নিয়াতের প্রয়োজনীয়তা ও বিশুদ্ধতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৭:৪৭:৩৮ অপরাহ্ন

মুন্সি আব্দুল কাদির
নিয়াত তথা সংকল্প বা ইচ্ছা, অভিপ্রায় ইবাদাতের মূল। নিয়াত শব্দটি ইখলাসের সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। নিয়াত ইবাদাতের প্রাণ। নিয়াত ছাড়া কোন ইবাদাত আর ইবাদাত থাকে না। কোরআনুল কারীমে হুবহু নিয়াত শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কোরআনুল কারীমে ইখলাস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, একান্ত নিষ্ঠাবান (মুখলিস) হয়ে আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত কর। জেনে রেখ একনিষ্ঠ (ইখলাস যুক্ত) ইবাদাত আল্লাহ তায়ালার জন্যই।- সুরা জুমার। আল্লাহ তায়ালা আরোও বলেন, এদের এ ছাড়া আর কোন কিছুরই আদেশ দেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহ তায়ালার জন্য নিজেদের দ্বীন ও ইবাদাত নিবেদিত (খালেস) করে নেবে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে। সুরা বাইয়েনাহ। হাদিসে নিয়াত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইমাম বুখারী (রাহ.) বুখারী শরীফের প্রথমে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে নিয়াত সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সকল কাজ নিয়াতের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়াত অনুযায়ী প্রতিফল লাভ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য হিজরত করে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্যই গণ্য হবে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বার্থে কিংবা কোন নারীকে বিয়ে করার মানসে হিজরত করে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে যে জন্য সে হিজরত করেছে।
নিয়াতের জন্য ইখলাস প্রয়োজন আবার ইখলাসের জন্য সহিহ নিয়াত প্রয়োজন। ইসলামে প্রত্যেকটি কাজই ইবাদাত। হোক সেটা ফরজ, হোক ওয়াজিব, হোক সুন্নাত, চাই নফল হোক, চাই মুস্তাহাব হোক। কাজটি করার পূর্বে নিয়াত করা জরুরি। কোন কাজ করার পূর্বে সবরে হোক কিংবা নিরবে হোক কাজটি করার সংকল্প বা অভিপ্রায় ব্যক্ত করার নামই নিয়াত। নিয়াতের স্থান হল অন্তর। নিয়াত নিজেও একটি ইবাদাত। নামাজের পূর্বে পবিত্রতা অর্জন, অযু যেমন স্বতন্ত্র ইবাদাত তেমনি ইবাদাতের পূর্বে নিয়াতও একটি ইবাদাত। ইবাদাতের সৌন্দর্য অনেকাংশে নিয়াতের উপর নির্ভরশীল। যার নিয়াত যত বিশুদ্ধ তার ইবাদাত তত সুন্দর।
বিশুদ্ধ নিয়াতের জন্য চারটি গুন থাকা প্রয়োজন:
১- নিয়াতকারীকে মুসলিম হতে হবে ।
২- নিয়াতকারীকে সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে।
৩- যে কাজ বা ইবাদাতের জন্য নিয়াত করছে সেই কাজ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা চাই।
৪- যে কাজ বা ইবাদাত করতে চায় তা করার সুন্নাত নিয়ম এবং উদ্দেশ্য জানা থাকা চাই।
বিশুদ্ধ নিয়াতের জন্য মানুষ সওয়াবের ভাগীদার হয়ে যায়। শরীয়াহ সম্মত কোন কারণে কাজটি করতে না পারলেও সে নিয়তের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয় না। কাজটি করতে পারলে কাজের সওয়াব পায়। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে বলেন, আমার বান্দা কোন গুনাহের কাজ করার নিয়ত করলে তা না করা পর্যন্ত তার জন্য কোন গুনাহ লিপিবদ্ধ করো না। তবে সে যদি গুনাহের কাজটি করে ফেলে, তাহলে কাজটির অনুপাতে তার গুনাহ লিখ। আর যদি আমার কারণে তা পরিত্যাগ করে তাহলে তার জন্য একটি নেকী লিপিবদ্ধ করো। সে যদি কোন নেকীর কাজ করার জন্য ইচ্ছা বা নিয়াত করে কিন্তু এখনও তা করেনি তাহলে তার জন্য একটি নেকী লিপিবদ্ধ করো। আর যদি কাজটি সে করে তাহলে তার জন্য দশগুণ থেকে (আন্তরিকতা অনুপাতে) সাতশ গুণ পর্যন্ত নেকী লিপিবদ্ধ করো। (সহীহ বুখারী)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, বলুন প্রত্যেকেই আপন স্বভাব অনুসারে কর্ম সম্পাদন করে থাকে।- সূরা বনি ইসরাইল- ৮৪। এখানে আপন স্বভাব অর্থ নিয়াত অনুযায়ী। মানুষ তার পরিবারের জন্য সাওয়াব লাভের নিয়াতে যা খরচ করে, তা সদাক্বাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এখন মক্কা হতে হিজরাত নেই, কিন্তু জিহাদ ও নিয়াত অবশিষ্ট রয়েছে। আবু মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন , রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ তার পরিবারের জন্য সওয়াবের নিয়াতে যখন খরচ করে তখন তা হয় তার সদকা স্বরূপ (বুখারী)।
সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) কে বলেন, তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যা-ই খরচ কর না কেন, তোমাকে তার সওয়াব অবশ্যই দেওয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও, তারও।- বুখারী।
কোন শাইখ বলেন, আমার মন চায়, কিছু ফকিহ তাদের অন্যান্য ব্যস্ততা ছেড়ে দিয়ে মানুষদেরকে শুধু তাদের আমলের মাকাসিদ ও উদ্দেশ্য সমূহ শিক্ষা দেওয়ার কাজ করুক এবং লোকদেরকে তাদের আমলের নিয়তের বিশুদ্ধতা শিক্ষা দেওয়ার কাজে বসে যাক। কারণ অন্তরের আমলের প্রতি অজ্ঞতার কারণে, অন্তরের আমলের হালাত না জানার কারণে অনেক মানুষই ইবাদাত করেও ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে যায়। এমনকি দ্বীনি ইলমের ধারক বাহকগণ ইলম অর্জন ও বিতরণের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়াত না করে তবে তার জন্যও কঠিন শাস্তির হুশিয়ারী রয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ইলম দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়। এমন ইলম কেউ যদি শুধু দুনিয়ার স্বার্থে হাসিলের জন্য শিক্ষা করে, সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। – আবু দাউদ।
নিয়াত বিশুদ্ধ না হলে ইবাদাতে রিয়া বা লোক দেখানো ভাব স্থান করে নেয়, মন বিক্ষিপ্ত থাকে, ইবাদাতে মন বসে না। ইবাদাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা অনেকাংশে নিয়াতের উপর নির্ভর করে। নিয়াত নিয়ে আয়েম্মায়ে কেরাম অনেক আলোচনা করেছেন, আমরা মহানদের কিছু উক্তি উল্লেখ কবর।:
ইয়াহইয়া ইবনে কাছির (রাহ.) বলেন, তোমরা নিয়াতকে বিশুদ্ধ করতে শিখ। কেননা এর প্রভাব আমলের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক (রাহ.) বলেন, অনেক ছোট আমল নিয়াতের কারণে মহান কাজে পরিণত হয়।
মুতাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহ.) বলেন, অন্তর পরিশুদ্ধ হয় সঠিক আমলের মাধ্যমে । আর আমল পরিশুদ্ধ হয় বিশুদ্ধ নিয়াতের মাধ্যমে।
সুফইয়ান সাওরী (রাহ.) বলেন, আমাকে নিয়াতের চেয়ে কঠিন কোন কাজে অনুশীলন করতে হয় নি। কারণ আমার নিয়ত বার বার বিগড়ে যায়।
ইমাম নববী রাহঃ বলেন, অধিকাংশ সময় স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেওয়া হয়, আমোদ ফুর্তির মানসে। প্রবৃত্তির চাহিদা সেখানে স্পষ্ট থাকে। তবে সে যদি নিয়াত ঠিক করে নেয় আল্লাহর মেহেরবানীতে সে সওয়াব পাবে।
জুবাইদ (রাহ.) বলেন, প্রতিটি কাজে আমি নিয়াত করতে পছন্দ করি। এমনকি পানাহারেও।
ইকরামা (রা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা নিয়াতের কারণে যে সওয়াব দান করেন, যা আমলের কারণেও দেন না। কারণ নিয়াতের মাঝে কোন লৌকিকতা থাকে না। নিয়াত কাউকে দেখানো যায় না।
ইয়াহইয়া ইবনে জাওজী (রাহ.) বলেন, মুমিন সাধারণত আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইবাদাত করে। কিন্তু কখনো ইবাদাতে গোপন রিয়ার (লৌকিকতার) অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে তার নিয়াত এলোমেলো হয়ে যায়। আর রিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া বড়ই কঠিন কাজ।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম (রাহ.) বলেন, অন্তরের আমলই মূল। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমল অন্তরের অনুগামী শাখা প্রশাখা ও পূর্ণাঙ্গ রূপ। নিয়াত হল রূহের মত। আর আমল হল দেহের মত। রূহ ছাড়া দেহ মৃত। তাই অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমলের আহকামের চেয়ে অন্তরের আমলের আহকাম সম্পর্কে জানা বেশি জরুরি।
হ্যাঁ আমরা নিয়াত নিয়ে কথা বলি, আলোচনা করি। কিন্তু নিয়াত বিশুদ্ধ আর খাটি করার জন্য আমাদের কোন মেহনত নেই। নিয়াত বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি, পন্থা জানার আমাদের কোন চেষ্টা নেই। অথচ প্রতিদিন নামাজে নিয়াত করছি, অযুতে নিয়াত করছি, অন্যান্য ইবাদাতে নিয়াত করছি। সেই নিয়াতকে কতটুকু মানে নিতে পারছি , তা নিয়ে সামান্য ভেবে দেখারও সময় নেই। আসুন ইবাদাতের পিছনে যেভাবে মেহনত করছি, সময় দিচ্ছি। ইবাদাতের নিয়াত, ইখলাস, বিশুদ্ধতার চিন্তায় সময় দেই। নিজেকে পরিশুদ্ধ করি। পরকালীন মুক্তির পথ তালাশ করি।