বঙ্গবন্ধু : একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের দৃষ্টিতে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুন ২০২২, ৫:০০:০২ অপরাহ্ন

অনুবাদক : সৈয়দ মবনু
ইয়াহিয়া খানের চিঠি এবং শেখ মুজিবের ক্ষুব্ধতা :
পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব, প্রধান সচিব, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী এম খুরশেদ ৪ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। তারা হোটেলে না গিয়েই সোজা শেখ মুজিবের বাসায় চলে যান। তাদের এই আসা হঠাৎ হয়েছিলো। তারা একাকীত্বে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন এবং তাঁকে ইয়াহিয়া খানের মহর লাগানো একটি পত্র দেন। আমার তখনই এই চিঠি দেখার ভাগ্য হয়েছিলো। অবশ্য বছরের পর বছর থেকে এই চিঠি বাংলাদেশের জাতীয় আরকাটোজে সংরক্ষিত রয়েছে। এই চিঠিতে ইয়াহিয়া খান স্পষ্ট করে বলেন যে, তিনি ‘এখন যেন স্বাধীনতার ঘোষণা না করেন। তিনি তা থেকে বড় উপহার দেওয়ার জন্য আসতেছেন।’ শেখ সাহেব এই চিঠি পড়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি খুরশেদ সাহেবকে বললেন; ‘আপনি আমার দলের লোক, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করছেন ইয়াহিয়া খানের?’ তিনি শুধু এই চিঠির কোন নোট নেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকারই করেননি, বরং জীবনে আর কোনদিন খুরশিদ সাহেবের সাথে কথাও বলেননি। বিশ্বাস যখন ভঙ্গ হয়ে যায় তখন এমনই হয়। খুরশিদ সাহেবেরও আজীবন এই কষ্ট ছিলো যে, তাঁর পক্ষ থেকে এমন খারাপ ভুল কীভাবে সংগঠিত হলো? জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মতো রাজনীতিতেও বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রাজনৈতিক দৃশ্যপট হঠাৎ পাল্টে যাওয়া
১ লা মার্চ থেকে অবস্থা যেদিকে মুড় নিয়েছিলো তা থেকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট হঠাৎ পাল্টে যায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অবস্থা এমন ছিলো যে, আওয়ামী লীগ মোটামোটি চাপে ছিলো। এখানে একদিকে ইয়াহিয়া খানের চাপ ছিলো, অন্যদিকে মাওলানা ভাসানির পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতার শ্লোগান। তৃতীয়ত ভূট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা এমন করে রেখেছিলো যে, সেখানে খুব কম লোক এমন ছিলেন যে, যিনি সাহসিকতার সাথে দেশ রক্ষার কথা ভাববেন বা বাস্তবতার আলোকে কথা বলবেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে ঘোষণা বা বক্তব্যই আসছে তা পূর্ব পাকিস্তানে লেগে থাকা আগুনকে বৃদ্ধির জন্য পেট্রোলের ভূমিকা রাখছে। দৌলতানা এবং আব্দুল কায়ূমের মতো রাজনৈতিকও অবস্থার মোকাবেলা করা থেকে পিছু চলে যাচ্ছেন। মাওলানা শাহ আহমদ নূরানী, নুর খান এবং এয়ার মার্শাল আসগর খান বা মালিক গোলাম জিলানীর বক্তব্য বা ঘোষণাকে কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না, কারণ তাদের তিনজনের কেউ জাতীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি, আর মাওলানা নূরানী রাজনীতিতে নতুন। তিনি নিজের দলের বাইরে অন্য দলের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারেননি। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ভূট্টো দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্যে শাসন করার জন্য দেশ ভাগের নীতি ঘোষণা করে দিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কিত কিছু দল যুক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পার্লামেন্টের ছবিই কূয়াশাচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে তাকে এজন্য গ্রহণ করা হচ্ছে না যে, সে দেশের এক অংশ থেকে ভোট পেয়েছে, অন্য অংশে তার কোন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কিত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল পিপি সহ, মাওলানা ভাসানী এবং আতাউর রহমান খানের সমর্থকেরা এক সাথে ছিলেন। মাওলানা ভাসানী তো স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘোষণাই করে দিয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় যে, মাওলানা পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ রাজনৈতিক দলগুলোর নিকট রক্ষক ছিলেন। ভূট্টো কর্তৃক এক দেশে দুই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করার পরও শক্তির উৎসের কাছে পরাজিত নয়, প্রিয় ছিলো।
রাজনৈতিকদের গোলটেবিল বৈঠকের তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করার পর ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চ ঘোষণা দিলেন যে, জাতীয় পার্লামেন্টের বৈঠক ২৫ মার্চে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ‘সামরিক শাসন প্রত্যাহার’ এবং ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’ ছাড়া পার্লামেন্ট বৈঠকে অংশগ্রহণের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেদিলো।
ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য ঢাকায় আসতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু যখন পরামর্শক এবং সংবাদপত্রগুলো জোর দিয়ে বললো তখন তিনি ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়ে যান। প্রেসিডেন্টের ভবনের আশপাশ অত্যন্ত নিরাপত্তার বেষ্টনীতে নিয়ে আসা হলো। চারদিকে কাটাতারের বেড়া দেওয়া হলো এবং এক হাজারের মতো নির্বাচিত ব্যক্তিকে বিল্ডিং-এর হেফাজতের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলো, যাদের সরকারী নাম ‘আইওয়ানে সদর’ ছিলো। অবস্থা এই পর্যন্ত সামনে গিয়েছে যে, ২৩ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সাথে চূড়ান্ত কথাবার্তার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের যে গাড়ি ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে প্রবেশ করছে তার মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিলো। আলোচনার শেষদিকের বিষয়গুলো শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র ছিলো। নতুবা ‘লাড়কানা’য় ইয়াহিয়া-ভূট্টো এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েগিয়েছিলো যে, এটাই সঠিক সময় বাঙালিদের থেকে প্রাণ বাঁচানোর। এর জন্য পদ্ধতি একটা ছিলো যে, আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, কিন্তু এরমধ্যে একটি খারাপি ছিলো যে, এই পদ্ধতিতে সম্পদের বন্টনকে নীতিগতভাবে এবং বাকী বিষয়গুলোকে কর্মের দিকে গ্রহণ করতে হবে। আরেকটা খারাপি ছিলো সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিলো যে, পূর্ব পাকিস্তানে শক্তির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে দুর্বল করে দেওয়া। এরপর ভূট্টোর বক্তব্যানুসারে পঁচিশ বছর পর্যন্ত বাঙালিরা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। খান আব্দুল কাইয়ূম খানও এই খিয়াল প্রকাশকারিদের মধ্যে একজন ছিলেন।
সাবেক তথ্যমন্ত্রী জেনারেল শের আলী খানের বক্তব্য
৬ মার্চ সংবাদপত্রেই ইয়াহিয়া খানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী জেনারেল শের আলী খানের এক বিস্তারিত বক্তব্য প্রকাশিত হয়। যারমধ্যে তিনি ইয়াহিয়া খানের ‘বিশেষ উপদেষ্টা’র তৎপরতার পর্দা উঠিয়ে দেন। জেনারেল শের আলী খানের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করছি;
‘দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ি নে দিনে অত্যান্ত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেমিকেরা সবাই শঙ্কিত যে, দেশের ভবিষ্যত কি হবে? কিছুদিন থেকে আমার বন্ধুরা আমাকে চাপ দিচ্ছেন যে আমি এই বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করি। আমি মনে করি এই সময়ে চরম বিচক্ষণতা এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে বিষয়ের সমাধান করা জরুরি। সময়ের প্রয়োজন হলো যে, বর্তমান তিক্ততা বৃদ্ধি করা থেকে হ্রাস করা জরুরি। আমার থেকে আগে কোন সম্মানিত বন্ধু এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব দেশের অবস্থার ব্যাপারে নিজের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে নিয়েছেন। আমি আজ জাতির সামনে বাঙালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বেলুচী, অথবা পাঠান হিসাবে বক্তব্য রাখছি না। আমি আমার নামের সাথে মুহাজির শব্দটিও ব্যবহার করতে চাই না। কারণ, ২৩ বছর যাওয়ার পরও যদি পাকিস্তান মুহাজিরদেরকে এই অনুভূতি দিতে না পারে যে, এখন তারা মুহাজির নয়, তবে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক কথা। এজন্য আমি একজন পাকিস্তানি এবং সৈনিক হিসাবে এই বক্তব্য দিচ্ছি। আমার এই কথা স্পষ্ট অনুভব হয়েছে যে, বর্তমান সামরিক শাসনের সময় আমি তথ্য এবং জাতীয় বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব আদায় করে নিয়েছি।’
‘ইতিহাসের ঘটনা থেকে একটি সত্য বেরিয়ে আসে যে, যখন কোন জাতি তার নিজের মৌলিক নীতিকে ভাঙে তখন সে খারাপ অবস্থার মধ্যে সমস্যাগ্রস্থ হয়ে যায়। এরপর এই জাতি যেদিকেই অগ্রসর হয় তা পশ্চাদপসরণ হয়ে থাকে। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি এই বিষয়ে ব্যাপক বক্তব্য দিয়েছেন, তাই এ বিষয়ে আমি আর বলতে চাচ্ছি না। আমি শুধু সেই বিষয়টি বলতে চাচ্ছি যে, পাকিস্তানের মূল ভিত্তি কি? দুনিয়ায় দুটি দেশ নীতিগত কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; এর একটি পাকিস্তান এবং অন্যটি ইসরাইল। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পশ্চিমাদের গোপন ষড়যন্ত্রের ফসল হিসাবে ইসরাইল প্রকাশ্যে আসে। পশ্চিমারা তাদের স্বার্থ রক্ষায় ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করেছিলো, তাই আজ তাদের বেঁচে থাকার মূল নীতি হলো পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং তারা তা খুব শক্তভাবে করে যাচ্ছেও। আমাদের জন্য জরুরি ছিলো যে, আমরা আমাদের গতিশীল শক্তিকে খারাপ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো দুটি জাতীয় নীতিতে। আমার সৈনিক ভাইদের সাথে আমি দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছি। তারা এই কথার স্বাক্ষী যে আমি সুযোগ পেলেই তাদেরকে প্রায় প্রশ্ন করেছি যে, আপনারা প্রথমে মুসলমান, না প্রথমে পাকিস্তানী? এই মানুষগুলোকে প্রথমে কিছু বলা হয়নি। তারা এ কথা বলতেন যে, ‘জনাব আমরা পাকিস্তানী এবং পাকিস্তানের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।’ আমি তখন তাদেরকে বলতাম যে, যদি আপনারা প্রথমে মুসলমান না হতেন তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতো না। এক সৈনিক এজন্য লড়াই করেন যাতে দেশ তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের উপর দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।’
‘প্রত্যেক জাতির জন্য আত্ম-পরিচয় থাকা জরুরি। তাই আমাদের আত্ম-পরিচয়ের উপর কোন পাকিস্তানীর সন্দেহ রাখা যাবে না। আমি আমার মন্ত্রীত্বের সময়ে বারবার এই বাস্তবতা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি যে, কোন জাতি নিজের চলমান সংঘবদ্ধ শক্তি ছাড়া উন্নতি করতে পারবে না। আমি এই ব্যাপারে আমার প্রতিবেশি বড়দেশ চীনের উপমা দিয়ে থাকি। আপনারা সবাই সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে পড়েছেন বা অবগত আছেন, যা মাউসেতুং শুরু করেছিলেন। এর কারণ শুধু এই ছিলো যে, চীনে কমিউনিস্ট নীতি প্রতিষ্ঠার পর বিশ বছরের মধ্যে সেখানে বিদেশী প্রভাব বিস্তার শুরু হয়েগিয়েছিলো। তিনি তখন নিজেদের নীতি রক্ষায় অত্যন্ত নজর দিলেন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেন। এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক জাতির নিজ নীতিকে রক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ চলমান শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত রাখা জরুরি হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য পাকিস্তান রাষ্ট্র ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তার মূল নীতিকে শক্তিশালী করার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের পাশের শত্রুদেশ ভারত, যাদের মূল নীতিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা রয়েছে। তারা এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, আমরা আমাদের মহাজির ভাইদেরকে সঠিকভাবে বসতি তৈরি করে দিতে পারিনি। দাতাদের কাছ থেকে আসা দানগুলোও আমরা অস্ত্র খরিদে খরচ করতে হয়েছে। বৈদেশিক ঋণের বুঝাও বেড়ে চলেছে। এই ঋণ দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কী খারাপ প্রভাব ফেলবে সে সম্পর্কেও বিজ্ঞরা পর্যন্ত গাফেল। এর ফলে যা হয়েছে যে, বাইরের প্রভাবে যেমন জাতীয় সংহতির অনুভব অর্জিত হয়নি তেমনি গরিবি এবং বেকারত্বকে দূর করারও কোন উন্নত চেষ্টা করা সম্ভব হয়নি।