বঙ্গবন্ধু : এক পাকিস্তানি সাংবাদিকের দৃষ্টিতে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মে ২০২২, ৫:২৯:৪৬ অপরাহ্ন

উর্দু থেকে অনুবাদ : সৈয়দ মবনু
(পূর্ব প্রকাশের পর) : তিনি বললেন, ‘আপনি জানেন বর্তমানে অবস্থা এমন যে, সামান্য আগুন সবকিছুকে জ্বালিয়ে ছাঁই করে দিতে পারে।’ গভর্ণর অফ দ্যা রেকর্ড অনেক কথা বললেন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকের বিষয়কে সামনে এনে বললেন,‘আমার জীবনের স্মরণীয় এবং আনন্দের দিন সেটি ছিলো যেদিন আমি কায়দে আজমের আইটিসি হিসাবে মিরপুর বিমানবন্দরে অবতির্ণ হয়েছিলাম। আর আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় এখন অতিবাহিত করছি। যে দেশকে এত কষ্ট-সাধনা করে তৈরি করা হলো তা ভাঙার জন্য তা থেকে বেশি রক্তপাত দেখতে হবে মনে হচ্ছে।’ এডমিরাল আহসান খুব হৃদয়গ্রাহী হয়ে বলেন; ‘রাওয়ালপিন্ডিওয়ালা টেলিফোনে কথা শোনতে অগ্রহ্য করে এবং প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত আমার বক্তব্য পৌঁছতে দেয় না। আমি তাদেরকে হতাশ এবং হৃদয়গ্রাহী দেখছি না।’ এডমিরাল আহসান বলেন,‘ মুজিব তো কিছু হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিষয়ে কিছু চিন্তা করে, কিন্তু ভূট্টোর হৃদয়ে এমন কিছুই নেই। কারণ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সে কিংবা তার পরিবার রক্ত দেওয়াতো দূরের কথা, ঘামও বের করেনি।’ গভর্ণর সাহেব বললেন,‘ রাওয়ালপিন্ডিতে নাজানি কি হচ্ছে? আমার সে বিষয়ে কোন কিছু জানা নেই। এই অবস্থায় আমার মতো ব্যক্তি কি করতে পারে? সম্ভবত একদুদিনের মধ্যে আগামীর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবো।’ হৃদয়ে বেদনা নিয়ে আমি গভর্ণরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। প্রকৃত অর্থে তিনি এই রাতেই শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করেন। কেননা, ২৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতা হঠাৎ এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে দিলেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য এজন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে যে এর দ্বারা পরিস্থিতি এবং বাতাসের রঙ অনুমান করা যাবে। আমি সেই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। আমিও কিছু প্রশ্ন করেছি, যা এই বক্তব্যের পরে উল্লেখ করবো।
’৭১-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত শেখ মুজিবের বক্তব্য
‘আজ পাকিস্তানের ইতিহাসে পাকিস্তানের দিক থেকে আমরা খুব মারাত্মক অবস্থার মধ্যে উলট-পালট হয়ে যাচ্ছি। এই বিষয় শুধু আমার জাতের বা আমার দলের নয়, বরং তা পাকিস্তানের ১৩ কোটি মানুষের। এই বিষয় এমনও নয় যেমন সাধারণ মনে করা হচ্ছে। দেশে গত সাপ্তাহ থেকে যে ‘সফর’ শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষ তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। বর্তমানে সময় এসেগেছে এই খারাপ অবস্থাকে শেষ করে দেওয়ার। আপনারা সবাই জানেন বর্তমান সংকট খুবই মারাত্মক অবস্থায় এবং তা কৃত্রিমভাবে তৈরিকৃত। তাদের উদ্দেশ্য দেশের আগামী শান্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া। শাসনের দায়িত্ব জনগণের ভোটে নির্বাচিতদের কাছে হস্তান্তরে বিলম্ব করা হোক কিংবা এর জন্য কিছু নতুন শর্তারোপ করা হোক, কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই সমস্ত জিম্মাদারীর ব্যাপারে অবগত যে রায়দাতারা তাদের উপর অর্পিত করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা আজও নিরব রয়েছেন। কারণ, আমরা চাচ্ছি না যে, এখতেলাফি কথা বলে পরিস্থিতিকে বিষাক্ত করে দিতে। —-বরং আওয়ামী লীগ তাঁর সেই অবস্থার উপর রয়েছে যে, সামনে যতবড় সমস্যাই আসুক না কেন তারা দৃঢ়তার সাথে সমাধান করে যাবে। একজন গণতান্ত্রিক হিসাবে এটা আমার বিশ্বাস যে, এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো। কিন্তু এর পদ্ধতি হলো এই যে, পার্লামেন্টে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সমস্যাসমূহের সমাধান করা। এজন্যই আওয়ামী লীগ চাচ্ছে খুব দ্রুত পার্লামেন্টের বৈঠক ডাকা হোক। তারা প্রত্যেক দলের নেতাদেরকে তাদের মতামত দেওয়ার জন্য দাওয়াত করছে। এজন্যই আমি দলের নেতাদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে আওয়ামী লীগের ছয়দফার ব্যাখ্যাও করেছি, যার ভিত্তিতে জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে তাদের বেশিরভাগ ভোট দিয়েছে। আমি জুলফিকার আলী ভূট্টো ও তাঁর সাথীদের সাথেও কথা বলেছি এবং তাদের বাস্তবতা ভালো করে জানা আছে যে, পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ ছয়দফার পক্ষে। তারা ছয়দফা বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগকে রায় দিয়েছে।’ এখন আওয়ামী লীগের উপর ফরজ হলো জনগণের রায়কে বাস্তবায়ন করা। তবু আমি ছয়দফার উপর থেকে ভয় দূর করতে এর ব্যাখ্যা বারবার করে যাচ্ছি, যাতে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশের লোকদের চিন্তায় নিজেরা অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে বলে কোন ভয় তৈরি না হয়। পিপলস পার্টি ছয়দফার আলোচনা এখানে এসে স্থগিত করেছে যে, তারা তাদের দলের নেতাদের মতামত নিবে। কথা ছিলো এরপর আবার আলোচনা হবে। আওয়ামী লীগ আজ এখানে দাঁড়িয়ে বলছে যে, যদিও ছয়দফার ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর ওয়াদা করেছি তবু আমরা সমস্ত রাজনৈতিক দলের সাহায্য-সহযোগিতার প্রত্যাশী, যেন দেশের জন্য স্থিতিশীল শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। এজন্য আমরা জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তানের সভাপতি মাওলানা শাহ আহমদ নুরানী, নওয়াব মুহাম্মদ আকবর খান বুগতি, মাওলানা গোলাম গৌছ হাজারায়ী, মাওলানা মুফতি মাহমুদ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের সাথেও কথা বলেছি। আমরা সাথে সাথে তাও সন্দেহ করছি যে, বৈঠক আহ্বানে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বেহুদা বিলম্ব করা হচ্ছে। আমাদের এই সন্দেহটাও বাস্তবিক, কারণ আড়াই মাস চলে যাওয়ার পরও বৈঠক ডাকা হচ্ছে না। আর যখন ৩ মার্চ জাতীয় পার্লামেন্টের বৈঠকের কথা বলা হচ্ছে তখন আমরা শান্তির শ্বাস নিচ্ছি এজন্য যে, শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের দেওয়ার ভেঙে আকল-বুদ্ধির জয় হচ্ছে। যাকিছু এই মূহুর্তে মাঠে বুঝা যাচ্ছে, এখন রাষ্ট্রপ্রধান গণতান্ত্রিক নীতিতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চিন্তা করবেন। যারা ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে ছিলো তারা হলো জনগণের শত্রু। এরপর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা হলো।-(চলবে)