নৌকা চলে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২১, ৩:৫৫:২৫ অপরাহ্ন

মাসুম মাহমুদ
বাড়ির উঠানে রাইয়ান বাবার সঙ্গে হাঁটছে। প্রতি শুক্রবার বিকেলে ওরা এ রকম হাঁটে আর কিছু একটা বিষয় নিয়ে অভিনয় অভিনয় খেলে। মাঝে মাঝে রাইয়ানের মা আর বোনও এসে যোগ দেয় ওদের সঙ্গে। স্কুলে গতকাল ময়ূরপঙ্খি নৌকার গল্প শুনেছে রাইয়ান। সেই থেকে ওর মাথায় নৌকা ঘুরঘুর করছে।
বাবাকে বলে, ‘আমায় একটা ময়ূরপঙ্খি নৌকা কিনে দেবে বাবা? ওই নৌকায় করে আমি বিলে শাপলা তুলতে যাব।’
‘ময়ূরপঙ্খি তো রাজা-বাদশাদের নৌকা বেটা।’
‘আমরাও রাজা-বাদশা। আমি রাজপুত্র আর আপনি তার পিতা, মহারাজ।’
‘শোনো হে রাজপুত্র আমার, যে নৌকাটি আবদার করলে; তার সামনে থাকে কাঠ ও খোলা দিয়ে তৈরি পেখম তোলা ময়ূর, পেছনে কুমির। তাই ময়ূরপঙ্খি নাম। ময়ূরপঙ্খি চালাতে দরকার চারজন মাঝি। এত মাঝি কোথায় পাবে আমার রাজপুত্র?’
‘আমি রাজপুত্র মাঝি হব। আপনি মহারাজ হবেন মাঝিদের সর্দার। রাজপুত্রের ময়ূরপঙ্খি চালাতে এই প্রাসাদের রানিও লগি ধরবেন। আর আমাদের রাজকন্যা! একমাত্র ছোট ভাইয়ের ময়ূরপঙ্খি না চললে সে কি বসে থাকবে? আপনিই বলুন, মহারাজ?’
‘প্রিয় রাজপুত্র, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু আমাদের রানি এমনিই নৌকায় উঠতে ভয় পান। রাজকন্যা আর তুমি এখনো সাঁতার শিখে ওঠনি। সাঁতার না জানলে মাঝি হওয়া যায় না। আমি তবে একা কী করে ভাসাব ওই ময়ূরপঙ্খি?
‘এখন তাহলে কী উপায়, মহারাজ?’
‘উপায় ডিঙি নৌকা। আকারে ছোট, তাই একজন মাঝি চালাতে পারে।’
‘ডিঙি নৌকা কোথায় পাব, মহারাজ? ওটা দেখতেই বা কেমন?’
‘ডিঙি বাংলাদেশের সবচেয়ে চেনা নৌকা। নদীতীরে বা হাওর-বাঁওড়ে যে মানুষজনরা থাকে, নদী পার হতে; হাট-বাজারে যেতে তারা ওই নৌকা ব্যবহার করে।’
‘আপনার মনে আছে, মহারাজ? সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে একটি নৌকা দেখেছিলাম। সামনের দিক উঁচু আর বাঁকানো। পেছনটা সোজা।’
‘হ্যাঁ, সাম্পান। সমুদ্রের উঁচু উঁচু ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু সাম্পান দিয়ে তুমি কী করবে প্রিয় রাজপুত্র? ওই নৌকায় তো বাণিজ্যের মালপত্র টানা হয়।’
‘মহারাজকে সাম্পানে বসিয়ে বাণিজ্যে যাব। সাম্পান ভরে রোদ আর বৃষ্টি নিয়ে ফিরব।’
‘প্রিয় পুত্র, রোদ আর বৃষ্টি হলো গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছের মতো। যার আছে তার কোনো অভাব নেই।’
(রাইয়ানের বোনের প্রবেশ)
‘মহারাজ, বজরা নৌকায় করে কোথাও বেড়াতে যেতে চাই। আপনি জানেন অনেক অনেক দিন আগে ধনী লোকেরা শখ করে নৌকাভ্রমণে যেত। তাদের খুব পছন্দের ছিল বজরা নৌকা। বজরায় তারা ঘরবাড়িও বানিয়ে নিত। আপনি তো মনের দিক থেকেও অনেক ধনী। কেন তবে আমরা বজরায় করে ভ্রমণে যাই না?’
‘নিশ্চয় আমরাও একদিন যাব প্রিয় রাজকন্যা। তার আগে রাজপ্রাসাদের প্রধান কাজ এখন বাইচের খেলার আয়োজন করার। সে জন্য দরকার অনেক বাইচের নৌকা।’
‘বাইচের নৌকা! সেটা কেমন, মহারাজ?’
‘যে নৌকা দিয়ে বাইচের খেলা হয় ওটাই বাইচের নৌকা। একসময় নবাব-বাদশাহরা খুব সুন্দর বাইচের আয়োজন করত। তারা বাইচের নৌকার সুন্দর সুন্দর নামও দিত। পঙ্খিরাজ, ঝড়ের পাখি, দ্বীপরাজ, সোনারতরী এসব। এই নৌকা লম্বায় অনেক বড় হয়। যারা নৌকাবাইচে প্রতিযোগিতা করত, তাদের অনেক রকমের হাঁকডাক ছিল। আরো জোরে হেঁইও/ মারো টান হেঁইও/ আগে চলো হেঁইও/ জিতা যামু হেঁইও। নদীর দুই পারে দাঁড়িয়ে মানুষজন খেলা দেখত। হাঁকডাক শুনে অনেক মজা পেত তারা।’
‘আপনি বুঝি বাইচের নৌকা অনেক পছন্দ করেন, মহারাজ?’
‘প্রিয় রাজকন্যা, আমার সবচেয়ে পছন্দ মাছধরা নৌকা। ছোটবেলায় ঘাটে দাঁড়িয়ে মাছধরা নৌকা থেকে জেলেদের মাছ নামানো দেখতাম। আহা! কী মধুর ছিল সেই সব দিন।’
(রাইয়ানের মায়ের প্রবেশ)
‘প্রিয় রাজপুত্র-রাজকন্যা, জেনে আনন্দিত হবে আমাদের মহারাজ চমৎকার গান গায়। পরের বর্ষায় যখন আমরা তোমাদের দাদার বাড়ি যাব, একসঙ্গে নৌকায় ঘুরব! বিলে শাপলা তুলব! মাছ ধরব, ঘুরতে ঘুরতে আমাদের নৌকা যখন দিক হারিয়ে ফেলবে, মহারাজ গলা ছেড়ে গাইবে। আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে। মহারাজের গানের সুর আবার আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে।’
‘পরের বর্ষায় যে নৌকাটিতে করে আমরা দাদাবাড়ির নদীতে বেড়াতে যাব তার কী নাম, রানি?’
‘গয়না।’
‘গয়না! খুব সুন্দর নাম। কিন্তু এই নামটাই কেন?’
‘শুনেছি অনেক অনেক বছর আগে ওখানকার রাজা তাদের স্ত্রী-কন্যাদের সোনার গয়না না দিয়ে সেই পয়সায় গরিব-দুঃখী মানুষকে এক ধরনের নৌকা বানিয়ে দিত। তারা যেন নিরাপদে চলাচল করতে পারে তাই। সে জন্য সেই অঞ্চলের মানুষেরা খুশি হয়ে ওই নৌকার নাম দিয়েছিল গয়না।’
তখনই রাইয়ান ওর ভাঙা সাইকেলের বেল বাজায়- ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। রাইয়ানের বোন সাবিলা হাততালি বাজিয়ে বলে, ‘এখন দশ মিনিটের বিরতি। ফিরে এলে দেখবে কোষা, সাম্পান, বালাম, পটোল, ঘাসি, বজরা, পানসি, ছইওয়ালা, সাপুড়িয়া নৌকা। আগেই বলে রাখি। সাপুড়িয়া নৌকায় থাকে সাপুড়েরা। আর তাদের কাছে থাকে সাপ! থাকবে না আবার! তারা তো সাপেরই খেলা দেখায়। কী! ভয় পেলে? ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই, ওই সাপ কামড়ায় না।