নিশি রাতে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ৫:২৩:৫৯ অপরাহ্ন

সুলতান মাহমুদ
কিসের যেনো খসখসানির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কান খাড়া করে শব্দটা বুঝার চেষ্টা করলাম।
অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ। শুকনো মরা পাতার উপর দিয়ে কেউ হেটে গেলে যেমন মচমচ শব্দ হয়। সতর্কতার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বললে যেমন, শব্দ হয়, ঠিক সেইরকম শব্দ। তীক্ষè তীক্ষè কন্ঠে গোঙ্গানীর শব্দ। ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। বিছানায় উঠে বসলাম। জঙ্গলের এই নির্জন এলাকার এ বাড়িতে আমি সম্পূর্ণ একা। আমার বাসাটি উঁচু টিলার উপর। অনেকটা উচু এ টিলাটি। টিন সেডের হাফ বিল্ডিং একটি ঘরে আমি থাকি। তিন রুমের এ বাড়িতে কোন প্রাচীর নেই। এ টিলার নিচে কিছু দূরে কিছু বাড়ি ঘর আছে। উপজাতিরা সেখানে বসবাস করে। ভয়ঙ্কর কোন জীব জানোয়ার এখানে নেই। সন্ত্রাসী ডাকাতির মতো ঘটনাও এখানে কখনো ঘটেনি। আমি সহায় সম্বলহীন একজন মানুষ। ছোট খাটো একটা এনজিও তে ছোট একটি পদে এখানে কর্মরত। আমার শত্রু বলে এখানে কেউ নেই। বারো তের বছর যাবত এখানে আছি। কোন প্রকার বাসা ভাড়া দিতে হয় না। শুধু মাত্র কারেন্ট বিল দিয়ে ফ্রি বাসায় থাকছি। এখন রাত কত হবে? বাইরে যে শব্দ হচ্ছে সেটা ভয়ংকর কিছু হতে পারে। সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থা হচ্ছে বিপদজনক কিছু হলে গলা ফাটায়ে চিৎকার করলেও কারও কোনো সাহায্য এখানে পাবো না। কান পেতে ভাল করে শুনার চেষ্টা করলাম। খসখসানির শব্দ, ফিসফিসিয়ে কথা বলার শব্দ, গোঙ্গানীর শব্দ। শব্দগুলো থামছে না। এখন আমি কি করব বুঝতে পারছি না। কথা বলতে সাহস পাচ্ছি না। লাইট জ্বালাতে সাহস পাচ্ছি না। আমি কী চরম বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। ফোন করা যায় আমার কলিগদের কাছে অন্তত: যারা আমার কিছুটা কাছাকাছি আছে। তার আগে আসল বিষয়টা নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে আসলে ব্যাপারটা কি।
বিছানা থেকে উঠলাম। দরজা জানালা বন্ধ। জানালায় কান পেতে শুনার চেষ্টা করলাম। একই রকম শব্দ। জংলী কোন জীব জানোয়ার হলে কোন সমস্যা নেই। দরজা জানালা ভেঙ্গে তো আর ভিতরে ঢুকতে পারবে না। বাইরে দাপাদাপি করে এক সময় ওরা চলে যাবে। কিন্তু ওরা যদি মানুষ বা অন্য কোন কিছু মানে ভূঁত পেত্নি হয়, যদিও আমি ভূত পেত্নি বিশ্বাস করিনা। তবে আজকে আমার ভীষণ ভয় করছে। এ মুহুূর্তে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমার কলিগের এক আত্মীয় রাতের বেলা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একা একা যাচ্ছিল। তখন রাত বেশি না মাত্র সন্ধ্যা রাত। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। তরতাজা যুবক। মনে অদম্য সাহস। খুশি মনে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। সে লোকাল। রাস্তা ঘাট সব কিছু তার নখদর্পণে। মনে ভয় ডর কিছুই ছিল না। থাকবেই বা কেন ভয়, ডরের মত কোন কান্ড এখানে কখনো ঘটেনি। পাহাড়ি উচু নিচু পথ। কখনো ঝোপ জঙ্গল আবার কখনো সমতল ভূমি। দু’পায়ের মেঠো পথ। জোৎস্নার আলোয় স্পষ্টই সবকিছু দেখা যায়। সে একটা বড় সড় ঝোপের কাছে এলো। ঘটনা ঠিক তখনই ঘটলো। জংলী ঝোপ ঝাড়। তার কাছে মনে হল ঝোপের ভিতর থেকে কেমন জানি একটা গোঙ্গানীর শব্দ হলো।
সে থমকে দাঁড়াল। সে জানে এ জঙ্গলে প্রচুর শিয়াল কুকুর আছে। বেজি সাপ আছে। তবে সাবধানে চললে এগুলো কোন ভয়ের কারণ হতে পারে না। তার পরেও গোঙ্গানীর ধরনে তার মনে কিছুটা আতংকের সৃষ্টি হলো। ঝোপ ঝাড়ের গাছগুলো অসম্ববভাবে নড়ে চড়ে উঠতে লাগলো। মনে হচ্ছে ঝোপের ভিতরে অসম্ভব এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তার মনে যেমন ভয় ডর কাজ করছিল, তেমনি আবার মনে একটু কৌতুহল জাগলো ব্যাপারটা কী? সে একটু থমকে দাঁড়াল। ঠিক তখনই ঘটলো বিপদটা। আচমকা ঝোপের ভিতর থেকে কুচকুচে কালো মত বিভৎস এক ভয়ংকর জানোয়ার বের হয়ে এলো। জীবটির দেহের গঠনটা শুয়োরের মত। কিন্তু মাথাটা শুয়োরের মত নয়। হিংস্র চোখ থেকে অদ্ভুত এক ধরনের নীলাভ আলো বের হচ্ছে। শুয়োরের চেয়ে আকারে কিছুটা বড়ই হবে। ভয়ে আতংকে যুবক ছেলেটির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সে দিশাকুল হারা হয়ে দৌড়াতে শুরু করলো। ভয়ংকর প্রাণীটিও তাকে তাড়া করে ছুটলো। যুবক ছুটছে জানের ভয়ে ভয়ংকর জীবটি ছুটছে শিকার ধরার নেশায়। যুবকটি দৌড়াতে আর বুঝতে পারছে দৌড়ে সে প্রাণীটির সাথে পেরে উঠবে না। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সে ভয়ংকর প্রাণীটির সুস্বাদু খাদ্য হয়ে যাবে।
জান বাঁচানোর জন্যে সে তাৎক্ষণিক এক উপায় বের করে ফেলল। যুবকটি লাফ দিয়ে এক গাছের ডালে ঝুলে বাঁদরের মত তিরিং বিরিং করে গাছের আগায় উঠে গেল। ভয়ংকর প্রাণীটির শিকার হাত ছাড়া হওয়াতে ভীষণভাবে ক্ষেপে গেল। প্রাণীটি গাছের নিচে রাগে গোস্বায় অনেক লম্ফ ঝম্ফ দিতে লাগল। এমন কি গাছে উঠার নিষ্ফল চেষ্টাও করলো। অবশেষে সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে রাগে গরগর শব্দ করতে করতে চলে গেল। যুবকটি বাকী রাত আর গাছ থেকে নামেনি। সকাল বেলায় সে গাছ থেকে নেমে বাড়ি চলে যায়। জীবনে আর কখন রাতের বেলায় কোথাও বের হয়নি।
যাক এবার আমার নিজের ক্ষেত্রে ফিরে আসি। আমার মনে হয় এ রকম কোন প্রাণীই এ রকম গুণ্ডামি করছে আমার বাসার কাছে এসে। আমি ভয় ডর কিছুটা কাটিয়ে জানালার পাল্লা সামান্য একটু খুলে দেখার চেষ্টা করলাম। বাহিরে জ্যোৎস্না রাত। যা ধারণা করছিলাম ঠিক তাই। তিনটি কালো কুতকুতে শুয়োরের মত দেখতে ভীষণ হিংস্র মনে হচ্ছে। সাদা খরগোশ জাতীয় কিছু হবে এদেরকে নিষ্ঠুরভাবে ভক্ষণ করে চলেছে।
আমার শংকা অনেকটা কেটে গেল। আমি সাহস করে তিন ব্যাটারির একটা টর্চ লাইটের আলো জানালার পাল্লা সামান্য খুলে ওদের উপর ফেললাম। ভেবে ছিলাম ভয় পেয়ে ওরা এমনিতেই চলে যাবে। কিন্তু না। ভয় তো ওরা পেলোই না। ওল্টা ওরা আমার উপর ক্ষেপে গেল। লাইটের আলোয় যা দেখলাম তাতে ভয়ে ডরে আমার সেন্স হারানোর অবস্থা। সে কি ভয়ংকর প্রাণী যা আমি জীবনে সিনেমা নাটকে কোথাও দেখিনি। এদের সমস্ত মুখ লাল টকটকে। শরীরটা কালো লোমে ঢাকা। মুহূর্তের মধ্যে তাদের হাতের থাবা দিয়ে আমার টর্চ লাইট ফেলে দিল। আমি চিৎকার করে জানালার পাল্লা থেকে ঘরের মেঝেয় ছিটকে পড়লাম। তার পর সেন্স হারালাম।