ফারহানের না ফেরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ মার্চ ২০২১, ৩:৩৭:৫৮ অপরাহ্ন

ফাহমিদা ইয়াসমিন
চারদিক ভয়াবহ অবস্থা। কারো চোখে-মুখে সামান্য স্বস্তির চিহ্নও নেই। এমন দিনে যে যার মতো করে বাঁচার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে লও সবাই সবাইকে যে সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে, এটা ভাবতেই ফারহানের মনে বেশ আনন্দের অনুভূত হয়। যদিও সময়টা এখন আনন্দের নয়; কষ্টের, ভয়ের, হতাশার। ফারহানরাও প্রতিবেশীদের মতো যেকোনো মুহূর্তে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। এসব যখন ফারহানের ছোট্ট মনে খেলা করছে তখনই তার দাদুর গলায় আওয়াজ। তিনি উচ্চ স্বরে সবাইকে বললেন, তোমরা দেরি কোরো না। দ্রুত বের হও, গ্রামের দিকে যেতে হবে। এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়।
ভয়, ত্রাস, আতঙ্ক নিয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে আবদুল মতলেবের পরিবার, পোড়ামাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে। অনেকগুলো মৃতদেহ ডিঙিয়ে, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেদ করে নদীর ঘাটে এসে পৌঁছাল ফারহানরা। দাদু আগেই একটা ছোট্ট পাল তোলা ডিঙি নৌকা ঠিক করে রেখেছিলেন। পরিবারের সবাই মিলে নৌকায় করে গ্রামের পথে রওনা হচ্ছে। নৌকায় করে যেতে যেতে নদীর দুই ধারের গ্রামগুলোতেও আগুন জ্বলতে দেখল। আগুনের তাপ যেন মাঝ নদীতেও ফারহানদের শরীরে লাগছে! ছোট্ট ফারহানও বুঝে গেছে এখন দেশে কী হচ্ছে! সে শুধু ভাবছে কেন এমন হয়? কেন মানুষ মানুষকে মারে? সবার প্রিয় বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে?
পালে বাতাস পেতেই দারুণ গতিতে ছুটছে নৌকা। মাঝি দক্ষ হাতে হাল এবং পাল দুটোই সামলাচ্ছে। গ্রামের কাছাকাছি প্রায় এসে গেছে। বুকের ভেতরে ধুকধুকানিটা বেড়েই চলছে। সবার চেহারায় একটা ভীতির ছাপ স্পষ্ট। একটু বাদেই গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে যাবে। ফারহান এর আগেও অনেকবার এসেছে গ্রামের বাড়িতে। সেই আসার সময় খুশিতে তার বুক ভরে যেত। গ্রামের বাড়িতে তার আসার খবর পেলে, চাচাতো ভাই-বোন তুহিন, তাহেররা সকাল থেকেই নৌকাঘাটে অপেক্ষা করত। অথচ আজ, কেউ নেই কোথাও। ভাবতেই মনটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে পৌঁছে যায় গ্রামের বাড়িতে। এই বাড়িতেই তার দাদা-দাদুর জীবনের সুন্দর সময় কেটেছে। তার বাবার, এমনকি তার নিজের জন্মও এ বাড়িতেই হয়েছে।
গ্রামের বাড়িতে এসে পুরো গ্রামটাই যেন ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছে। সহজে কাউকে চোখে পড়ে না। সবাই লুকিয়ে থাকে। গ্রাম থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামটিতে মিলিটারি ক্যাম্প। গ্রামের অনেকেই মিলিটারিদের পক্ষে! পাশের বাড়ির করিম এসে তার দাদুর কাছে বলে গেলÑ‘শুনলেন মতলেব ভাই, রফিককে তো মিলিটারিরা মইরা ফেলছে!’
এ খবরটা ফারহানও শুনেছে। রফিক ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। যতবার গ্রামে এসেছে রফিক ভাই তাকে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। বয়স কত হবেÑপনেরো বা ষোলো। তিনি নাকি মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কাজ করতেন।
ফারহান ভাবে, ‘আমি রফিক ভাইয়ের মতো বড় হলে তো এখন মুক্তিবাহিনীতে গিয়ে যুদ্ধ করতে পারতাম। আচ্ছা আমার তো এখন বয়স আট বছর। মা মনে হয় ভুল গুনেছেন, আমার বয়স দশই হবে। আমার বয়সের কেউ কি মুক্তিবাহিনীতে আছে? না থাকলেও আমি যাব। এভাবে নিজেদের রক্ষা করার জন্য লুকিয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। ধীরে ধীরে ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে। বরং সাহস করে প্রতিবাদ করলে অনেকে বেঁচে যাবে। শুরুতে কয়েকজনে মিলে প্রতিবাদ করলেও পরে গ্রামের অন্যরাও মনে সাহস-শক্তি ফিরে পাবে। তাহলে একসময় আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না। আর সবাই মিলে প্রতিবাদ করতে পারলে মিলিটারিরাই দেশ ছেড়ে পালাবে।
পরের দিন সকালে ফারহান বাজারে যায়। সেখানেই সালাম দাদুর সাথে দেখা! দাদু কাছে ডেকে বললেন, কি ফারহান, তোমরা গ্রামে কবে এলে? তোমার দাদুও এসেছে নাকি?
হ্যাঁ, এসেছেন তো।
কোথায় আছে?
দাদু বাড়িতেই আছেন।
আচ্ছা, দাদুকে বলবে আমি বিকেলে আসব তার সাথে দেখা করতে।
সালাম দাদুর সাথে কথা শেষ করে ফারহান একটা কলম কিনে বাড়ি ফিরে আসে।
বিকালে সালাম সাহেব আসেন। মতলেব সাহেবের সাথে দীর্ঘক্ষণ বসে কথা বললেন। তারা সহপাঠী। ফারহান পাশের রুমেই শুয়ে বই পড়ছিল। এখন পড়া থামিয়ে দাদুদের কথা শুনছে।
সালাম দাদু এই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক। তারা দুজনে মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। মুক্তিবাহিনীর একটা ক্যাম্প ফারহানদের গ্রামেই, আরেকটা পাশের গ্রামে গোপনে কাজ করছে।
তাদের আলোচনা শুনে ফারহান বুঝতে পারলÑএবার বাংলার মানুষ যুদ্ধ করবে। ফারহান মনে মনে ভাবে, আমিও যুদ্ধ করব।
পরের দিন বিকালে ফারহান গিয়ে সালাম দাদুর বাসায় হাজির। দাদুকে বলল, দাদু আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করব, প্রয়োজনে জীবন দেব!
দাদু হেসে বললেন, তুমি তো এখনো ছোট।
তাতে কী, বিশ্বাস করেন আমি অনেক কাজ করতে পারব। তা ছাড়া আমি খুব বেশি ছোটও না। আমাকে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে চলেন না।
ফারহানের জোরাজুরিতে সালাম সাহেব একসময় ফারহানকে নিয়ে ক্যাম্পে গেলেন। ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা ফারহানের কথা শুনে প্রথমে হাসলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারলেন ফারহানকে দিয়ে অনেক কাজই হবে। তা ছাড়া এভাবে সবাই এগিয়ে এলে আমাদের দেশ স্বাধীন হবেই হবে। ক্যাম্পে অন্যদের মনোবল যেন বেড়ে গেল!
এর পর থেকে ফারহান ক্যাম্পে হালকা ট্রেনিংসহ ফাই-ফরমাশ খাটে। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সে করে, তা হলোÑএক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে ব্যাগে করে গ্রেনেড, হাতবোমা পৌঁছে দেয়। ও ছোট বলে অন্যরা সন্দেহই করে না।
এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল। দিন দিন মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়েই চলছে। মাঝে মাঝেই মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের সুসংবাদ আসত। ক্যাম্পের সবাই তখন আনন্দিত হতো এবং দোয়া করত।
একদিন সকালে ক্যাম্পে খবর এলো, আজ রাতে মিলিটারি পাশের গ্রামের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করবে।
সব কিছু শুনে কমান্ডার কুদ্দুস সাহেব বললেন, আমরা গিয়ে ওই ক্যাম্পে সহযোগিতা করব। সবাই এককথায় রাজি।
রাত ৮টার দিকে রওনা হলো সবাই। অস্ত্র নিয়ে চলল সবাই, সাথে ফারহানও আছে, তবে ফারহানকে কোনো অস্ত্র দেওয়া হয়নি। ও নিরাপদ দূরত্বে হাতবোমার ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করবে। প্রয়োজন হলে সহোযোগিতা করবে।
তারা জঙ্গলে অপেক্ষা করছে। রাত ১১টার দিকে হেডলাইট বন্ধ করে দুই গাড়ি মিলিটারি এসে নামল। কমান্ডার কুদ্দুস মিয়ার আদেশে প্রথম গুলি করা হলো। মিলিটারিরা গাড়ির কভার নিয়ে পজিশন নিল। শুরু হলো গোলাগুলি। একটা গুলি এসে কমান্ডার কুদ্দুস মিয়ার বুক ভেদ করল। সহকারী কমান্ডার আদেশ দিল পিছু হটার। সব মুক্তিযোদ্ধা পিছু হটল। কিন্তু কমান্ডার কুদ্দুস মিয়ার দেহ আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ফারহান।
সকল মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার পরই তার কাছে থাকা হাতবোমার ব্যাগে একসাথেই বিস্ফোরণ ঘটাল। সাথে সাথেই দুই গাড়ি মিলিটারিসহ ফারহান ও কমান্ডারের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
পরদিন সকালে সূর্য উঠলে মুক্তিযোদ্ধারা ফারহানের জন্য গভীর কষ্ট মিশ্রিত শ্রদ্ধা নিয়ে গ্রামের স্কুলে বাংলার লাল-সবুজ বিজয়ের পতাকা উড়ালো।