বদলে যাওয়া সমাজের আয়নায় আমাদের উন্নয়ন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০২২, ৫:০৬:৩৮ অপরাহ্ন

শেখর ভট্টাচার্য
বদলে যাচ্ছে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি। সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় সব কিছু। ইতিবাচক ভাবে সব কিছু বদলে যাওয়াকে মানুষ স্বাগত জানায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবন সারা পৃথিবীর মানুষের জীবনকে জাদুর মতো বদলে দিয়েছে। অর্থনীতির বদলে যাওয়াও দৃশ্যমান। পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে বেড়েছে প্রতিযোগিতা। এর প্রভাব এসে পড়েছে সমাজে। বাংলাদেশের সমাজ এখন আর কৌতুহলী নয় আপনি কী করে সম্পদশালী হলেন। সামাজিক মানুষ আপনাকে অভিবাদন জানায় আপনার সম্পদের মালিক হিসাবে। আপনার বিত্ত আছে তাই আপনার চিত্ত ও উদার। আপনি দু’হাত ভরে ব্যয় করেন সমাজের জন্য। আপনাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান ও সমাজ উন্মুখ। এই মানুষটিকেই এই সামজিক, প্রতিষ্ঠানের নেতা করতে হবে। তিনিই উপযুক্ত। তিনিই যোগ্য। বদলে যাওয়া সমাজ আপনার বিত্তের চাকচিক্য দেখে মোহিত।আপনি যদি পনেরদিন যে কোন পণ্য মজুদ করে কয়েক হাজার কোটি টাকা অনৈতিক ভাবে উপার্জন করেন এই সমাজে আপনার অবস্থান উর্ধগামী হবে, এনিয়ে আপনার অহেতুক সংকোচের কোন প্রয়োজন নেই। আপনি সমাজের অনুসরণীয়। এক সময় সমাজ আদর্শবান নায়ককে খুঁজে বেড়াতো। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো মানুষেরা এখনও হাপিত্যাশ করেন, মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ নেতার জন্য। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের কন্ঠ সমাজের মূল ধারায় গিয়ে পৌছোয় না। কন্ঠ বড় নিম্ন। অপ্রয়োজনীয় হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে যারা ভাবেন তাদের ভাবনা জানার মানুষের বড় অভাব। মূল্যবোধ সম্পন মানুষদেরকে সমাজ এখন আর আস্থায় নেয়না।
শক্ত মেরুদন্ডের সেই সব নাগরিক সমাজের নেতা, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিকরা কোথায়? সারা দেশ ব্যাপী মনে হয় আমরা সকলেই সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছি। পরিবর্তনের জন্য যে শ্রেণি সকল সমাজে সব চেয়ে বেশী সোচ্চার থাকে সে শ্রেণি হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। উচ্চ শ্রেণির মানুষের পাত থেকে উপচে পড়া এঁটো খাবার কুড়িয়ে খেতে তারা ব্যস্ত। তাদের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নানা সুযোগ। সেই সুযোগে তারাও এখন ছেলেমেয়েদেরকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।অর্থ দিয়ে পুঁজিবাদী দেশে যেকোন পর্যায়ের শিক্ষা ক্রয় করা সহজ হয়ে গেছে।মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের সন্তানেরা যে ভাবে শিক্ষা ক্রয় করছেন পুজিবাদী দেশে সেসব শিক্ষা যে খুব গুণমান সম্পন তা’ কিন্তু বলা যাবেনা। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত নির্বিশেষ সকল শ্রেণির মানুষেরা ইউরোপ, আমেরিকায় ক্যাম্প গড়ে তুলছেন। প্রয়োজন হলে যেকোন সময় তারাও আশ্রয় নিবেন সেখানে। বিবেক, মূল্যবোধ, বৈষম্য নিরসন এ’ গুলো নিয়ে কথা বলবে কারা? আশ্চর্য হতে হয় বাঁধা ধরা বেতনের মধ্যবিত্তকে যখন দেখি টরন্টো, নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডায় উচ্চমূল্যে বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয় করে চাকরি শেষে সেখানে অবস্থান করতে। বাংলাদেশ হলো, আয় রোজগারের একটি উর্বর ভূমি। কারণ বদলে যাওয়া সমাজ এখান থেকে আয়রোজগার করে বিদেশে স্থায়ী বা অস্থায়ী ভাবে নিশ্চিত জীবন যাপন করাকে বাহবা দিতে প্রস্তুত। মূল্যবোধহীন এ’ সমাজ এ’ ধরণের মানুষকে নায়ক মনে করে। এসব নায়কেরা আমাদের সমাজের সকল ক্ষেত্রে এখন বহুল প্রশংসিত।
আমাদের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা কী? এজেন্ডা একটি এবং তা’হলো নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া। নির্বাচন অবশ্যই গণতন্ত্রের একটি মূল্যবান উপাদান।স্বচ্ছ ও সুষ্ঠ নির্বাচন সকল দায়ীত্বশীল নাগরিকেরা কামনা করেন। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আসলে কী খুব বড় ধরনের গুণগত পার্থক্য আছে? দু’টি দলই চায় ক্ষমতায় আসীন হতে। স্বচ্ছ নির্বাচনের সংজ্ঞা হলো যে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বা ব্যবস্থায় আমাদের দল ক্ষমতাসীন হতে পারে সেই প্রক্রিয়াই স্বচ্ছ! অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার, বিরোধী দল ও জনগণ- সব অংশীজনেরই ভূমিকা ও দায় রয়েছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল ভূমিকায় থাকে নির্বাচন কমিশন। তাই ভালো নির্বাচনের জন্য প্রশংসা এবং খারাপ নির্বাচনের জন্য সমালোচনা দুই-ই কমিশনের সমানভাবে প্রাপ্য।সেই কমিশন গঠণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ কোথায়?প্রত্যক্ষ ভাবে না থাকুক, পরোক্ষভাবে ভাবে থাকারও সুযোগ নেই। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকরণ করতে হলে জনগণকে এড়িয়ে গিয়ে বা বিযুক্ত করে তা’ করা সম্ভব নয়। তাহলে সেই গণতন্ত্র হবে অসার, মূল্যহীন। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটক নিয়ে সেই কথা। যুবরাজ হ্যামলেট চরিত্রকে উহ্য রেখে যেভাবে হ্যামলেট আটকের কথা ভাবা যায়না একই ভাবে জনগণকে বিযুক্ত করে আপনি কোন ভাবেই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার কথা ভাবতে পারবেন না।
আবার ফিরে আসি বদলে যাওয়া প্রসঙ্গে। এই যে সমাজ, সংস্কৃতি নেতিবাচক ভাবে বদলে যাচ্ছে এর প্রভাব পড়ছে সব চেয়ে বেশী সামাজিক মূল্যবোধে। ক্ষয়িষ্ণু সমাজের এতো কিছু ভাবা সময় কোথায়? একসময় রাষ্ট্রের কাছে নয় সংবেদনশীল সমাজের কাছে মূল্যবোধহীন, অস্বচ্ছ মানুষদের জবাদীহি করতে হতো। নাগরিক সমাজ ছিলো অত্যন্ত জাগ্রত। বুদ্ধিজীবীরা সমাজের সতর্ক পাহারাদার ছিলেন। কোনো দেশের সমাজে যখন অবক্ষয় দেখা দেয়, তখন সরকারের পক্ষে একা সেই পচন রোধ করা সম্ভব হয় না। দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সেই পতন রোধে এগিয়ে আসেন। অনেক বুদ্ধিজীবীকে এই কাজের দায়িত্ব পালন করতে এসে আত্মদানও করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, প্লাবন, এমনকি রাষ্ট্র বিপ্লবেও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর গণহত্যার পরিকল্পনায় বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল একটি বড় অংশ। তারা চেয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা দ্বারা দেশটাকে মেধাশূণ্য করে রেখে যাবে, যাতে দেশটা স্বাধীন হলেও সমাজ পুনর্গঠনের জন্য কোনো মেধাবী লোক পাওয়া না যায়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি, স্বৈরাচারী শাসন উৎখাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঢেউ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, রাজনৈতিক আন্দোলন কখনো সফল হয় না সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহায়তা ছাড়া। সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়। আবার রাজনৈতিক আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। বাংলাদেশেও এটাই হয়ে আসছে সব সময়। এরশাদ হটাও আন্দোলন ছিল গোড়ায় সংস্কৃতিসেবীদের। আজ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি, অনায্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সেরকম সোচ্চার হতে দখিনা কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে। তারাও নীরবতার সংস্কৃতিকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সব সময় আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীরা সব চেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে গেছেন পাকিস্তানী শাসকেরা ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করলে এ’দেশের রাজনৈতিক দল গুলোর থেকে অধিক সোচ্চার হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক সংগঠণ গুলো। বুদ্ধিজীবীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। নাগরিক সমাজ নানা ভাবে সক্রিয় হয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দলন করে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা যতোটুকু এগিয়েছি তাকে টেকসই করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ হলো সুশাসনের মূল ভিত্তি। আমাদের রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠণ গুলোকে প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি হতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে চিন্তা ও আদর্শে স্বকীয়তা থাকবে। ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন মত, ভিন্ন আদর্শকে শ্রদ্ধা সম্মান করা হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের বাগানে শত ফুলের চাষ করা হয়। এই যে ফুলে ফুলে বৈচিত্র্য, প্রতিটি ফুলের নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে অবস্থান করা তা’হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য অথবা বলতে পারেন বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য। মতাদর্শ গত ভাবে আমাদের ভিন্নতা থাকবে কিন্তু জাতীয় কিছু মূল নীতিতে দল, মত নির্বিশেষে আমদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আর এরকম ঐক্যের নাম হলো জাতীয় সংহতি। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য চাই এরকম জাতীয় সংহতি। যেমন উন্নত দেশে সরকারের বদল হয় কিন্তু পররাষ্ট্র নীতি, জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির ব্যাপারে নুতন এবং পুরোনো সরকারের মধ্যে বড় কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়না। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর পার হয়ে আমরা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছি। এবার আমাদের থামতে হবে, ভাবতে হবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কথা। আলোর পথ ধরে এগোতে হলে কিন্তু হাতে হাত ধরে সকলে মিলেই এগোতে হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক।