প্রজাপতির মাতম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৪:১৯:০৯ অপরাহ্ন

ইউনুছ আলী
রাকিব হাসান।তুলতুলে ফুটফুটে এক শিশু। বয়স দশ কিংবা এগারো। ফুল-পাখি ও প্রকৃতি নিয়েই তার ভাবনা।সারাদিন গাছের ডালে ডালে সে ফড়িং খুঁজে বেড়ায়।ঝরে পড়া ফুল কুড়িয়ে খেলায়। মাঝে মধ্যে পারিবারিক বাগানের এক কোণে বসে গুনগুনিয়ে গান গায়।একদিন বাগানের দক্ষিণ দিকে কয়েকটি প্রজাপতিকে উড়াউড়ি করতে দেখা গেল। রাকিব ধীরে ধীরে ওদের কাছাকাছি চলে যায়। রঙবেরঙের ডানাওয়ালা প্রজাপতির নাচানাচি দেখে তার খুব ভালো লাগে। আনন্দ হয়। সে তাৎক্ষণিক গান ধরে, “প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গীন পাখা/টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা।/তুমি টুলটুলে বন-ফুলে মধু খাও/মোর বন্ধু হয়ে সেই মধু দাও,/ওই পাখা দাও সোনালী-রূপালী পরাগ মাখা।” প্রজাপতিগুলোও কী যেন বুঝে তার চতুর্দিকে উড়াউড়ি করতে শুরু করলো। একটা-দু’টা প্রজাপতি ধরে সেও নাচতে লাগলো।এমন সময় বাগানে প্রবেশ করে বন্ধু ইফতি হাসান। প্রজাপতির সাথে রাকিবের এই সুসম্পর্ক দেখে শিহরিত হয় ইফতি!
-কি রে! প্রজাপতির সাথে তোর খুব বন্ধুত্ব দেখছি। ব্যাপার কী?
-কী আর বলবো? বাগানে এলাম একটু ঘোরাঘুরি করবো।এসে দেখি প্রজাপতিগুলো উড়াউড়ি করছে। নাচানাচি করছে। তাই আমিও একটু খুনসুটিতে মেতে উঠলাম বৈকি!
-শোন্, আজ ২৬শে মার্চ।দিনটি আমাদের জন্য বড়োই বেদনার। বড়োই কষ্টের।প্রজাপতিগুলো আনন্দে নয়,দুঃখে নাচানাচি করছে। কারণ ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর আক্রমণে তারাও অনেক আপনজনকে হারিয়েছে ; যেভাবে আমরাও হারিয়েছি আমাদের অগণিত আপনজন।
-তাই তো তাদের এই নৃত্যের মধ্যে কোনো ছন্দ নাই।তাল নাই। এ যেন শুধুই বিলাপ, আহাজারি–। প্রিয়জনের স্মরণে হয়তোবা তারা মাতম করছে!!
-হ্যা,ঠিক ধরেছিস্। পাকবাহিনীর হাতে শুধু এদেশের জনসাধারণই মরে নি।অসংখ্য-অগণিত পশুপাখিও প্রাণ হারিয়েছে তাদের আক্রমণে।পুড়ে ছাই হয়েছে মূল্যবান বনজ সম্পদ। বোমার আঘাতে মাটির সাথে মিশে গেছে অনেক দালানকোঠা। সে এক লোমহর্ষক ইতিহাস! এমন অসংখ্য ঘটনা আছে যা শোনলে তোর বুক কেঁপে ওঠবে।দম বন্ধ হয়ে আসবে।
রাকিব ও ইফতির আলোচনার ফাঁকে চলে এলেন হুমায়ুন সাহেব। তিনি রাকিব হাসানের বাবা।রাকিবকে লক্ষ্য করে বললেন, “আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে যাবো।যাবে তুমি?”
-কেনো নয়? এতক্ষণ আমরা দুই বন্ধু এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই গল্প করছিলাম আব্বু! সত্যিই বড়ো দুঃখের ইতিহাস সেটা।আব্বু ইফতিকে কী আমাদের সাথে নেওয়া যায় না?
-ইফতির আম্মু দিলে অবশ্যই নিবো।
ইফতি রাকিবকে সাথে নিয়ে এক দৌড়ে চলে গেল মায়ের কাছে। তারপর মায়ের অনুমতি নিয়ে চলে এলো হুমায়ুন সাহেবের নিকট।
-আম্মু সম্মতি দিয়েছেন আপনার সাথে যাওয়ার জন্য।
-ঠিক আছে। চলো।
নোহা এসে রাকিবদের উঠোনে থামলো। রাকিব, ইফতি, রাকিবের বড়বোন পারুল ও হুমায়ুন সাহেব গাড়িতে চড়ে বসলেন। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলো ঢাকার আগারগাঁওস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্দেশ্যে। সবার আগ্রহের পারদ তুঙ্গে। ইফতি ও রাকিবের মন আঁকুপাঁকু করছে দ্রুত কাঙ্খিত জাদুঘরে পৌছানোর জন্য। অবশেষে তারা জাদুঘরে এসে পৌছালো। কি চমৎকার দৃশ্য! হৃদয়কাড়া পরিবেশ! রাকিবের গাল বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরতে লাগলো চোখের পানি। আহ্! এইতো শহীদের রক্তমাখা পোশাক। বিভিন্ন দ্রব্যের ধ্বংসাবশেষ। শহীদের মৃতদেহ। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র। আলোকচিত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার ব্রোঞ্জের তৈরী ম্যুরাল।
রাকিব, পারুল ও ইফতি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এখান থেকে চলে যেতে মন চাইছিলো না তাদের। স্বপ্নের ন্যায় কেটে যায় অনেক সময়। হঠাৎ হুমায়ুন সাহেবের ডাকে তারা সম্বিৎ ফিরে পায়।দ্রুত গাড়িতে উঠে সকলে। রাকিব,ইফতি ও পারুলের চোখে দুখের নোনাজল খেলা করছে! লজ্জার বাঁধ ভেঙে সবার চোখ থেকে পানি ঝরছে। আবেগঘন এই দৃশ্য দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন হুমায়ুন সাহেবও।চলন্ত গাড়িতে সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের!