বঙ্গবন্ধু : একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের দৃষ্টিতে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২২, ৬:০২:১১ অপরাহ্ন

অনুবাদক : সৈয়দ মবনু
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ
৭ মার্চের সূর্য উদিত হওয়ার সাথে সাথে গোটা দেশের দৃষ্টি চলে আসে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। সবাই অপেক্ষায় ছিলেন রেসকোর্স ময়দান থেকে কি ঘোষণা আসে? নব্বইভাগ থেকে বেশি মানুষের ইচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করবেন এবং ইসলামাবাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার কথা বলবেন। ঢাকার বিভিন্ন অংশে এই শ্লোগান গুঞ্জন হচ্ছিলো যে, ঢাকা না পিন্ডিÑঢাকা ঢাকা। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় মিছিলসমূহ আসতে শুরু করে। ঢাকার বাইর থেকেও মিছিল আসতে ছিলো। নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গি এলাকা থেকে আসা মিছিলগুলোতে মানুষের সংখ্যা ছিলো বেশি। এই দুই এলাকায় যাওয়া-আসার রাস্তায় মিছিল ছাড়া যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। শহরের বেশিরভাগ বিল্ডিং-এ বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিলো। এমন কি সচিবালয়, কেন্দ্রীয় পোস্ট অফিস এবং ন্যাশন্যাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিলো। জাতীয় পতাকা শুধু গভর্ণর হাউসে ছিলো। জনসভায় আসা বেশিরভাগ মানুষের হাতে জান্ডা কিংবা ডান্ডা ছিলো। রাস্তায় দূরদূরান্ত পর্যন্ত যেমন পুলিশ দেখা যাচ্ছিলো না, তেমনি দেখা যাচ্ছিলো না সরকারী অন্যকোন ব্যক্তি। রেসকোর্স ময়দান থেকে দুই মাইল দূরে ধানমন্ডী ৩২ নম্বার সড়কে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের মিটিং অব্যাহত ছিলো। সেখানে এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো যা শেখ মুজিবুর রহমান আজ রেসকোর্স ময়দানে দেবেন। সচিবালয়ের কোন কোন লোক তাও বলছিলেন যে, আজ শেখ মুজিবের সেই কথাগুলো বলা উচিৎ যা সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে এবং এই উত্তেজনাকে আরও বৃদ্ধির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে পুলিশ অথবা সেনাবাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুবরণকারীর বিষয়টি বেশি বেশি আলোচনা করা হচ্ছে। গুজবের শক্তি এতটুকু ছিলো যে, বাস্তবতাকে খুঁজে বের করা সমুদ্র থেকে সুঁই বের করা থেকে বেশি কষ্টের ছিলো। ঢাকায় অবাঙালিদের উপর আক্রমণের আশংকা হচ্ছিলো। এই বিষয়ে গুজবের স্রোতও চলছিলো। নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এমন মারাত্মক ছিলো যে কোন রিক্সাওয়ালা শহর থেকে মুহাম্মদপুর কিংবা মিরপুর যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো না এবং সেই এলাকা থেকেও কোন রিক্সাওয়ালা বাঙালি এলাকায় যেতে চাইতো না।
প্রথমদিকে পরিকল্পনা এমন ছিলো যে, রেসকোর্স ময়দানের অনুষ্ঠান রেডিও এবং টেলিভিশনে দেখানো হবে। এজন্য এই দুই প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রস্তুতিও নিয়েছিলো। পরে সিদ্ধান্ত হয় রেকর্ড করা অনুষ্ঠান দেখানো হবে। ফলে গুজবের আরও পথ খুলে যায়। ৭ মার্চের জনসভা আতংকের মধ্যে শুরু হয়। কিন্তু যখন জনসভা শেষ হয় তখন আতংক অনেকটা কমে যায়। এই অবস্থায় যখন জনতা ক্ষুব্ধ ছিলো এবং স্বাধীনতার পক্ষে শ্লোগান দিতেছিলো তখনও শেখ মুজিবুর রহমান জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সফল ছিলেন। সেখানে দাবী ছিলো; ১. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, ২. মার্চের শুরু থেকে ক্ষতির উচ্চতর পর্যায়ের তদন্ত করানো হোক, ৩. সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হোক, ৪. ক্ষমতা জনতার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হোক।
রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য নিয়ে সংবাদপত্রের রিপোর্ট এই ছিলো যে, ‘আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চে জাতীয় পার্লামেন্টের বৈঠকে যোগদানের জন্য চারটি শর্ত দিয়েছেন। তাদের দাবী হলো বৈঠকের পূর্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হোক। জনতার নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। সৈন্যদেরকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হোক এবং পূর্ব পাকিস্তানে গুলির বিষয়ে তদন্ত করা হোক। তারা তাদের বক্তব্যে বলেন, এখনও সময় আছে আমরা আমাদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের মাধ্যমে ভাইভাই হয়ে একসাথে থাকতে পারি। আজ এই রেসকোর্স ময়দানে পাঁচ লাখ মানুষের ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তব্যে ঘোষণা করেন, যদি আমাদের দাবী মেনে নেওয়া হয় তবে আমরা জাতীয় পার্লামেন্টের জনসভায় যোগদানের বিষয়ে চিন্তা করবো। আওয়ামী লীগের নেতা বলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই দাবীগুলো গ্রহণ করা হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সকল সরকারী, অর্ধসরকারী প্রতিষ্ঠান, আদালতসমূহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সরকারকে টেক্স এবং অন্যান্য অর্থ দেওয়া হবে না। সমস্ত বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলন অভ্যাহত থাকবে। জাতীয় পার্লামেন্টের বৈঠকের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে শনিবারে বিক্ষোভ শেষে তাঁর বিশ মিনিটের বক্তব্যে শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দেন। তিনি এই কথার সত্যতা স্বীকার করেন যে, তিনি জাতীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের ডাকা গোলটেবিল বৈঠককে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রক্তের মধ্যে গোসল করছেন আর আমরা এগুলোকে এড়িয়ে ১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠকের উপর কীভাবে ভরসা করতে পারি? তিনি বলেন, আমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোন খায়েশ নাই। আমি শুধু জনগণের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছি।’
‘আওয়ামী লীগের নেতা সংবিধান প্রণয়নের বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে তাঁর আলোচনার কথা উল্লেখ করে বলেন, যদি এখনও শান্তিপূর্ণভাবে তা করা হয় তবে আমরা ভাইয়ের মতো এক সাথে থাকতে পারি। শেখ সাহেব বলেন, সংখ্যাগরিষ্ট্য দলের নেতা হিসাবে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় পার্লামেন্টের বৈঠক ডাকতে বলেছিলাম। কিন্তু সংখ্যালঘু পার্টির নেতার ইচ্ছায় ৩ মার্চ বৈঠক ডাকা হলো। তবু আমি বৈঠকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমি পার্লামেন্টের ভেতরে এবং বাইরে যেকোন স্থানে সংবিধান বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। এই ব্যাপারে তিনি তাঁর বর্তমানের এক বক্তব্যের সূত্র দিলেন যাতে তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেক ভালো এবং যুক্তিসম্মত পরামর্শকে তিনি গ্রহণ করবেন যদি তা একজন সদস্যের পক্ষ থেকেও উপস্থাপন করা হয়। এরপর জাতীয় পার্লামেন্ট স্থগিত করে ২৫ মার্চে বৈঠক করার ব্যাপারে আমার সাথে কোন পরামর্শ করেননি। তারা সংখ্যাগরিষ্ট দলের সদস্যদেরকে কোন গুরুত্বই দেননি, যা বাংলাদেশের জনগণের অপমান বলে মনে করি।’
পিপলস পার্টির নেতার সাথে কথা বলার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কথাবার্তার দরজা বন্ধ হয়নি। আমি মুফতি মাহমুদ এবং মাওলানা নুরানী সহ অন্যান্য নেতাদের সাথেও কথা বলেছি এবং আমি সংবিধান বিষয়ে কথা বলতে প্রস্তুত রয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ভূট্টো আলোচনার পরিবর্তে হুমকি-ধমকি দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন। ভূট্টো পার্লামেন্টকে হত্যা করে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানে জিম্মি হয়েগেছেন। পার্লামেন্ট স্থগিত না করলে তিনি হরতাল ডাকারও হুমকি দিয়েছেন।’ শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রথম মার্চ যখন পার্লামেন্টের বৈঠক স্থগিত করা হলো তখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পার্লামেন্টের বৈঠকের জন্য ৩৫ জন সদস্য ঢাকায় পৌঁছেগেছেন। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২জন সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বৈঠক স্থগিত করা হলো এবং অসংখ্য অপবাদ আমার উপর দেওয়া হলো, যেগুলোর কোন বাস্তবতা নেই। তবুও পার্লামেন্ট স্থগিতের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে জনতা আমার ডাকে মাঠে চলে এসেছে। কিন্তু বিনিময়ে আমরা এভাবে উত্তর পেয়েছি যে, দেশের নিরাপত্তার জন্য আমাদের টাকায় ক্রয় করা অস্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো।’ তারা বলেন, ‘যখনই আমাদের জনগণ নিজেদের ভাগ্য গড়তে চেষ্টা করেন তখনই তাদের উপর গুলি চালানো হয়।’
‘শেখ মুজিবুর রহমান অতীতে বাঙালিদের ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করেছি, তবু আমাদের ত্যাগের ধারাবাহিকতা শেষ হচ্ছে না। আমাদের পরীক্ষার গাঢ়তা দিনদিনে আরও গাঢ় হয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের সর্বস্বত্ব চলে যাচ্ছে। আমাদের অনেক লোক শহিদ হয়েগেছেন। আমরা এখন ইনশাল্লাহ শহিদ নয়, গাজী হবো। আজ আর পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদেরকে আমাদের অধিকার আদায় থেকে ফিরাতে পারবে না। তারা সাধারণ মানুষকে সেই লোকগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকতে বলেছেন, যারা তাদের মধ্যে অবস্থান করে আছেন এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আমাদের যেকোনভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলতে হবে।’ ‘শেখ মুজিব আরও বলেন, যারা বর্তমান সংঘর্ষে আক্রান্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগ তাদেরকে প্রত্যেক রকম সহযোগিতা করবে।’ জনসভার শুরুতে যখন শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চে আসেন তখন লাখ লাখ মানুষ তাঁকে উত্তেজিতভাবে শুভেচ্ছা জানান।
(দৈনিক আমরোজ, লাহোর, ৮ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ)।
এই বক্তব্যের পর হাইকমান্ডের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে গণ-প্রতিক্রিয়া থেকে ফায়দা নেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা তথ্যগুলোর উপর বিবেচনা করা হয়। প্রত্যেক জেলার একজন এমএনআই এবং এনপিএ পরামর্শের জন্য ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। তারা নিয়মিত তাদের নিকটস্থ কর্মির সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন।