প্রসঙ্গ : স্বেচ্ছা ঋণখেলাপি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২১, ৪:১৩:৩৯ অপরাহ্ন

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
সমাজে ছোট বড় আমরা যারাই আছি, আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা কেউই সমাজের বাইরে কেউ নই। আমি ছোট মানুষ। অভিজ্ঞতার ধরণটিও সে রকমই হবে। কিন্তু সেটা যে অভিজ্ঞতা তা কিন্তু মানতে হবে। আমি ব্যাংকে একটি ছোট খাটো চাকরী করতাম। সে সুবাদে ব্যাংকিং কর্মকান্ডের অভিজ্ঞতাই একটু বেশি থাকবে। অভিজ্ঞতাটি ১৯৭৮-৭৯ সালের। জনতা ব্যাংক দিরাই শাখার ব্যবস্থাপক আমি। তখন সারা দেশে ১০০ কোটি কৃষি ঋণের প্রোগ্রাম চলছে। সব রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। বৈশাখ মাস। কৃষকের ঘরে ঘরে ধান। কৃষিঋণ আদায়ের মৌসুম। কৃষিঋণ আদায়ের জন্য ঋণগ্রহীতার দ্বারে দ্বারে আমরা যাচ্ছি। আদায় তেমন হচ্ছিল না। সে সময় দিরাই-শাল্লার মাননীয় সংসদ সদস্য ছিলেন জননেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। ব্যাংকটি দিরাই বাজারে। বাজারের গলিতে ব্যাংকের সামনে সুরঞ্জিত সেনের জনসভা। তাঁর বক্তৃতা আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। মাইকে হঠাৎ শুনতে পারলাম তিনি বলছেন-‘কৃষক ভাইয়েরা যারা পারেন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবেন।’ ভাবলাম, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আর ঋণ আদায় হবে না। এখন সবাই বলবেন-‘আমরা পারি না। আমরা অক্ষম।’
তাহলে উপায়? ব্যাংকের বড় বড় সাহেব বলবেন-কৃষিঋণ আদায় হচ্ছে না কেন? এই কেন, এর উত্তরটি তো সাহেবরা বুঝবেন না! আমার বড় ভাই অধ্যাপক দেবেন্দ্র কুমার দাসের (প্রয়াত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বিধায় তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতেন। উনার সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে বিষয়টি বললাম। জানালাম যে, আপনার বক্তব্যের পর থেকে কেউ আর কৃষিঋণ পরিশোধ করছেন না। তিনি সেদিন খুবই গুরুত্ব দিয়ে আমার কথা শুনছিলেন। তার কিছুদিন পর ঐ স্থানেই উনার আর একটি জনসভা। তিনি সেদিন অন্য সুরে বলছিলেন আপনারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে দেবেন! ম্যানেজারকে বলে দেবো-‘যারা ঋণ পরিশোধ করবেন তাদেরকে যেন আবারো ঋণ দেয়।’ এতেই কাজ হয়ে গেছে। এরপর থেকে কৃষিঋণ আদায়ের হার বেড়ে গেল।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এতো সব বলার কারণটা কি! আমার কাছে কারণটি হলো ২২.০২.২০২১ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটি শিরোনাম-‘বিদেশে যেতে পারবেন না স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিরা।’ অর্থাৎ এই ‘স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিরা’ শব্দ দু’টিই মূল কারণ। আমারতো মনে হয়, ছোটবড় যত ঋণ গ্রহীতাই হোক না কেন এই ঋণের টাকা কিন্তু ব্যাংক সমূহ পেয়েছে দেশের জনগণের কাছ থেকে। অর্থাৎ ঋণ খেলাপি হোক বা খেলাপি না হোক টাকাটা কিন্তু জনগণের। দেশের জনগণের রক্তের টাকা ঋণের নামে লুটেপুটে খাওয়ার অধিকার কারো নেই। নৈতিকভাবে যেমন সেটা অপরাধ ধর্মীয় বিধি বিধানের ক্ষেত্রেও সেটা পাপ। যারা এ কাজ করে তারা পাপী। ব্যাংক কম্পানি আইনের সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বেচ্ছা খেলাপিদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমিটি ওই তালিকা চূড়ান্ত করার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। সবই মানলাম। সবই ঠিক আছে। কিন্তু স্বেচ্ছা খেলাপির সংজ্ঞা কি আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে? যদি তাই হতো তাহলে মিউচুয়েল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কি বলতেন,-‘সবার আগে স্বেচ্ছা খেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ জরুরি, এরপর সংজ্ঞা অনুযায়ী যথাযথভাবে তাঁদের শনাক্ত করা।’ এই যদি অবস্থা হয় তাহলে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকে যে তালিকা পাঠাবে তা কি সঠিক হবে? এ ক্ষেত্রে আইন থাকা এক কথা আর বাস্তবতা আর এক কথা। বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা এমন নয় যে দেশের সব ঋণ গৃহীতারা সদা সত্য কথা বলিবেন!
ঋণখেলাপি স্বেচ্ছা না অনিচ্ছায় সেটা নির্ধারণ করা এদেশে সহজ ব্যাপার নয়। এদেশে তথা এ সমাজে অনেকেই ব্যবসা খারাপের অজুহাত দিয়ে খেলাপি হতে পারে। গৃহীত ঋণের হাজার হাজার লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যবসা থেকে সরিয়ে বিদেশে সেকেন্ড হোম বা নির্লজ্জ বেগমদের বেগম পাড়ায় পাচার করে ব্যবসা খারাপের অজুহাত দেখালে তাদের টিকিটি কেউ ধরার ক্ষমতা রাখে? যদি এমন ক্ষমতা কেউ রাখতো তাহলে কি সুইসব্যাংক নামক ব্যাংকে বাংলাদেশীদের একাউন্ট থাকতো? আর স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিরা যদি বিদেশে যেতে না-ই পারেন তাতেই বা তাদের তেমন ক্ষতিটাই বা কি! ব্যাংকের ঋণের টাকা লুটপাট করে দেশেই তো তারা আরাম-আয়েশে সমাজে কেউকেটা হয়েই তো চলতে পারবেন। তবে আমরা যে যা-ই বলি না কেন, এটাও ঠিক যে চুরের মনে কিন্তু সব সময়ই পুলিশ পুলিশ ভাবটা থেকেই যায়। আজকাল দুদক এর কথা মনে হলে ঋণ খেলাপিরা ও তাদের সহযোগী অনেকেরই রাতের সুখ নিদ্রায় খানিকটা হলেও যে ব্যাঘাত ঘটে তা কিন্তু সত্য।
তাতে কি? লুটেরা ঋণখেলাপিদের নিদ্রার খবরে আমজনতার কি-ই বা আসে যায়। ওদের কুকর্মের ফল যে দেশের জনগণকে ভোগ করতে হচ্ছে সেটাইতো বড়ো কথা। এখানে চৌর্যবৃত্তি স্বেচ্ছায় অনিচ্ছায় এমন প্রশ্ন অবান্তরই বলতে হবে। বহুল আলোচিত পি.কে হালদার ও তার সহযোগী ও সহযোগীনিরা মিলেমিশে ব্যাংক পাড়ায় যে কুকান্ডের নজির সৃষ্টি করেছে তারাও যদি কোন সময় বলে বসে যে তারা স্বেচ্ছা ঋণখেলাপী নন তাও কি মানতে হবে? কার্টুনিস্ট ভাইয়েরা অনেক সময় ছোট পরিসরে অনেক অনেক তাত্ত্বিক বড় বড় বিষয় বলে ফেলেন। ৮.৪.২১ তারিখের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার একটি কার্টুন যেন সে কথাই বলে দিয়েছে।
কার্টুনটি হলো-‘লক্ষ্মীপুরের চেয়ারম্যান রানা ‘শুধু খাই খাই করেন’-‘কী করব গিন্নি যে শুধু চাই চাই করে’। এই কার্টুন থেকে আমরা তো এটাই ধরে নেবো যে রানা চেয়ারম্যানের ‘খাই খাই’, কোন দোষের বিষয় নয়, যত দোষ তার গিন্নীর ‘চাই চাই’ করার। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম রানা-চেয়ারম্যানের গিন্নিই তাকে খাই খাই করতে বাধ্য করেছে কিন্তু পি.কে হালদারের তো গিন্নিটিন্নি কিছু নেই? এই ভদ্রলোক(?) খাই খাই করে দেশ ছাড়া হতে গেলেন কেন? সত্যিকথা বলতে কি এই দেশে, এই সমাজে এখনো গিন্নিরা এখনো এতো শক্তিধর নয় যে গিন্নিদের ‘চাই চাই’ এর কারণে তাদের সাহেবরা ‘খাই খাই’ করবেন। আসলে তাদের স্বভাবই হলো ‘খাই খাই’ ধরনের। তবে এসব ক্ষেত্রে সব কথার শেষ কথা হলো সরকারের সব সেক্টরের কথিত ‘রানা সাহেব’দের খাই খাই বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই!
এখন প্রশ্ন হলো, বন্ধ করবেটা কে! স্বাভাবিকভাবেই বলা চলে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এ ব্যাপারে ২৫.০২.২০২১ তারিখের দৈনিক সংবাদ পত্রিকা যে সম্পাদকীয় লিখে তা তো দারুণভাবে হতাশই হতে হয়। পত্রিকাটি লিখে-‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কার করে ‘মধু খাওয়া’ বন্ধ করতে হবে।’ পত্রিকাটি লিখে-‘পি.কে হালদারের সহযোগী এডি রাশেদুল হক ও চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী নাকি আদালতে জবানবন্দী দিয়ে বলেছেন-কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস.কে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে নিয়মিত ‘ঘুষ’ দিয়ে তারা বিভিন্ন সময় অনিয়ম চাপা দিয়েছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলের কর্মকর্তাদেরও ঘুষ দিতেন। এমনও অভিযোগ নাকি উঠছে যে, ব্যাংকের এমডি নিয়োগ, অনুমোদন, নতুন শাখা খোলা, বড় ঋণ অনুমোদন, ঋণ পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন কাজেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একশ্রেণীর কর্মকর্তা অনিয়ম করেন, অনৈতিক সুবিধা নেন।
তাহলে উপায়? পি.কে হালদার গংদের দেয়া ‘মধু খেয়ে’ তাদেরকে তো আর ‘বিষ’ দেয়া যায় না! আর এমডি নিয়োগ অনুমোদনে যদি ঘুষ নেয়া হয় তাহলে এমডিরাও তো অনিয়ম করবেনই। দেয়া টাকাতো আদায় করতে হবে। আর ‘মধু খাওয়া খাওয়াই’ চলতে থাকলে ব্যাংকসমূহে স্বেচ্ছা খেলাপির সংখ্যা তো দিনে দিনে বৃদ্ধি পাবেই। এতে করে আর্থিক খাতে অশনি সংকেত তো দেখা দেবেই। তাই জরুরি ভিত্তিতে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবেই। ওদেরকে বোঝাতে হবেÑশুধু নয়, তোমরা জেনে শুনে বিষ পান করছো। বিষের জ্বালা কিন্তু বড় জ্বালা।
লেখক : মু্িক্তযোদ্ধা, কলামিস্ট, সাবেক ব্যাংকার