্জার পায় কিনা দেখতে যেই উপরে উঠছিল তখনই শুভর সাথে দেখা।
সুচনার অস্থিরতা দেখে শুভ বলে, ‘এনি প্রবলেম?’ সুচনা বলে আমার মোবাইলে ব্যালেন্সও নেই চার্জও নেই। এই মুহূর্তে আমার বাবা-মা যদি ফোন করে না পান- তাহলে উনারা চিন্তা করবেন- তাই ছোট পিনের চার্জার খোঁজছিলাম।’
শুভ বলে, আমার কাছে চার্জার আছে নিতে পারবেন। বেশি প্রয়োজন হলে আমার মোবাইল দিয়ে আপনার বাবা-মার সাথে আলাপ করতে পারেন- নিন আমার মোবাইল নিয়ে আপনি বাসায় আলাপ করুন- আমি বেড থেকে চার্জার নিয়ে আসছি। সুচনা ইতস্ততঃ করে শুভর মোবাইল দিয়ে তার মা-বাবার সাথে আলাপ করে। শুভ চার্জার এনে দিলে সুচনা চার্জার হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসে।
প্রথম পর্বে মোবাইল ও চার্জার দেওয়া নেওয়াকেই কেন্দ্র করেই আইসোলেসনে থাকা দুই যুবক যুবতীর মধ্যে অনুরাগ-পূর্বরাগ হয়ে প্রেমের সম্পর্কে রূপ পায়। মোবাইলের নাম্বার দেওয়া নেওয়া মোবাইলে কল দেওয়া- ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো। চ্যাট করা- ভিডিও কলে আলাপ করে অল্প দিনেই খুব কাছাকাছি চলে আসে দু’জন। হাসপাতালের ডাক্তার নার্সরা কিছুটা টের পায়। এমনিতে ডাক্তার সেবিকাগণ রোগীদের আনন্দ দিয়ে থাকেন। রোগী যাতে মানসিক কষ্ট না পায় তার জন্য রোগীদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে। রোগীদের বিভিন্ন ফলসহ উন্নতমানের খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাদের দু’টি রিপোর্টই করোনা নেগেটিভ আসায় প্রেমিক প্রেমিকা জুটি নতুন করে স্বপ্ন দেখছে।
একদিন ডাক্তারদের ফাঁকি দিয়ে শুভ নিচ তলায় এসে সুচনাকে ইশারায় ডাকে। সুচনা বারান্দায় এসে গ্রীলে হাত রেখে দুরত্ব বজায় রেখে গল্পে মেতে উঠে। এক পর্যায়ে শুভ বলে, ‘একটা গান গাও না- আজ আমাদের আনন্দের দিন’। সুচনা বলে, ‘গান করবো কিন্তু তোমাকেও আমার সঙ্গে গাইতে হবে কিন্তু?’
-আচ্ছা ঠিক আছে
‘আয় তবে সহচরি হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবে গিরিগিরি গাইবে গান………’
এমন সময় হঠাৎ করেই আকাশে মেঘ জমে- অন্ধকার হয়ে আসে- ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকালো- বৈশাখি ঝড় শুরু হলে কারেন্ট চলে যায়।
সুচনা বলছে, ‘আমার ভয় হচ্ছে, চলো ইউনিটে ফিরে যাই।
শুভ- ভয় নয়, ভয়কে জয় করতে হবে। আমার হাত ধরো সুচনা।
সুচনা- কেউ দেখে ফেলবে যে।
শুভ- না, আশে পাশে কেউ নেই। শুধু তুমি আর আমি।
শুভ হাত বাড়িয়ে দিলে, সুচনা হাত ধরে বলে ‘ইস! কি নরম তোমার হাত, না জানি তোমার মনটা কত নরম।’
এমন সময় বেরসিক বয়স্ক সেবিকা এসে ধমক দিয়ে বলে, আপনাদের নামে আমি কমপ্লেন করবো। বারবার আপনাদের বারন করা সত্ত্বেও আপনারা হাসপাতালের নিয়ম কানুন মানছেন না। সুস্থ হয়ে বাসায় গিয়ে প্রেম করুন- এখানে নয়।’
শুভ- সুচনা দু’জনেই সরি বলে মাথা নিচু করে নিজ নিজ ইউনিটে চলে যায়।
চল্লিশ দিন আইসোলেশনে থেকে অবশেষে করোনা জয়ী হয়ে প্রেমিক জুটি মুক্তি পায়। ডাক্তার সেবিকাগণ তাদের হাতে ফুলের ডালি সাজিয়ে বিদায় দেন।
তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উভয় পরিবারের সম্মতি নিয়ে গোধূলী লগ্নে বিয়ে হয়। শুভ বিয়েতে কোন যৌতুক দাবি করে নাই। বৌভাতে কোন ভোজের আয়োজন না করে পাড়ার একশত গরিব পরিবারকে চাল-ডাল-তেল তরকারি বিতরণ করে।