পৃথুর বুদ্ধিতে বাঁচল সবাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ৪:২৩:০১ অপরাহ্ন

নূসরাত নিশা
‘খুউব ভালো! নিজেকে বানর ভাবলে এমনই হবে’, চেঁচিয়ে উঠল পৃথুর মা।
‘মা…!’ মন খারাপ করল পৃথু।
ঘরে ঢুকল বাবা। ‘কী গো, এত বকছ কেন?’
‘কী আর হবে! তোমার পুত্র গাছে উঠেছিল নিজেকে বানর ভেবে। কিন্তু বানরের মতো বুদ্ধি তো নেই। তাই মরা ডাল চিনতে পারেনি। ধপাস করে মাটিতে।’
পৃথুর মায়ের কথায় হাসি আটকাতে পারলেন না বাবা। দেখলেন ছেলেকেও। ‘নাহ। সামান্য ছিলেছে। ভয়ের কিছু নেই।’
আবার রাগে গজগজ করলেন মা। ‘ছুটিতে গ্রামে আসতে ভয় লাগে। পৃথু কথাই শোনে না! তার ওপর বাবার লাই পেয়ে গাছে…না গাছে ওঠাও থামাচ্ছি!’
‘কটা দিন ছুটি পায়। এসব মজা শহরে পাবে কোথায়?’
এভাবেই বিছানায় শুয়ে-বসে কেটে গেল দিনটা।
পরদিন ভোর। জানালায় ঠকঠক। কুসুম এসেছে।
‘গোবর ভাঙতে যাব, যাবি?’
নাক কুঁচকে পৃথু বলল ‘গোবর’
‘হ্যাঁ, পুকুর পারে গোবর শুকাতে দিয়ে চকে যাব শাক তুলতে। মিঠাই আর রতন যাবে।’
‘চক আবার কী?’
‘চক মানে বিশাল ক্ষেত। সেখানে গাছের গোড়ায় আগাছার মতো শাক হয়। ওটা তুলব। খেতে ভারি মজা।’
কুসুমের কথায় লোভ সামলাতে না পেরে বেরিয়ে গেল পৃথু।
পুকুর পারে গোবর শুকাতে দিয়ে চারজন চলল শাক তুলতে। কার ক্ষেত কে জানে। এখান-ওখান থেকে শাক তুলেই যাচ্ছে।
‘সাবধান! ধানগাছ মাড়াস না! তাড়াতাড়ি কর! ক্ষেতের মালিক দেখলে দাবড়ানি দেবে,’ বলল রতন।
পৃথু বলল, ‘সেরেছে! লাঠি নিয়ে আসছে কে জানি!’ সবাই তাকাল। মিঠাই দিল চিৎকার, ‘পালা! মালিক’। পড়িমড়ি দৌড়। এক দৌড়ে যে যার বাড়ি।
ঢুকতেই মায়ের মুখোমুখি। একেবারে মারমুখোই হয়ে আছেন। ‘সকাল সকাল কোথা থেকে তাড়া খেয়ে আসছিস শুনি?’
পৃথু বলল, ‘মা দেখো, কী তাজা শাক! তোমার জন্য শাক তুলতে গিয়েছিলাম।’
মায়ের হাতে শাকের আঁটি ধরিয়েই ঘরে ঢুকে গেল পৃথু। ভাবল, এমন তাড়া জীবনেও খাইনি। কী একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল!
বিকেলে চারজন নদীর পারে আড্ডা দিচ্ছিল। সকালের তাড়া খাওয়া নিয়ে গল্প চলল।
মিঠাই বলল, ‘কাল বাবা সারা রাত নদীতে মাছ ধরেছে। সকালে মাছ বিক্রি করে দুপুরে খেয়ে ঘুম। নৌকা ঘাটে বাঁধা। ওপারে চরে যাবি? সন্ধের আগেই ফিরব।’
দেরি না করে সবাই চড়ে বসল নৌকায়।
‘তোর বাবা জানলে বকবে না’, বলল পৃথু।
‘নাহ। আমি তো বাবার সাথেই নৌকা চালাই।’
ঠিকঠাক ওপারে পৌঁছে গেল চারজন। কিছুক্ষণ চরে ঘুরেফিরে আবার উঠল নৌকায়।
ইঞ্জিন চালু করতেই ঘটল ঘটনা। শব্দ করে থেমে গেল ইঞ্জিন। মিঠাই দেখল, ইঞ্জিনের ভেতর মোটরের একটা পাখা ভেঙে গেছে।
পৃথুর ব্যাপারটা ধরতে সময় লাগল। বুঝতে পেরে শুকিয়ে গেল মুখ। ‘আজ মা মেরেই ফেলবে।’
‘আরে ডরাস না। দরকার হয় সাঁতরে যাব’, বলল রতন।
‘মা সন্ধের আগে ফিরতে বলেছে। তা ছাড়া আমি সাঁতারও জানি না’, বলল পৃথু।
কুসুম বলল, ‘ভয় নেই। আমরা তো জানি। তুই ডুবতে বসলে তোকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব। হি হি হি।’
আপাতত অপমানটা গায়ে মাখল না পৃথু।
এদিকে নৌকার বৈঠাটা কয়দিন আগেই ভেঙে গেছে। চিন্তায় পড়ল মিঠাই। এটা জানতে পেরে বাকিরাও টেনশনে পড়ে গেল। কী করা যায়? চরে কোনো বসতি নেই, আর কোনো নৌকাও নেই।
‘ওই দেখ দুটো চিকন বাঁশ’, চেঁচিয়ে বলল পৃথু । ‘এত চিকন বাঁশ দিয়ে কী হবে। এ দিয়ে তো বৈঠার কাজ হবে না। আবার এত ছোট বাঁশ দিয়ে লগিও বানানো যাবে না। লগি চিনিস তো? নদীর তলায় যে বাঁশ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকা চলে সেটা’, বলল বাকিরা।
পৃথু উত্তর না দিয়ে আঙুল তুলে দেখাল, ‘আরে ওই যে একটা মরা কলাগাছ পড়ে আছে!’
এবারও বুঝল না কেউ। কলাগাছ আর বাঁশ দিয়ে তো ভেলাও হবে না।
‘নৌকায় দড়ি আছে দেখলাম। কলাগাছের গোল বাকলগুলোর ফাঁকে ওই চিকন বাঁশটা বেঁধে দিলেই জিনিসটা হয়ে যাবে’, উত্তেজনায় চকচক করছে পৃথুর চোখ।
‘কী হয়ে যাবে’, বাকিরা এখনো ধরতে পারেনি।
‘আরে! যেটা দিয়ে পানি সরিয়ে সরিয়ে নৌকা চালায় ওটা।’
পৃথুর কথায় সবাই হেসে উঠলেও তার তারিফ না করে পারল না। কুসুম বলল, ‘আরে বোকা ওটাকেই বলে বৈঠা। অবশ্য তুই বোকা না। তোর অনেক বুদ্ধি।’
পৃথুর কথামতো ঝটপট দুটি বৈঠা বানিয়ে ফেলল বাকিরা। নৌকা চলতে শুরু করল ছলাৎ ছলাৎ।
সন্ধে নাগাদ ঘাটে ফিরল সবাই। বিদায় নিল পৃথু। তার আগে বাকিরা তাকে বলে দিল, ‘তোর বুদ্ধিতে আজ বেঁচে গেলাম। কাল আমরাই তোকে সাঁতার শেখাব। ওটা শিখলে আর ভয় নাই।’