বন্যা ও ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ আগস্ট ২০২২, ৮:৩২:৫৪ অপরাহ্ন

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিলো। অনেকে চলে এসেছেন শহরের দিকে। অনেকে আশ্রয়গ্রহণ করেছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। অসহায় মানুষগুলো অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত করেছেন। তাঁদের প্রয়োজন সাহায্যের। সিলেট শহর ও এর আশেপাশে ত্রাণ-সামগ্রী ও খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হলেও গ্রামাঞ্চলের অসহায় মানুষগুলোর অবস্থা খুব করুণ। সরাসরি না দেখলে অনুধাবণ করা যায় না। সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ সহ অন্যান্য উপজেলার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সড়ক পথে বন্যার পানি উঠে যাবার ফলে ত্রাণ পৌছানোও দুরূহ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে বন্যার পানি অনেকটাই কমেছে। এর আগে সিলেট অঞ্চলের অধিবাসীগণ এমন অবস্থায় পতিত হন নি। এর মাঝেও কিছু কিছু স্থানে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে।
কথা হলো, সিলেটের আখালিয়া তপবন আবাসিক এলাকা মসজিদের ইমাম সাহেব মুফতি নোমানের সাথে। তাঁর বাড়ী সুনামগঞ্জের ছাতক এলাকায়। ছাতকের বন্যা পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। বাড়ী ঘরের টিনের চালের উপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হয়েছিল। জানা গেলো, কাজীহাটা গ্রামের ২২/২৩ বছরের তরুণীকে বন্যার পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পরের দিন পার্শ্ববর্তী আমেরতল গ্রাম থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। জানা গেলো, কাজীহাটা গ্রামে একটি মাত্র স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ার কারণে এবং পর্যাপ্ত নৌকার অভাবে বন্যার্ত অসহায় মানুষের ঘর ছাড়া অন্যত্র আশ্রয়গ্রহণের সুযোগ খুবই কম। নদীমার্তৃক দেশ হলেও সড়ক-যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বর্তমানে নৌকার পরিমাণ কমে এসেছে। কাজীহাটা গ্রামের একটি মাত্র স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় ৪০০ জন বন্যার্ত মানুষ, কিন্তু গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ১৫০০ জন। জানা গেলো, ত্রাণ না যাবার ফলে প্রায় ৩ দিন যাবৎ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে ছিল।
গত জুন মাসের ২২ তারিখে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক সদর ইউনিয়নের কাজীহাটা গ্রামে ত্রাণ বিতরণের সুযোগ হলো। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট থেকে প্রায় ৪৫ মিনিট সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডে ছাতকের বোকারভাঙ্গা পর্যন্ত সড়ক পথে এবং একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় প্রায় ৪০ মিনিটের জলপথ পেরিয়ে কাজীহাটা গ্রামে পৌছালাম। গ্রামে গিয়ে দেখি প্রচুর সংখ্যক অসহায় দরিদ্র মানুষ। ত্রাণ বিতরণের জন্য কোন শুকনো স্থান না থাকায় অবশেষে নৌকায় বসে ত্রাণ বিতরণ করা হলো। মুফতি নোমান আহমেদের গ্রাম কাজীহাটা। প্রায় কয়েক দিন যাবৎ গ্রামের বাসিন্দারা অনাহারে-অর্ধাহারে ছিলেন। যে পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হলো তার একটি বিরাট অংশ পাওয়া গেল সিলেট আইডিয়াল সোসাইটি নামক একটি ক্লাবের মাধ্যমে। এছাড়াও এম আহমেদ টি এন্ড ল্যান্ড কোম্পানীর অবদান ছিলো। ত্রাণ বিতরণে শা.বি.প্র.বি এর পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম, বারাকা পাওয়ার লিমিটেডের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ফাহিম আহমদ চৌধুরী, আহমদ ফাইয়াজ উমায়ের সহ আর কয়েক জন ছিলেন।
ত্রাণ বিতরণ শেষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উপলব্ধি করা গেল। ব্যক্তিগত অথবা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা বেসরকারী উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের সময় বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
প্রথমত, অনেক সময় ত্রাণ বিতরণের সময় দেখা যায় একই পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য ত্রাণ পেয়েছেন। অনেক পরিবারের কেউই পাননি। এটা মোটেই কাম্য নয়। ত্রাণ বিতরণকালে প্রতিটি পরিবারের জন্য এ পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী দেয়া প্রয়োজন যাতে ৫/৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবার কমপক্ষে ১০/১২ দিন কষ্ট করে হলেও কাটাতে পারেন। কোন গ্রামে বা এলাকায় ত্রাণ বিতরণের পূর্বে উক্ত গ্রামের বা এলাকার বিশ্বস্ত কয়েকজন ব্যক্তির মাধ্যমে ত্রাণ পাওয়ার উপযুক্ত পরিবারগুলোর একটি তালিকা তৈরী করা এবং সেই তালিকা অনুযায়ী টোকেন প্রদান করা উচিৎ এবং ত্রাণ বিতরণের সময় উক্ত টোকেন অনুযায়ী পরিবারগুলোর যে কোন একজন সদস্যকে ত্রাণ বিতরণ করা প্রয়োজন। এতে ত্রাণের সঠিক বন্টন সম্ভব হবে। প্রতিটি এলাকার মসজিদগুলোর ইমাম সাহেব এবং মোয়াজ্জিনগণকে উক্ত তালিকা তৈরী এবং টোকেন প্রদানের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এতে উপযুক্ত পরিবারগুলোর নিকট ত্রাণ পৌছানোর সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, ক্লাব- এর মাধ্যমে অথবা বেসরকারীভাবে ত্রাণ বিতরণের সময় সমন্বয়হীনতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। ত্রাণ বিতরণের সময় দেখা যায়, কোন এলাকায় প্রচুর সংখ্যক ত্রাণ বিতরণ হয়েছে এবং অনেক এলাকায় হয়নি। এ সমন্বয়হীনতা নিরসনে উদ্যোগে “দুর্যোগকালীন ত্রাণ বিতরণ” / “ডিজএসটার রিলিফ ডিস্ট্রিবিউশন” নামক একটি অ্যাপস্ তৈরী করা একান্ত প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে কথা হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং- বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. আব্দুল্লাহ আল মুমিন এর সাথে। তাঁর মতে, অ্যাপস্ টি এমন হবে যেটি মোবাইলে ডাউনলোড করে তথ্য সংগ্রহ এবং বন্টন করা যাবে। বিষয়টি হলো, ধরুন, মি. এ সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের পারকুল এবং খোয়াজপুর গ্রামে ত্রাণ বন্টন করতে আগ্রহী। এখন, অ্যাপস্ এর মাধ্যমে তিনি পুরো সিলেট এবং সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকায় কোন কোন স্থানে ইতিপূর্বে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে এবং কোন কোন এলাকায় ত্রাণ বিতরণ হয়নি, তা জানতে পারবেন। এখন ধরুন, অ্যাপস্ এর মাধ্যমে মি. এ জানতে পারলেন যে, খোয়াজপুর গ্রামে ইতিপূর্বে ত্রাণ দেয়া হয়েছে কিন্তু পারকুল গ্রামে ত্রাণ দেয়া হয়নি। আরও জানতে পারলেন পারকুলের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মির্জারগড়ে ত্রাণ দেয়া হয় নি। এখন মি. এ পারকুল এবং মির্জারগড় গ্রামে ত্রাণ দিতে পারেন এবং ত্রাণ বিতরণের পর অ্যাপস্ এর মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারেন যে উক্ত দুই গ্রামে ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। এখন মনে করুন, মি. বি বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মির্জারগড় গ্রামে ত্রাণ দিতে চাচ্ছেন কিন্তু অ্যাপস্ এর মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন যে, ইতিমধ্যে মির্জারগড় গ্রামে ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। তখন তিনি অন্য গ্রামে ত্রাণ দিতে পারবেন। যে কোন ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যখন ত্রাণ দিতে যাবেন তখন খেয়াল রাখতে হবে যেন কমপক্ষে একটি গ্রামের দুর্গত এবং দুঃস্থ পরিবার ত্রাণ সহায়তা পায় এবং অসহায় কোন পরিবার যেন বাদ না থাকে। অ্যাপস্টির এ্যাডমিন পরবর্তীতে তথ্য যাচাই-বাছাই করবেন। তথ্য যাচাই- বাছাই এবং প্রকৃত অসহায় এবং দুর্গত পরিবার সনাক্তে উক্ত গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব এবং মোয়াজ্জিনগণের সাহায্য নিতে পারেন। এভাবে করতে পারলে বেসরকারী উদ্যোগে ত্রাণ বন্টন অনেকাংশে স্বচ্ছ ও সঠিক হবে বলে আশা করা যায়। ধরুন, মোট টোকেন দেয়া হলো ২০০ টি পরিবারকে। এক্ষেত্রে, ২০ টি অতিরিক্ত ত্রাণের প্যাকেট করা যেতে পারে সম্ভাব্য ভুল-ত্রুটির পরিমাণ হ্রাস করতে।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যোগাযোগের অভাবে এখনও ত্রাণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না এবং অনাহারে ও অর্ধাহারে মানুষজন মানবেতর অবস্থায় রয়েছেন। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত, বিভিন্ন সংগঠন থেকে যে কোন ব্যক্তি যেভাবে সম্ভব সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসি। ব্যক্তিগতভাবে জাকাত, সদকা, দান ইত্যাদির মাধ্যমে আর্ত-মানবতার সেবা করা এবং মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির সুযোগ অপেক্ষা করছে। আসুন আমরা সবাই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অসহায় বন্যার্ত মানুষগুলোর সাহায্যে এগিয়ে আসি।