পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন প্রসঙ্গে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মে ২০২২, ৬:২২:২১ অপরাহ্ন

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের
বর্তমান সময়ে কিছু কিছু ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলে। হতাশায় নিমজ্জিত করে দেশ, জাতি ও সমাজকে। আমরা যেন এক ধরনের ব্যর্থতায় পর্যবসিত। সবাই যেন ছুটছে মরিচিকার পেছনে, কিছু কিছু মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ একেবারেই যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। দেশ, জাতি ও সমাজকে নৈতিকতায় সমৃদ্ধ করতে হলে প্রত্যেকেই তাদের পারিবারিক অবস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। পরিবারের লোকজন কে কী করছে, কে কার, দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, এ বিষয়গুলো দেখতে হবে। প্রত্যেকে যদি প্রত্যেকের সন্তানকে সঠিকভাবে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝিয়ে দিতে না পারে, তবে তারা বড় হয়ে কিভাবে পরিবার ও সমাজের কাজে লাগবে। এ ব্যাপারে মা বাবার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির এই সময়েও একটা চূড়ান্ত অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে চলছি আমরা। সামাজিক মূল্যবোধগুলো যেন এক এক করে ক্ষয়ে যাচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
গত ৭ মে শনিবার দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপটিই যেন প্রকাশ করে। বসতবাড়ির জমি লিখে না দেওয়ায় ৮০ বছর বয়সী মা রেজিয়া বেগমকে মারধর করে দুই হাত ভেঙ্গে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্যাংক কর্মকর্তা ছেলে রাজীব আলী ডন ও তার স্ত্রী খালেদা বেগমের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ০৩ মে ২০২২(মঙ্গলবার) রাতে দিনাজপুর শহরের বড় বন্দর নতুনপাড়া মহল্লায় ওই মায়ের বাড়িতে। রেজিয়া বেগমকে দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার হাত, পা ও মাথাসহ শরীরের সব জায়গায় শুধুই আঘাতের চিহ্ন। হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। এই ঘটনায় অভিযুক্ত ছেলে রাজীব আলী ডনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শাখার সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তার স্ত্রী মোছা. খালেদা বেগম গৃহিনী। আর নির্যাতিতা রেজিয়া বেগম প্রাইমারী স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা। তিনি বড় বন্দর নতুনপাড়া মহল্লার মৃত বাহার আলীর স্ত্রী। স্বামী বাহার আলীও দিনাজপুর জিলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
মামলা, নির্যাতনের শিকার নারী এবং স্বজনদের তথ্যে জানা যায়, রেজিয়া বেগমের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছেন। স্বামীও গত হয়েছেন অনেক আগে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে রাজীব আলী ডন ব্যাংক কর্মকর্তা। ছোট ছেলে ও বড় ছেলের রেখে যাওয়া এক সন্তানকে নিয়ে বড় বন্দর নতুনপাড়ায় বসবাস করেন তিনি। বেশ কিছুদিন থেকেই ছেলে রাজীব আলী ডন মায়ের কাছে বসতবাড়ির ১৬ শতাংশ জমি লিখে নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মা তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এক সময়ে ছেলের জেদাজেদি ও নির্যাতনের কারণে তিন শতাংশ জমি লিখে দেন। কিন্তু ছেলে সম্পূর্ণ জমিই লিখে নেওয়ার জেদ ছাড়েননি। বাকি জমি লিখে না দেওয়ায় নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। গত ১৯ রমজান মাকে আবারও নির্যাতন করেন ডন। সেদিন পরিবারের লোকজন ও পুলিশের সমঝোতায় ছাড় পান তিনি।
পরে ঈদের দিন রাত ৮টার সময় রাজীব আলী ডন ও খালেদা বেগম বাকী জমি লিখে দিতে রেজিয়া বেগমকে চাপ সৃষ্টি করেন। এতে রাজি না হওয়ায় তারা তাকে অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন। যে লাঠির ওপর ভর করে রেজিয়া বেগম চলাফেরা করেন, সেই লাঠি কেড়ে নিয়ে ও লোহার রড দিয়ে তাকে তারা মারধর করেন এবং লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন। রেজিয়া বেগমের শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তারা আঘাত করেননি। নির্যাতন সইতে না পেরে মা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে গেলে আবারও টেনেহিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেন ছেলে ও পুত্রবধূ। নির্যাতনে রেজিয়ার দুই হাত ভেঙ্গে যায়। তিনি মাথায় আঘাত পান, পায়ে হয় যখম। পুত্রবধূ খালেদা বেগম বুকের ওপর বসে গলা চেপে ধরেন রেজিয়ার। এ সময় বড় ছেলের রেখে যাওয়া সন্তান নাতি লিমান ফুফুদের খবর দিলে তারা এসে মাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
রেজিয়া বেগমের ছোট মেয়ে জনতা ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা মোছা. সামসি জাহান বকুল বলেন এর আগেও জমির জন্য আমার ভাই মাকে মারধর করেছে। আবারও আমার ভাই ও ভাবি মাকে মারধর করে হাত-পা ভেঙ্গে দিয়ে নিজেই আবার মায়ের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গিয়েছিল। এ সময় পুলিশ তাকে আটক করে। আমরা তার বিচার চাই। আরেক মেয়ে আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, আমরা ভাইবোন সকলে শিক্ষিত। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমার মাও সাবেক শিক্ষিকা। আমাদের পরিবারে এই ঘটনা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। মায়ের ওপর নির্যাতনকারী আমার ভাইয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে করে আর কোনো সন্তান মায়ের ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন না করে।
ওপারেশন থিয়েটারের সামনে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রেজিয়া বেগম বলেন, আমি বারবার আমার ছেলেকে বলছিলাম বাবা আমি তোমার মা, আমাকে মারিস না। আমি বংশের সবচেয়ে বড় সন্তান। তোর বাবা কিংবা আমার বাবা ও পরিবারের কোনো লোকজন আমার গায়ে কখনো হাত তোলেনি। কিন্তু আমার ছেলে কোনো কথা না শুনেই আমাকে মারধর করে। ছেলের নির্যাতনে আমি হাসপাতালে। আর যে ছেলেকে আদর যত্ন করে মানুষ করেছি, সেই ছেলে জেলে। বলেন দেখি এমনটি কি হয়? আমি দেশের প্রচলিত আইনে এই ঘটনায় ছেলের বিচার চাই। যাতে কোনো মা ছেলের দ্বারা নির্যাতনের শিকার না হয়।
দিনাজপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফফর হোসেন বলেন, ওই ছেলে থানায় এসেছিল মায়ের বিরুদ্ধে মামলা দিতে। কিন্তু পুলিশ মাকে মারধরের বিষয়টি অবগত হওয়ার পর তাকে আটক করে। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দিলে ওই মামলায় ছেলেকে আসামি করে আদালতে পাঠানো হয়। বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাটি তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।
পিতামাতাকে ভরণ পোষণ না করা তাদেরকে নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। যেহেতু পিতামাতার ভরণ-পোষণের জন্য দেশে আইন আছে দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে অন্য কেউ এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস না পায়। তাছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক নীতি নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। ধর্মীয় বিধি নিষেধ ও আচরণ মেনে চলতে প্রত্যেককে উৎসাহী করে তুলতে হবে। পাঠ্য পুস্তকে ও নীতি নৈতিকতার বিষয়গুলোর উপরে আরও বেশী জোর দিতে হবে। অকৃতজ্ঞ সন্তান কর্তৃক মাতাপিতাকে নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
বর্তমান সরকার পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১১ প্রণয়ন করেছে। এ আইন প্রণয়ন সরকারের নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে মনে করি। এ আইনের
৩নং ধারায় বলা হয়েছে :
(১) প্রত্যেক সন্তানকে তাহার পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিতে হইবে। (২) কোন পিতামাতার একাধিক সন্তান থাকিলে সেইক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করিয়া তাহাদের পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিবে। (৩) কোন সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার বা ক্ষেত্রমত তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করিতে বাধ্য করিবে না। (৪) প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখিবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করিবে। (৫) প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখিবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করিবে, সেবা ও পরিচর্যা করিবে। (৬) পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তান হইতে পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেইক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তাহার বা ক্ষেত্রমত তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে। (৭) কোন পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তানদের সহিত বসবাস না করিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেইক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমত মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয়ের কমপক্ষে ১০% আয় পিতা বা মাতাকে নিয়মিত প্রদান করিবে।
৪নং ধারায় বলা হয়েছে :
(১) পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণ-পোষণ প্রত্যেক সন্তান তাহার (ক) পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং (খ) মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে, ধারা ০৩ এ বর্ণিত ভরণ-পোষণে বাধ্য থাকিবে এবং ভরণ-পোষণ পিতামাতার ভরণ-পোষণ হিসাবে গণ্য হইবে।
৫নং ধারায় বলা হয়েছে :
(১) কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ০৩ এর যেকোন উপধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনুর্ধ ০৫ (পাঁচ লক্ষ) টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবে, বা উক্ত অর্থদন্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনুর্ধ ছয় মাস কারাদন্ডে দন্ডিত হইবে। (২) কোন সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্রমত স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন নিকট আত্মীয় ব্যক্তি (ক) পিতামাতার ভরণ-পোষণে বাধা প্রদান করিলে বা (খ) পিতামাতার ভরণ-পোষণে অসহযোগিতা করিলে, তিনি এই আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিয়াছে গণ্যে উপধারা (১) এ উল্লিখিত দন্ডে দন্ডিত হইবে।
লেখক : কলামিস্ট।