পাঠ্যানুভূতি : তারাশঙ্কর প্লেনের নিচে ঝাঁপ দিল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ৬:১৬:১০ অপরাহ্ন

মোয়াজ আফসার
হারান কান্তি সেনকে রম্য লেখক হিসেবেই পরিচিতি এনে দিয়েছে তার দুই যুগেরও বেশি সময় রম্য লেখার দীর্ঘ পথ চলা। এ পথে কখনো কলম তার থামেনি। আড্ডায় চলার পথে কাজের সূত্রে বিভিন্ন চরিত্র-ঘটনা যখনই তার চোখে ধরা পড়েছে সেগুলোকে কুড়িয়ে তুলে এর সাথে মনের মাধুরী মিশিয়ে কলমের লাঙল দিয়ে চাষ করেছেন ধন ধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরার মতো। রম্য রচনা লিখতে লিখতে হারান নিজের মধ্যেই ধারণ করে নিয়েছেন রম্য এক চরিত্র। গল্পগুজবে বক্তৃতায় কিংবা সাধারণ আলাপচারীতায়ও তার সে রম্য ঢংয়ের দেখা মেলে। যন্ত্রের এ যুগে হৃদয় পিষে রোবটের মতো হয়ে ওঠে মানুষের আচরণ। কাজ কাজ আর কাজ। হারান আমেরিকার মিশিগানে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। সাথে রয়েছেন স্ত্রী পম্পা দত্ত. একমাত্র ছেলে পিদিম সেন তোজো, দুই মেয়ে শতাব্দী সেন পৌষি আর শাঁওলী সেন পিউ। কাজ করেন একটি মোটর পার্টস তৈরির ফ্যাক্টরিতে। সত্যি সত্যি রোবটের সাথে তাকে কাজ করতে হয় প্রতিনিয়ত। কাজে ফাঁকি দেয়া কিংবা কাজ ফেলে অন্য কোন কাজে হাত দেয়া যেখানে একেবারেই অসম্ভব। এরপরেও মাথায় যখনই যা আসে নোট করে রাখেন কাগজের বুকে। কাগজ কলম সাথেই রাখেন সবসময়। তিনি নিজেও সন্দিহান ছিলেন এমন পরিবেশে কাজ করে তারপর লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারবেন কি না। কিন্তু রোবটের সাথে থাকলেও তার কোমল হৃদয় তিল পরিমাণও সেই রোবটিক্স জ্বরে আক্রান্ত হয়নি।
আমাদের যে হারান ওই হারানই রয়েছেন, রোবটের কাছে হারাননি তিনি। কাজ শেষে গভীর রাতে ঘরে ফিরেও তিনি চর্চা করেন সাহিত্য। টিভি দেখেন, দেশে ফোনে কথা বলেন, আবার লেখেনও। এইসব করতে করতে যখন রাত ভোরের দিকে গড়ায় তখোন যান বিছানায়। সবসময় আন্তরিক যোগাযোগ রাখেন বাংলাদেশের বন্ধু স্বজনের সাথে। হৃদয় পড়ে থাকে এখানে, বন্ধু স্বজনের জন্যে কাঁদেন। হারান তার চতুর্থ গ্রন্থ ‘তারাশঙ্কর প্লেনের নিচে ঝাঁপ দিল’-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যখন বক্তৃতা রাখছিলেন মাইকেই কেঁদে ফেলেন, আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। হৃদয়ের সে আবেগ ঝরে পড়ে আকাশে পুঞ্জিভূত মেঘের বৃষ্টিধারায়। প্রত্যেক বছরই তিনি দেশে আসেন। পৃথিবীর এ দৈন্য পরিস্থিতিতে এবার দেশে আসার সময় ছেলে মেয়েদের মন সায় দেয়নি। তবু তিনি না এসে পারেননি। অসুস্থ মা যে দেশে। তার হৃদয়ে মানুষের প্রতি সাহিত্যের প্রতি অগাধ এক ভালবাসা। এটা সবার হয়না। হৃদয় আছে যার সে-ইতো ভালবাসে।
গেলো একুশ ডিসেম্বর প্রকাশ পেলো ‘তারাশঙ্কর প্লেনের নিচে ঝাঁপ দিল।’ বইটির নামকরণ খুবই চমৎকার। লক্ষণীয় বিষয় নামকরণে ‘ট্রেন’ শব্দটি লিখে ওটার ওপর আবার ক্রস চিহ্ন এঁকে একটি নতুন ট্রেন্ড তৈরি করেছেন লেখক। নামকরণটি দেখে যে কারো মনে কৌতুহল উঁকিঝুঁকি করবে নিঃসন্দেহে। আগুনে পানিতে গাড়ির নিচে কিংবা ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয়া যায়, প্লেনের নিচে ঝাঁপ দেয়াতো মানুষের ‘কম্মো’তে আগে দেখা যায়নি। একটি গ্রন্থ প্রকাশের লক্ষ্য মাথায় নিয়ে তিনি যখন বাংলাদেশের প্লেনে উড়েন তখোন কিন্তু তার মাথায় তারাশঙ্কর ছিলো না। প্লেনের চাকা সিলেটের মাটি স্পর্শ করলে তারাশঙ্কর চরিত্রটি লেখকের মাথায় হুট করেই আসে পাইলটের এক ঘোষণা থেকে। পাইলট বলছিলেন ‘ঢাকা থেকে পুণ্যভূমি সিলেটে আমরা নিরাপদে অবতরণ করেছি; তবে ল্যান্ড করতে গিয়ে আমি রানওয়ের একদম কাছে এলে দেখতে পাই কে একজন আমাদের এয়ারক্রাফটের দিকে দৌড়ে আসছে! আমি তখনই সতর্কতার সাথে আগন্তুককে পাশ কাটিয়ে নিরাপদে ল্যান্ড করি।’ ঘোষণাটি আমার কাছে মনে হয়েছে যাত্রীদের কোহেলিকায় ফেলে পাইলটের একটি গেম খেলার মতো। প্লেনের এতোজন যাত্রীর জীবন নিয়ে অবতরণের মুহূর্তে রানওয়েতে একজন মানুষের উপস্থিতি কতোটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে তা ফুটে ওঠেনি পাইলটের ঘোষণায়। আর প্লেন যখন কোন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়ে সাথে সাথে ককপিট থেকে ঘোষণা আসে যাত্রীদের সতর্ক থাকার বিভিন্ন নির্দেশনা। কেবিন ক্রু নিজ নিজ আসনে বসে পড়ুন, কেউ হাঁটাহাটি করবেন না, টয়লেট ব্যবহার করবেন না, সিট বেল্ট বেঁধে রাখুন, সিটের পেছনের দিক সোজা থাকুন ইত্যাদি। পরিস্থিতি উৎরে গিয়ে ঘোষণা দেয়ার কোন মানে নেই। প্লেন চলাকালীন সময়ে পাইলটের প্রতিটা বার্তা কিন্তু ব্লাকবক্স নামের ডিভাইসে সংরক্ষিত থাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে সময় স্বল্পতায় লেখক তাড়াহুড়ো করে লেখাটা শেষ করেছেন। এর বাইরে লেখক রসবোধের মাধ্যমে তারাশঙ্করকে এক সাহসী এবং সচেতন যুবক রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে ছিল প্রেমে পাগলপারা। ভালবাসার জন্যে সে প্রাণ নিতে পারে হাতের মুঠোয়।
বইটিতে বিশটি লেখা রয়েছে। বেশিরভাগ লেখাই বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে লেখা। বিরানব্বই এবং তিরানব্বই সালে। এই দিক দিয়ে লেখক দুই শতাব্দীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন, আটকে দিয়েছেন একই মোড়কে। তার লেখায় হাস্যরস কৌতুক ইত্যাদির মাধ্যমে খুব নিপুণভাবে সভ্য সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন নানান অনিয়মের বেড়াজাল। ট্রাফিকজ্যাম নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষকে তিনি ষাঁড়ের শিং দিয়ে গুঁতো খাওয়ার ভয় দেখিয়েছেন। টিকিট না কেটে ট্রেনে চড়ার মাশুল গুনার চিত্র তুলে ধরেছেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে স্বামীর ব্যবসা নিয়ে স্ত্রীদের অহেতুক টানাটানি, স্ট্যাটাস রক্ষার বিড়ম্বনা অনেকটা স্নায়ুযুদ্ধের মতো হয়ে ওঠে। তিনি বলতে চেয়েছেন মাছের ব্যবসা করলেই একজন মাছুয়া হয়ে যায় না, সেলুন চালালেই নাপিত বনে যায় না। আরেকজনের আন্তর্জাতিক মানের লন্ড্রি ব্যবসা। তার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেলো ধোপার লেবেল গায়ে জড়িয়ে।
‘ভাইরাল : আছাড় ১৭ বার এবং (!)’ গল্পটা পড়লে হঠাৎ করেই আপনি হেসে ওঠবেন। বদই ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাচ্ছেন লেখক। বৃষ্টির দিন গ্রামের পথ। সিএনজি অটো ছেড়ে তিনি হেঁেট রওয়ানা দিলেন। কর্দমাক্ত পথে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে তিনি এক এক করে আছাড় খেলেন সতেরো বার। কাদায় কাপড় চোপড়ের বেহালত অবস্থা। সবচে’ মজার ব্যাপার হলো বাথরুমে ঢুকে তিনি যখন কাপড় চোপড় ছেড়ে বালতিতে ডুবিয়ে রাখেন তখোনই দরজায় কার যেন ঠোকা পড়ে, বাইরে দাঁড়িয়ে বদই ভাই লেখকের হাতে একটি নতুন লাল পেটিকোট আর ছিকা গেঞ্জি ধরিয়ে দিলেন। বৃষ্টির কারণে বদই ভাইয়ের সব লুঙ্গি ছিলো ভেজা। না পরে লেখকেরও আর উপায় নেই, যদিও পেটিকোট পরতে লেখকের আপত্তি ছিলো না, তবে কটকটে লাল রঙটা সঙ সাজার মতো মনে হয়েছিলো।
বইয়ের প্রত্যেকটি লেখাতেই একটা ম্যাসেজ রাখার চেষ্টা করেছেন লেখক। কটাক্ষ করে বিদ্রুপ করে রঙ ঢঙ করে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজের অনিয়ম অসংগতি তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় একটি স্থানের নাম এবং একজন মানুষের নাম ঘুরেফিরে বারবার এসেছে। দুলিয়ারবন্দ আর পাগলা কানু। দুলিয়ারবন্দ লেখকের জন্মস্থান। আর পাগলা কানু চরিত্রের মুখ দিয়ে সামাজিকভাবে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। পাগলা কানু দুলিয়ারবন্দ গ্রামেরই ছেলে। অত্যন্ত মেধাবী এবং স্বভাবকবি। একটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় পড়ে সে মানসিক অসুস্থ। লোকে তাকে পাগল বলে। কিন্তু লেখক তাকে পাগল বলতে রাজি নন। কারণ সে সবসময় গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াতো এবং কোথাও সমাজের জন্যে ক্ষতিকারক কিছু দেখলেই প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। ‘টেরি বঙ্গাই’র মজাদার বেগুনি’ গল্পে লেখক জানিয়েছেন তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেন রমজান মাসে তাদের শিফটে নিজেদের সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে ইফতার আয়োজন করা হয়। ওই ইফতার ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যে উন্মুক্ত। সবাই একসাথে বসে ইফতার করেন। কোম্পানি ওই সময়টায় কাজ বন্ধ রাখে। এটা একটা আনন্দের বিষয়। লন্ডনে দেখা যায় বাঙ্গালি মুসলমান মালিকদের রেস্টুরেন্টেও ইফতারের সময় রোজাদারদের মুখে পানি দেয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। কালো মানিকের বেগুনি নিয়ে কৌতুহল আর গছেনা চৌধুরীর কাস্টারের বাচ্চা গালিটি বেশ উপভোগ্য।
‘টাকায় নাম লিখা ও পত্রলিখন’ গল্পে টাকার ওপরে যারা লেখালেখি আঁকাআঁকি করেন তাদের খুব ভাল করে নসিহত করেছেন। টাকার ওপর একজনের নাম ঠিকানা পেয়েতো ক্ষুব্ধ হয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠিও লিখেছেন ওই ঠিকানায়, এমনকি বিভিন্ন শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। হারান যে রাগী মানুষ জানলাম তার ‘টিউশনি’ গল্পটি পড়ে। এসএসসি পরীক্ষার পর নিজের অনিচ্ছা সত্বেও বাবার চাপাচাপিতে একটা টিউশনির কাজ নিতে হয়। পড়ুয়া স্কুল ছাত্রছাত্রী চার ভাইবোন। ইচ্ছে ছিলো পরীক্ষা শেষে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেবেন, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াবেন। সে বাসনা ভেস্তে যায়। প্রথম দিন টিউশনিতে রওয়ানা হবেন লেখকের মা সাবধান করে দিয়ে বল্লেন, দেখিস বাবা ছাত্রদের মারধর করিস না। পড়াতে যেয়ে মায়ের কথা রাখতে পারলেন না ছেলে মেয়েগুলোর বইয়ে অরুচি আর দুষ্টামির কারণে। বেত হাতে নিতেই হলো। নিজে বেশি বেশি সময় দিয়ে বেত চালিয়ে-বুঝিয়ে পড়ালেন ভাল রেজাল্টের জন্যে, কিন্তু বছর শেষে সবাই খুব করুণভাবে ফেল করে। ভাল করে না পড়ানোর অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। শেষে ছাত্রছাত্রীদের পিতা যখন স্কচটেপ মারা পুরাতন এক শত টাকার একটা নোট লেখকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন আর পড়াতে হবে না। তিনি খুব কষ্ট পেলেন, অপমানিত বোধ করলেন। এ অপমান বয়ে নেয়া বড় কঠিন, কঠিনেরে কাঁধে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটলেন। লেখকের এ প্রস্থান ব্যথিত করলেও পাঠক হৃদয়ে তিনি কিন্তু একটা দাগ এঁকে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
হারান তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তার লেখাগুলো সাজিয়েছেন। কোথাও কোথাও গ্রাম্য মাটিমাখা কিছু কথা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, শহরে যা একেবারেই অপরিচিত। বিভিন্ন চরিত্রের ব্যঙ্গার্থক নামগুলোও বেশ হাস্য রসাত্মক। আসলে এই নামগুলোর মাধ্যমেও লেখক সমাজের ঘুণে ধরা ক্ষতে আঘাত করার চেষ্টা করেছেন। সমাজের এতোসব নেতিবাচকতার মধ্যেও লেখক আশাবাদীÑদেখিস, একদিন আমরাও! বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে লেখক প্রত্যেকটি ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন আর তাতে রূপ রস ও গন্ধ মিশিয়ে নিজস্ব একটা ঢংয়ে পাঠকদের দোরগোড়ায় পৌঁছার চেষ্টা করেছেন। বইটি পাঠক সমাদৃত হবে বলে আশা রাখি।
তারাশঙ্কর প্লেনের নিচে ঝাঁপ দিল। প্রকাশক : কৈতর প্রকাশন, সিলেট।