প্রাক্কলিত ব্যয় ১২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা: সুনামগঞ্জে বোরো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে গতি নেই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২:১৬:১৬ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী::
সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪ হাওরের ইরি-বোরো ফসলরক্ষা বেড়ি বাঁধের কাজই শুরু হয়নি। এবার ১১ উপজেলায় ৬১২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এজন্যে ৭৮০টি প্রজেক্ট ইমপ্লিম্যান্ট কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রাথমিকভাবে ৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান অভিযোগ করে বলেছেন, বিভিন্ন উপজেলায় পিআইসি গঠনে অনিয়ম হয়েছে। কোথাও কাজের কোন গতি নেই।
অবশ্য, পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী ও জেলা বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব মোঃ সবিবুর রহমান সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ৬০২টি বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সকল বাঁধের শতভাগ কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলায় ১ হাজার ৬৮০ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ রয়েছে। ১৯৬৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই বাঁধের কাজ করা হয়। চলতি অর্থ বছরে ৬১২ কিলোমিটার বাঁধ ও ১৩৫টি প্রধান ক্লোজার নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ক্লোজারও নির্মাণ করবে পাউবো। এজন্যে ৭৮০টি পিআইসি গঠন করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর ৩৫টি পিআইসি বেড়েছে। পিআইসি বাড়লেও গতবারের চেয়ে এবার প্রাক্কলিত ব্যয় কমেছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। ১১ উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬৯টি পিআইসি ধর্মপাশা উপজেলায় এবং সর্বনিম্ন ১৮টি পিআইসি ছাতক উপজেলায়।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৩২টি পিআইসির অনুকূলে ৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ৪১ পিআইসির অনুকূলে ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, জামালগঞ্জ উপজেলায় ৪৪ পিআইসির অনুকূলে ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা, তাহিরপুর উপজেলায় ৮২ পিআইসির অনুকূলে ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, ধর্মপাশা উপজেলায় ১৬৯ পিআইসির অনুকূলে ৩২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, শাল্লা উপজেলায় ১৫৬ পিআইসির অনুকূলে ২৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ৪৯ পিআইসির অনুকূলে ৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৩২ পিআইসির অনুকূলে ৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, জগন্নাথপুর উপজেলায় ৩৭ পিআইসির অনুকূলে ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা, দিরাই উপজেলায় ১২০ পিআইসির অনুকূলে ১৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা ও ছাতক উপজেলায় ১৮ পিআইসির অনুকূলে ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করেছে পাউবো। কাজ সম্পন্নের পর চূড়ান্ত ব্যয় নির্ধারণ করা হবে। চাহিদা অনুযায়ী জেলার হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্যে প্রাথমিকভাবে ৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, গত নভেম্বর মাসে জেলার প্রায় সকল হাওরে পাউবো’র প্রধান কার্যালয় থেকে স্পেশাল টেকনিক্যাল টিম সরেজমিন জরিপ কাজ করে। টেকনিক্যাল টিমের জরিপের পরই হাওরের বাঁধ যোগ্য স্থান নির্ধারণ করে পিআইসির উদ্যোগ নেয় পাউবো।
সূত্র জানায়, গত ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে জেলায় ৬৩৩ কিলোমিটার বাঁধ ও ১৩৯টি ক্লোজার নির্মাণ করা হয়। এজন্যে ৭৪৫টি পিআইসি গঠন করা হয়েছিল। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩৫ কোটি টাকা। তবে, কাজ সম্পন্নের পর চূড়ান্ত বিল দেয়া হয় ১০২ কোটি টাকা। তবে গত মৌসুমের বাঁধের নির্মাণ কাজের টাকা গত ডিসেম্বরে দেয়া হয়। এজন্যে কৃষকরা সুনামগঞ্জে দফায়-দফায় নানা কর্মসূচিও পালন করেন।
২০১৮-২০১৯ সালে ৪৫১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে গঠন করা হয়েছিল ৫৭২টি পিআইসি। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০১৭-২০১৮ সালে ১ হাজার ৩৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্যে ৯৬৫টি পিআইসি গঠন করা হয়েছিল। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫১ কোটি ৬৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের মার্চ মাসের শেষ ও এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ি ঢলের পানিতে সুনামগঞ্জ জেলার সকল হাওর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। সে সময় হাওররক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠে। জনমনে চরম ক্ষোভ-হতাশা দেখা দেয়। এক পর্যায়ের বাঁধের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ঠিকাদারী প্রথা বিলুপ্ত করে পিআইসির মাধ্যমে হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্যে ‘কাবিটা নীতিমালা ২০১৭’ প্রণয়ন করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী পিআইসিকে তদারকির জন্য উপজেলা কমিটি, জেলা কমিটি ও উপদেষ্টা কমিটিও করার কথা রয়েছে। উপজেলা কমিটির আহবায়ক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্যসচিব পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী পিআইসি অনুমোদন দেন। নীতিমালা অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে উপজেলা কমিটি পিআইসি গঠন করে দেন।
পিআইসি গঠনে বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, কমিশন আদায়, নানান অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নীতিমালা অনুযায়ী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন সম্পন্ন করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু করে আবশ্যিকভাবে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ সমাপ্ত করতে হবে। প্রকল্প এলাকায় স্কীমের নাম, বরাদ্দের পরিমাণ, বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির নামসহ বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত দৃষ্টিযোগ্য বিলবোর্ড স্থাপন করতে হবে।
জানা গেছে, নীতিমালা অনুযায়ী কাজের সময়সীমা ইতোমধ্যে দেড় মাসেরও বেশি অতিবাহিত হয়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭৮০টি প্রকল্পের মধ্যে ৬০২টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন হাওরে গতকাল পর্যন্ত ‘এক কোদাল’ মাটিও পড়েনি। আবার বিভিন্ন উপজেলায় গত সপ্তাহে পিআইসি গঠন করে পিআইসি সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণ দেন কর্মকর্তারা। পিআইসি সদস্যদেরকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্নের জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাউবোর কর্মকর্তারা জানান, গতকাল পর্যন্ত ধর্মপাশায় ১১২টি, শাল্লায় ১১৮টি ও দিরাইয়ে ১০৮টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।
তবে, পাউবো’র দেয়া তথ্যের সাথে বাস্তবে মিল নেই বলে স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন। কৃষকরা জানান, নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্নেরও তেমন সম্ভাবনা নেই। বিভিন্ন এলাকায় অরক্ষিত বাঁধে পুরোপুরি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আবার বাঁধের খুব কাছে থেকে এস্কেভেটর দিয়ে অনেক প্রকল্পে মাটি তোলা হচ্ছে। বাঁধের কাজের কোন গতি না আসায় কৃষকরাও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন’র কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান সিলেটের ডাককে বলেন, ধর্মপাশা, শাল্লা, জামালগঞ্জ, সদরসহ কোথাও তেমন কাজ হয়নি। কাজের তেমন গতি নেই। তাই, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে না। এজন্য আমরা উদ্বিগ্ন। সদর ও বিশ্বম্ভরপুরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে সঠিক মানের কাজ করার জন্যে কঠোর নজরদারীর প্রয়োজন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর বিভাগ-১) মোঃ সবিবুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত ২০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। নানা কারণে একটু সময় গেছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্নের জন্যে সকলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্য নিয়েই কাজও চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শতভাগ কাজ শেষ হবে। অনিয়ম করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
উল্লেখ্য, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জের হাওরসমূহে ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষাবাদ করা হয়েছে। চাষকৃত জমি থেকে এবার ৮ লাখ ৮৭ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। সুনামগঞ্জ জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ ফরিদুল হাসান সিলেটের ডাককে এই তথ্য জানিয়েছেন।