ফারহাতের বিজয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মার্চ ২০২১, ৫:৪৬:৩৮ অপরাহ্ন

ফাহমিদা ইয়াসমিন
সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশটা ঝকঝকে হলেও চারদিক ভারি করে তুলছে অবিরাম গুলির শব্দ। কয়েকদিন ধরেই এমন শব্দে কেউ ঘুমাতে পারে না। ফারহাতের দাদু একটু পর পর রেডিও চালু করে দেশের খবর শুনছে। ফারহাতের বাবা প্রায় বিশ দিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। বাড়ির সবাই শুনেছে তার বাবা এখন ভারতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ফারহাতের মায়ের মুখে কিছু হারানোর শোক যেনো লেগেই আছে।
পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করেছে। অনেক মানুষকে তারা বন্ধুকের গুলিতে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। হয়তো এই দেশের সব কিছু তাদের আয়ত্বে চলে যাবে। ফারহাতের মা ফারহাতকে ডেকে বলেÑ
বাবা তোমার সবকিছু গোছানো হয়েছে। তুমি রেডি হও। একটু পর আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হবো।
ফারহাতের মনে অনেক প্রশ্ন ভর করে। কিন্তু এখন প্রশ্ন করার সময় নেই। তার মনে ভয়, যদি আম্মু বেঁকে বসে তাহলে তো গ্রামে যাওয়া হবে না। তাই সে কোনো কথা না বাড়িয়ে দ্রুত রেডি হওয়ার জন্য ঘরে যায়। কতোদিন গ্রামে যাওয়ার জন্য সে বায়না করেছে। গতো কয়েক বছরে তো সে গ্রামে ঈদও করেনি। অথচ আগে প্রতি ঈদেই গ্রামে যেতো। কেমন আছে তার বন্ধুরা, খেলার সাথি তহমিনা, নদী, রায়হান। নিশ্চয়ই তারা তাকে দেখতে পেলেই খুশিতে নাচতে থাকবে। এবার বাড়িতে গিয়ে পুকুর পাড়ে দোকান বসাবে। কলাগাছের পাতার ডাটা দিয়ে ঘোড়া বানাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই তার দাদু দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে বললোÑ
তোমরা তাড়াতাড়ি বের হও। আর দেরি করা যাবে না। পাকিস্তানিরা শহরে ঢুকে গেছে।
আচ্ছা বাবা, আমরা রেডি। চলেন বের হবো, বললেন ফারহাতের মা।
তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতের আঁধারে হাঁটতে শুরু করে ফারহাতেরা। পথ চলতে চলতে ফারহাত থমকে দাড়িয়ে দাদুকে বলেÑ
চলো দাদু, একটু সুনীলদের বাড়িতে যাই। সুনীলকে বলে যাই আমরা গ্রামে যাচ্ছি। সে অনেক খুশি হবে। অনেকদিন তো তোমরা আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দাও না।
দাদু মাথা নামিয়ে মাটির দিকে তাকায়। কোনো কথা মুখে নেই। ফারহাতের মা তাকে বলেÑ
বাবা, আজকে সময় নেই। দেরি করা ঠিক হবে না। এমনি তোমার বাবার খবর জানি না কতোদিন। মনটা বিষণ্ন থাকে। চলো বাবা, আজকে না।
ফারহাত নাছড় বান্দা। কিন্তু দাদু তাকে কিভাবে বুঝাবে যে, একটু আগেই সুনীলদের বাড়ির সবাইকে পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরেছে। একটু পর তাদের বাড়িতেও পাকিস্তানিরা হামলা করার জন্য যাবে। দাদু ফারহাতকে শুধু বললোÑ
দাদু এখন জিদ করার সময় নয়। চলো যেতে হবে।
মধ্য রাত ফারহাতেরা ক্লান্ত। পথ চলতে পারছে না। ঘণ্টা খানেক হাঁটলেই তারা পৌঁছে যাবে গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। নির্জন পথে থাকার মতো পরিবেশও নেই। যদিও খুব দূরে না মানুষের আনাগোনা। শহরের অধিকাংশ মানুষই পায়ে হেঁটে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে। পরিচিত অপরিচিত অনেকের সাথে পথিমধ্যে সাক্ষাত হয়েছে বলেই এতো পথ হাঁটার মতো মনোযোগ ছিলো। এখনো তাদের সাথেই আছে অনেকে। তারাও পার্শ্ববর্তী গ্রামে যাওয়ার জন্য শহর থেকে ফিরেছে।
হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। চারিদিকে গুলি। এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ার শব্দ। ফারহাতের দাদু ও মায়ের মনে মৃত্যু ভয়। একজন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে বললোÑ
এখানে থাকা নিরাপদ না। চলেন একটু দূরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আছে। সেখানে আশ্রয় নিতে হবে।
জীবনের তাগিদে শরীরের সকল বাঁধাকে অগ্রাহ্য করে তারা ছুটে চললো ক্যাম্পে। ক্যাম্পে পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড দেখে ফারহাতের মনে যুদ্ধ করার বাসনা তৈরি হলো। তাছাড়া তার বাবার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথাও মনে পড়তে থাকলো। সেও দাদুর কাছে গিয়ে বললোÑ
আমিও যুদ্ধ করবো।
দাদু কোনো কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। ফারহাত মুক্তিবাহিনীর সবার সাথে তার মনের কথা বললো। কিন্তু কমাণ্ডার বললোÑ
তোমাকে দিয়ে কি করাবো। তুমি তো ছোট বাবু।
ফারহাত কারও কথা শোনার মানুষ না। সে দেশের জন্য কিছু করতে চায়। বাবার মতো দেশের কাজে নিজেকে দাড় করাতে চায়।
পরের দিন সকালে পরিকল্পনা গোছানো হলো, দূরের একটা ক্যাম্পে থাকা পাকবাহিনীর ক্যাম্পের খবর সংগ্রহ করতে হবে। কে যাবে সেই কাজে। এই কথা শুনে ফারহাত বললÑ
আমি যাবো।
ক্যাম্পের অন্যরা ভয় পেলেও কমাণ্ডার বললোÑ
ফারহাতেই এটার জন্য উপযুক্ত।
প্লান মাফিক ফারহাত অনাথ শিশুর মতো ছেড়া পুরানো পোশাক পরে অনিশ্চিত জীবনের পথে হাঁটতে থাকলো। কিছুটা কষ্ট হলেও বুদ্ধি খাটিয়ে সব সংবাদ সংগ্রহ করে রাতের আধারেই ক্যাম্পে ফিরলো।
এবার তার দায়িত্ব পড়লো ক্যাম্পের ভেতরের খবর জানতে। ফারহাত বসে বসে বুদ্ধি আটলো। গাছে উঠে ক্যাম্পের ভেতরের প্রস্তুতি সে সংগ্রহ করবে। তাই করলো। রাতেই গিয়ে কাছাকাছি একটা গাছে উঠে বসে থাকে। সারারাত জেগে জেগে পাকিস্তান বাহিনীর প্রস্তুতি দেখে নিয়ে চুপিচুপি ক্যাম্পে ফিরে আসে। এভাবে নদী সাতরিয়ে, খাল পেরিয়ে, গাছ মাড়িয়ে পাকিস্তানিদের সকল খবর সংগ্রহ করতে করতে মুক্তিক্যাম্পে ফারহাত হয়ে ওঠে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যোদ্ধা।
কমাণ্ডার তার মুখে সব শুনে সে ভাবেই আক্রমণের ছক আঁকে। এই ক্যাম্পের সফলতাও আসতে থাকে। পাকবাহিনীর ছোট ছোট সব ক্যাম্পগুলোই ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু রয়েগেছে এই অঞ্চলের মূল ক্যাম্পটি। এটি খুবই শক্তিশালী। এখান থেকে খবর সংগ্রহ করা খুবই দুস্কর।
মূল ক্যাম্পটির ব্যাপারে রাতে জরুরি মিটিং বসেছে। এই ক্যাম্পটির কি করা যায়, কি ভাবে এটি ধ্বংস করা যায়। ফারহাতকেই এই ক্যাম্পের খবর আনতে হবে। তবে সেটা সহজ হবে না, হয়তো ফারহাত আর সেখান থেকে ফিরে নাও আসতে পারে। সে কথা ফারহাতও ভালো ভাবে জানে। তবু খবর তো আনতেই হবে।
আলোচনা চললেও কোনো সমাধান আসছে না। কমান্ডান খুবই চিন্তিত, কিভাবে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। সব শেষে ফারহাত বলে উঠলোÑ
কমান্ডার সাব, আমার একটা প্লান আছে।
কমান্ডার আগ্রহ নিয়ে ফারহাতের দিকে তাকালÑ
বলো কী তোমার প্লান।
কমান্ডার সাব, আমি যদি ওখানে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে না ফিরে আসি, তাহলে আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। তার চেয়ে এক কাজ করিÑ আমরা সকলে একসাথে প্রস্তুত হয়ে ওখানে যাবো। আপনারা সকলে বাহিরে নিরাপদ দূরত্বে ওঁৎপেতে থাকবেন, আমি ভেতরে যাবো খবর সংগ্রহ করতে। আমার শরীরে শক্তিশালী বোমা বেঁধে নিয়ে যাবো। যদি দেখি যে আমি ধরা পড়ে গেছি তবে ওদের সবচেয়ে দুর্বল স্থানে বোমার বিষ্ফোরণ ঘটাবো। আর তখন আপনারাও আক্রমণ চালাবেন। এভাবেই আমরা এই ক্যাম্প ধ্বংস করতে পারবো।
ফারহাতের কথা শুনে সবাই অবাক। কমান্ডার এসে ফারহাতকে জড়িয়ে ধরলো। কথামতো সকলে প্রস্তুত হলো। হাতে হাত রেখে সপথ নিলোÑ হয় আমরা সকলে শহিদ হবো, নয়তো বিজয়ী হবো।
পরদিন সকালে ফারহাত পাকক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে গেলো। আর বাকি সবাই কিছুটা দূরে আত্মগোপন করে রইলো।
সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকাল ফারহাতের কোনো খবর নেই। কোনো সংকেতও নেই। সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে কোনো সংকেত পাওয়ার আশায়।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। সবে অন্ধকার নেমেছে। কমান্ডার সকলকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে বললো। আসংকা-ফারহাত হয়তো ধরা পড়েগেছে।
কমান্ডারের কথা মতো সকলে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করেছে মাত্র অমনি বিকট শব্দে কয়েক হাজার বোমার বিষ্ফোরণ। চোখের নিমিষেই পাকবাহিনীর মূলক্যাম্প সম্পূর্ণ উড়ে গেলো।
সকলে একসাথেÑ জয় বাংলা বলে গর্জন করে উঠলো।
কমান্ডার ফরহাত, ফারহাত বলে কাঁদতে কাঁদতে বললোÑফারহাত একাই আমাদের বিজয় এনে দিলো। ঠিক সময়মতো ওদের অস্ত্র ভান্ডারে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে। আমরা বিজয়তো পেলাম, কিন্তু হারিয়ে ফেললাম অনেক বড় এক মুক্তিযোদ্ধাকে। ফারহাতের এই রক্ত বৃথা যেতে দিবো না। বাংলাদেশকে আমরা স্বাধিন করবই। ইনশাআল্লাহ। জয় বাংলা।