ফসল রক্ষায় বিরামহীন প্রচেষ্টা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ৪:৩৮:০৩ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী
হাওরের পর হাওরজুড়ে সবুজ ধান গাছ। ধানের শীষ বেরিয়ে মাথা নিচু করেছে। পাকতে সর্বসাকুল্যে লাগবে আরও ৮ থেকে ১০ দিন। কিন্তু ঢলের পানি কৃষকের একমাত্র স্বপ্ন বোরো ধানকে পাকার আর সুযোগ দিল না। কৃষকের ঘাম ঝরানো শ্রমের সোনালী ফসল চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে। উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে গতকাল মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার বৃহৎ চন্দ্রসোনারতালসহ কয়রানি হাওর, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কানলার হাওর, শাল্লার কৈয়ারবন ও পুটিয়া হাওর, জগন্নাথপুর ও দিরাইয়ের ঘোনা, ঘোটাইরা, জোয়ালভাঙ্গা হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। এর আগে বাঁধ ভেঙে তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর, শাল্লার মুনয়ারখলার ফসল তলিয়ে যায়। দেশে ধান উৎপাদনের শীর্ষ জেলা সুনামগঞ্জে এভাবেই প্রতিদিন হাওরের ফসল বানের পানিতে ডুবে যাচ্ছে। আর ফসল হারিয়ে হাওরপাড়ে চলছে কৃষকদের কান্নার রোল। অন্য হাওরগুলোর ফসল রক্ষায় কৃষকরা রাত জেগে বাঁধে মাটি দিচ্ছেন, দিচ্ছেন জিও ব্যাগ ও মাটি ভর্তি বস্তা। হাওরাঞ্চলের মসজিদসমূহে কেবল বাঁধ রক্ষা করতে মাইকিং করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জের কোনো হাওরের ফসলই এখন আর ঝুঁকিমুক্ত নয়। হাওরাঞ্চলে এখন বিরাজ করছে বেদনাবিধূর চিত্র।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে বোরো ফসলরক্ষা বাঁধ সার্বক্ষণিক তদারকি করার জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এতে বলা হয়, পাহাড়ি ঢলের কারণে সুনামগঞ্জ জেলার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় সার্বক্ষণিক তদারকি করার জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা যাচ্ছে ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, হাওরের ফসল রক্ষায় আমরা সার্বক্ষণিক মাঠে থেকে কাজ করছি। পিআইসির সদস্যদেরকে বাঁধে থেকে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সমূহে আমরা যাচ্ছি। সুনামগঞ্জে তেমন বৃষ্টি হচ্ছে না। কিন্তু, মেঘালয় বা পাহাড়ের ঢলের পানিতে নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পানি কমার তো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং পানি বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। কোনো হাওর বর্তমানে নিরাপদ নয়। হাওরের ফসল রক্ষায় সকলকে বাঁধে থাকতে হবে।
জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের চাষাবাদ করা হয়েছে। চাষ হওয়া জমি থেকে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকার ইরি-বোরো ধান উৎপাদনের কথা ছিল।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমার পানি বিপদসীমা ছুঁয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টায় পানির উচ্চতা ছিল ৫ দশমিক ৯৬ মিটার। কেবল সুরমা নদী নয়, যাদুকাটা, রক্তি, বৌলাই, পাটলাই, নলজুর, কালনী, চলতি, ধারাইন, চেলাসহ সব নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ছয় দিনের উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলের পানিতে সবকটি হাওর এখন তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে।
পাউবো বলছে, ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টি হলেই সুনামগঞ্জের নদ-নদীতে অসময়ে পানি উপচে পড়ে। গত ৬ দিনে চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয়ে ৪৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর, শনির হাওর, সমসার হাওর, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর, দিরাইয়ের চাপতির হাওর, টাংনির হাওর, দিরাই-শাল্লার ভরাম হাওর, শাল্লার ছায়ার হাওর, কালিয়াকুটাসহ জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, শান্তিগঞ্জসহ সকল উপজেলার হাওরগুলোর ফসল হুমকির মুখে পড়েছে। সকল হাওরের বাঁধ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কখন জানি কোন বাঁধে ফাটল দেখা দেয়- কোন বাঁধ ভেঙে যায় এমন আতঙ্কে হাওরপাড়ের মানুষরা দিনরাত অতিবাহিত করছেন। মসজিদে মসজিদে বাঁধ রক্ষায় কৃষকদের দ্রুত চলে যাওয়ার ঘোষণা এখন নিত্যদিনের সাথী হয়েছে। হাওর রক্ষায় করা হচ্ছে বিশেষ মোনাজাতও।
এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় জেলার অন্যতম বৃহৎ হাওর ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনারথাল হাওরের ডোবাইল বাঁধটি ভেঙে হাওরে পানি ঢুকছে। এতে হাওরের প্রায় ৩০ হাজার একর জমির আধা পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। গত রোববার ঢলের পানির চাপে বাঁধটিতে কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে উপজেলা প্রশাসন ও পাউবোর কর্মকর্তারা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি মেরামত করেন। কিন্তু, ওই বাঁধসংলগ্ন কংস নদীর পানির চাপ বেড়ে গিয়ে গতকাল বিকেলে বাঁধটি ভেঙে ডোবাইল হাওরে পানি প্রবল বেগে ঢুকতে থাকে। চন্দ্রসোনারথাল হাওরের ডোবাইল ফসলরক্ষা বাঁধটি পাউবোর অধীনে রয়েছে। ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বাঁধটির কাজের জন্য ২২ লাখ ৮১ হাজার ৩০৪ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল পাউবো। বৃহৎ এই হাওরের বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার পর স্থানীয় সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ ফসলডুবির ঘটনাকে কাঁচা ফসলের সমাধি উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেন। তিনি লিখেছেন, ‘সর্বগ্রাসী পানি গতির কাছে দেউলিয়া চন্দ্রসোনারথাল হাওরের হাজার হাজার কৃষক, ডুবাইল বাঁধ ভেঙে রচিত হলো কাঁচা ফসলের সমাধি।’
একই উপজেলার কয়রানী হাওরের ৩০ হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধানও তলিয়ে গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে জয়শ্রী ইউনিয়নের সানবাড়ী বাজারসংলগ্ন সোমেশ্বরী নদীর পানি ঢুকে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়।
ওই উপজেলার আরেকটি বৃহৎ হাওর সোনামোড়ল হাওরের ফসল রক্ষায় শরীয়তপুর, কাজীরগাঁও, শান্তিপুর, ইসলামপুর, গোলকপুর, বেড়ীকান্দা, ফাজিলপুর, দিগজান, প্রতাপপুর, সরিষাকান্দ -ইসলামপুর, বিনোদনপুর, বাগবাড়ী, নোয়াগাঁও, পাথারিয়াকান্দা এলাকায় স্থানীয় কৃষকরা রাতভর বাঁধে কাজ করেন।
শাল্লা উপজেলা সদরের পার্শ্ববর্তী কৈয়ারবন ও পুটিয়ার হাওরে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙে মুহূর্তেই ছোটো ছোটো দুই হাওরের প্রায় ৪০ হেক্টর জমির ধান চোখের সামনেই তলিয়ে যায়। হাওরের বাঁধটি পাউবোর আওতার বাহিরে ছিল। তবে, ফসল রক্ষায় গেল তিনদিন ধরে স্থানীয় কৃষকেরা দিনে রাতে মাটি কেটেও বাঁধটিকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। অন্যান্য বছর এই বাঁধে প্রকল্প দেয়া হলেও এবছর কোনো প্রকল্প না দেয়ায় প্রথম দফায়ই হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে বলে স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন।
নলুয়ার হাওর জেলার সর্ববৃহৎ হাওরের মধ্যে অন্যতম। হাওরের বেশির ভাগ জমি জগন্নাথপুর উপজেলায়। হাওরের ভূরাখালী এলাকার অবস্থিত ৫ ও ৬ নম্বর প্রকল্পের বাঁধ রক্ষায় ভূরাখালী গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। এছাড়া ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রকল্পের কিছু অংশ ধসে যাওয়ার পর নির্মাণ করা হয় বিকল্প বেড়িবাঁধ। বাঁধ দুটিকে শক্তিশালী করতে চিলাউড়া গ্রামের কৃষকরা রাতভর স্বেচ্ছায় কাজ করেন। হাওরের ভেটুখালী বেড়িবাঁধ নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়। বাঁধটি দুর্বল হয়ে যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় কাদিপুর গ্রামের লোকজন দিনরাত কাজ করেন।
দিরাই উপজেলার ভরাম হাওরের তুফানখালি বাঁধে ফাটল দেখা দেয়ায় স্থানীয় কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম, ইউএনও মাহমুদুর রহমান মামুনসহ কর্মকর্তারা ছুটে যান। পাউবোর পরামর্শ অনুযায়ী হেমারিং করা হয়, বাঁধে নতুন করে মাটি ভর্তি বস্তাও দেয়া হয়। একাধিকবার তুফানখালি বাঁধ ভেঙে ভরাম হাওরডুবির ঘটনা ঘটেছিল। ফলে এই বাঁধ নিয়ে কৃষকদের মাঝে সবসময় আতঙ্ক থাকে। চাপতির হাওরের বৈশাখী বাঁধে স্থানীয় ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে রাতভর কৃষকরা কাজ করেন। এছাড়াও সকল হাওরের ফসল রক্ষায় দিনরাত লোকজন বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।
০ তাহিরপুরে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তাহিরপুরের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওরের বাঁধসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্যে যাদুকাটাসহ সকল নদীতে মালবাহী নৌকাসমূহের চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন।
তাহিরপুরের ইউএনও মো. রায়হান কবির স্বাক্ষরিত এক পত্রে এই নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে বলা হয়, বাঁধসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপজেলার যাদুকাটা, পাটলাই ও বৌলাইসহ সকল নদীতে মালবাহী নৌকাসমূহের চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। বড়ছড়া, বাগলি, কলাগাঁও শুল্কস্টেশন এবং ফাজিলপুর (যাদুকাটা-১ ও ২ বালুমহাল ) হতে কোন মালবাহী নৌযান ছেড়ে যেতে পারবে না।