পতাকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ৩:২২:৪৭ অপরাহ্ন

জামান মাহবুব
হেমন্তের শীত শীত সন্ধ্যায় রাসেলের মনে ফুরফুরে আনন্দ। এখন দেশের নানা স্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের সংবাদ আসছে। ভাবতে ভালো লাগে, রাসেল আর ছোট্টটি নেই। সে এখন দেশমাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে অগ্রসৈনিক। তার অদম্য সাহস আর বীরত্বব্যঞ্জক অপারেশন প্রশংসা কুড়োচ্ছে শিবিরে শিবিরে। মুক্তিবাহিনীর ইউনিট কমান্ডার ইশতিয়াক আহমদ কিশোর রাসেলের মাথায় হাত রেখে তেজোদীপ্ত কন্ঠে বললেন, ‘চিন্তা নেই, আমরা বিজয়ী হবোই।’ রাসেল মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে উদ্দীপ্ত স্বরে স্লোগান দিল, ‘জয় বাংলা’। সাথে সাথে শিবিরে শিবিরে প্রতিধ্বনি উঠল, ‘জয় বাংলা’।
ইউনিট কমান্ডার রাসেলকে পরম স্নেহে কাছে টেনে বললেন, ‘তোমার মতো চৌদ্দ বছর বয়সের কিশোর মুক্তিযুদ্ধে বীরের মতো লড়ছে, এটি অনুপ্রেরণাদায়ক। এ যুদ্ধে আমাদের বিজয় অনিবার্য।’ আবেগ-আপ্লুত রাসেল পদমর্যাদা ভুলে ইউনিট কমান্ডারের স্নেহের আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলল, ‘স্যার, দোয়া করবেন, স্বাধীন বাংলাদেশে মায়ের বুকে ঠাঁই নিয়ে এমনি স্নেহের পরশ যেন পাই!’ ইউনিট কমান্ডারের চোখে অশ্রুবিন্দু চিক্চিক করে উঠল। রাসেলের মতো তিনিও জানেন না, তাঁর পরিবারের সবাই বেঁচে আছেন কিনা!’
একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে হানাদার বাহিনী যখন হত্যা, আগুন আর ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠল, তখন পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী বাবা বললেন, ‘বুঝলে রাসেলের মা, অখন্ড পাকিস্তানকে বুঝি আর টিকিয়ে রাখা গেল না! পাঞ্জাবিরা যে কখনোই বাঙালিকে ভাইয়ের মর্যাদা দেয়নি, আজ রাতের সেনাবাহিনীর অপারেশন তারই প্রমাণ।’ দুদিন পর পাকিস্তানি বাহিনী বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। ঠিক সাতদিন পর নদীর ধারে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। পচে-গলে লাশের অবস্থা এমন যে চেনার উপায় নেই। মাথায় লম্বা একটা কাটা দাগ ছিল, ওটা দেখেই লাশ সনাক্ত করা গেছে। বাবার দাফন শেষে মা রাসেলের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ‘আর ঘরে বসে থাকার উপায় নেই বাবা। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দাও। এ দেশকে খানসেনা মুক্ত করতেই হবে। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।’
সে রাতেই রাসেল কজন বন্ধুর সাথে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে। বয়স কম, সুতরাং মুক্তিবাহিনীতে প্রথমটা রাসেলের ঠাঁই হয়নি। কিন্তু তার দৃঢ় মনোবল, তীব্র আকাক্সক্ষা এবং কাকুতি মিনতিতে কমান্ডার ইশতিয়াকের মন টলল। তিনি মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করলেন রাসেলকে। মাস ছয়েকের ট্রেনিং-এ রাসেল তার অসামান্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করে দৃষ্টি কাড়ল সবার। কয়েকটি দুঃসাহসী অভিযানে যোগ দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল রাসেল। অভিষিক্ত হলো ‘ক্ষুদে টাইগার’ অভিধায়। ক্রমে খানসেনাদের কাছে রাসেল হয়ে উঠল মূর্তিমান আতঙ্ক! কমান্ডার ইশতিয়াক বললেন, ‘সতর্ক থাকবে রাসেল। বেঘোরে প্রাণ দিলে হবে না। দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে তোমাকে টিকে থাকতে হবে।’
ততদিনে মরণ কামড় দিতে শুরু করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিবাহিনীর সাথে যেসব স্থানে তারা পেরে উঠছে না, সেসব এলাকা ত্যাগ করার আগে হায়েনারা বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। রাসেলের চোখমুখ পাথরের মতো শক্ত আর কঠিন হয়ে উঠল। কমান্ডারকে বলল, ‘স্যার, সামনের চ্যালেঞ্জিং অপারেশনে আমাকে অগ্রবর্তী দলের নেতা করে দিন।’ কমান্ডার ইশতিয়াক আহমদ বললেন, ‘সাবাশ! এই তো চাই। তোমার ওপর আমি ভরসা রাখি।’
রাত গভীর। চারদিকে ঘুট্ঘুটে অন্ধকার। কোথাও জনমানব, পশু-পক্ষীর চিহ্নমাত্র নেই। ওরা অসমসাহসী ছয়জন মুক্তিসেনা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। মুক্তিসেনা ধারেকাছেও নেই, সেই বিশ্বাসে ক্যাম্পে বসেছে মদ, জুয়া আর গানবাজনার আসর। বাইরে পাহারায় রাজাকার বাচ্চু সর্দার, আনু শেখ ও সুরুজ আলী। ওদের ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে ভাসছে মদিরা, মনে অতৃপ্ত বাসনা। ঠিক সেই মুহূর্তে রাসেলের রাইফেলের তাক করা নিশানায় প্রথম গুলিতেই বাচ্চু সর্দার খতম! এরপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ওরা এগোতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকিস্তানি সেনারা। মদের নেশায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে রাইফেল হাতে নেওয়ার আগেই প্রাণ হারালো জনাপাঁচেক। অন্যেরা ছুটে পালালো অন্ধকারে। উল্লসিত রাসেল স্লোগান দিল, ‘জয় বাংলা’। সহযোদ্ধারা রাইফেল উঁচিয়ে মিলিত কন্ঠে আওয়াজ তুলল, ‘জয় বাংলা’।
এরই মধ্যে খানিকটা দূরের ক্যাম্প থেকে খানসেনাদের অপর একটি দল এগিয়ে এল গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে। রাসেলরা প্রাণপণে গুলিবর্ষণের প্রত্যুত্তর দিয়ে পিছু হটল। হঠাৎ একটা গুলি এসে বিঁধল রাসেলের ডান পায়ে। প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল রাসেল। সঙ্গীরা দ্রুত তাকে সরিয়ে ফেলল ঘন বনের আড়ালে। খানসেনারা এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে যখন আর কোনো সাড়া পেল না, তখন মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে গেছে ভেবে তারা নিজেদের আহত-নিহত সৈন্যদেরকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাসেলকে নিয়ে গোপনপথে সহযোদ্ধারা ফিরে গেল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে।
ফিল্ড হাসপাতালে অপারেশন করে রাসেলের পা থেকে গুলি বের করা হলো। দিন কয়েক পর যখন সে ছাড়া পেল তখন মুক্তিবাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী একেবারেই নাস্তানাবুদ। রাসেলের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। কমান্ডারকে বলে, ‘স্যার, মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমি কি কোনো অপারেশনেই যেতে পারব না?’ ব্যথিত কন্ঠে ইশতিয়াক আহমদ বললেন, ‘তোমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের ফসল আজকের এই সাফল্য। ভেবো না, শারীরিকভাবে না থাকলেও রণাঙ্গনের প্রতিটি যোদ্ধার হৃদয়ে অনুপ্রেরণা হয়ে আছ তুমি, তোমরা।’
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করল। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটল দখলদার বাহিনীর নৃশংস বর্বরতার। রাসেল বাড়িতে ফেরার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল। মা আর বোন বিগত নমাস কী দুঃসহ অবস্থায় ছিলেন , রাসেল জানে না। শুধু অন্তরের গভীরে অনুভব করে, মা আর বোন বেঁচে আছেন, ভালো আছেন।
বাড়ি ফিরল রাসেল। উশকোখুশকো লম্বা চুল। ডান হাতে ক্রাচ। ইউনিট কমান্ডার ইশতিয়াক আহমদ ওর সঙ্গেই এলেন। কিন্তু বাড়ি কোথায়? গোটা বাড়িই তো আগুনে পোড়া, ধ্বংসস্তূপ! রাসেল শূন্য ভিটেয় দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠে, ‘মা, রেনু– তোমরা কোথায়?’
প্রতিবেশিরা ভিড় করে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। সবার চোখ ছলছল। একজন প্রবীণ ব্যক্তি ইশারায় উঠোনের একপাশে দুটো কবর দেখিয়ে বললেন, ‘ওরা ওই যে ওখানে!” রাসেল হঠাৎ চমকে উঠল, ‘মানে?’ সালামত চাচা ওর কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হুহু কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘তুমি মুক্তিযোদ্ধা, মাখন রাজাকারের কাছে এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা তোমার বাড়িঘর শুধু পুড়িয়েই দেয়নি, তোমার মা ও বোনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে!’
রাসেল চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। কমান্ডার ইশতিয়াক আহমদ তাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলেন না। কিছুক্ষণ পর রাসেল নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল। দেখল, বাড়িতে পত্পত্ করে উড়ছে মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের পতাকা। এই পতাকা ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা। এই পতাকার জন্যেই তো রাসেলরা নয়মাস অস্ত্রহাতে লড়াই করেছে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। রাসেল স্পষ্ট দেখল, পতাকায় জ্বলজ্বল করছে তার শহীদ পিতা-মাতা ও বোনের হাস্যময় মুখ।
রাসেল ক্রাচে ভর দিয়ে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে স্যালুট করল পতাকাটিকে। চারদিকে ধ্বনিত হলো ‘জয়বাংলা!’