বাংলাদেশের উর্দু কবিতা ও বিহারের খণ্ডিত সত্তা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০২২, ৫:৪১:১৭ অপরাহ্ন

জাভেদ হুসেন
‘এতো ভাগে ভাগ হয়েছি আমি/নিজের ভাগে কিছুই নেই বাকি/ইতনে হিসসোঁ মে বাটা হুঁ গ্যায়া ম্যায়/আপনে হিসসে মে কুছ বাচা হি নেহি।’
কিছু মানুষ আর সব মানুষের মতোই পথে চলে। কিন্তু তারা কোথাও পৌঁছায় না। তাদের মাঝে কিছু মানুষের কাছে শব্দই দেশ। তারা কবিতা লেখেন। কবিতা লেখেন যেন শব্দের পাঠের গায়ে খোদাই করতে পারেন দেশ অন্বেষণের পথনির্দেশ।
বিহার এখন ভারতের একটা রাজ্য। ভারতবর্ষে পরিণত রাষ্ট্রের জন্মের আদিভূমি। বিহারের মাটিতে মগধ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতবর্ষের প্রথম সাম্রাজ্য। মৌর্য সাম্রাজ্য। এ মাটিতে জন্ম নিয়েছে বুদ্ধের দর্শন। এ বিহার থেকে মৌর্য আর গুপ্তদের হাতে দক্ষিণ এশিয়ার বড় অংশ একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আসে। বিহারের আরেক অঞ্চল মিথিলা, যা ছিল বিদেহ রাজ্যের কেন্দ্র, প্রাচীন জ্ঞান কেন্দ্রের অন্যতম। বিদেহ শাসকদের বলা হতো জনক। এমন এক জনকের মেয়ে জানকী। তাকে আমরা রামায়ণের সীতা নামে চিনি। বিদেহ পরে বজ্জিকা সংঘে যোগ দেয়। এ সংঘ ছিল অনেক রাজ্যের কনফেডারেশন। সরকার প্রধান নির্বাচিত হতেন সংঘভুক্ত রাজ্যগুলোর প্রধানদের থেকে।
বিহার নামটি বৌদ্ধবিহারের নাম থেকে এসেছে। এ অঞ্চলে রয়ে গেছে অনেক বৌদ্ধবিহারের অবশেষ। আজকের বিহার রাজ্যের পশ্চিমে উত্তর প্রদেশ। উত্তরে নেপাল। আর দক্ষিণে ঝাড়খণ্ড। আর পুবে বাঙলা। ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হলো, তখন সেখানকার যে মানুষগুলো রাতারাতি শরণার্থী হলেন তাদের কাছের পাকিস্তান ছিল পূর্ব বাঙলা। তারা এসে সেখানেই ঠাঁই নিলেন। যারা আজকে বাংলাদেশে বিহারি নামে পরিচিত, তারা সবাই বিহার থেকে আসেননি। আবার যারা বিহার থেকে এসেছেন তারা সবাই উর্দুতে কথা বলেন এমনটাও না। বিহারে অনেক ভাষা চালু আছে আজও। বিহারিরা কথা বলেন হিন্দি, উর্দু, মৈথিলি, মগহি, ভোজপুরিসহ আরো অন্যান্য ভাষায়। বাংলাদেশের বিহারিরাও (!) তাই এসব ভাষায় কথা বলেন।
আরণ্যকের মানুষ
সমৃদ্ধির তলেই থাকে বঞ্চনা। টাকায় আট মণ চালের আমলে কত লোক না খেয়ে মারা গেছে তার তো ইতিহাস লেখা হয়নি। বিহারের ব্যাপারেও তাই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক পড়লে দেখা যায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিহারের দারিদ্র্য কী ভয়াবহ পর্যায়ে ছিল। আজকে ঠিক সেই অঞ্চলগুলোয় আদিবাসীরা মাওবাদীদের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে বঞ্চনার উন্নয়নের বিরুদ্ধে। এমন জায়গায় সাম্যবাদী আন্দোলনের স্বর্ণযুগে যে আলোড়ন গড়ে উঠবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিহারের যে উর্দু কবিরা এ বাংলায় এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে যারা তরুণ তারা সাম্যবাদী আদর্শের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতেন।
১৯৪৭-এর পর পর পূর্ব বাংলায় যে উর্দু কাব্য চর্চা শুরু হয় তার একটি দাপুটে অংশ ছিলেন সরকারি আমলারা। এর উল্লেখযোগ্য বিপরীতে ছিলেন প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাহিত্যিকরা।
মহেঞ্জোদারোর মানুষ নওশাদ নুরী
তিনি জন্মেছিলেন ইংরেজ আমলের ভারতবর্ষের বিহারে, ১৯২৬ সালে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর জন্মভূমি ছাড়েননি। কিন্তু ১৯৪৯ সালে তার নামে হুলিয়া বের হলো রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। তখন তিনি সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘ, বিহারের সাধারণ সম্পাদক। সে সময় জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গ ছেড়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। জওহরলাল নেহরুকে ব্যঙ্গ করে ‘ভিখারি’ নামে একটি কবিতা লিখলেন নওশাদ নুরী। ভিখারিরা গাইতে লাগল পথে, ট্রেনে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে ভারত ছেড়ে তখনকার পূর্ব বাংলায় এলেন নওশাদ।
নওশাদ তার বন্ধুদের বলতেন, ‘গমের খেত আর ভুট্টার খেতের কথা ভুলে এখন ধানখেতের চিন্তাটা করো।’ ভাষা আর ভূগোলের বন্ধনের চেয়ে তার কাছে মানুষের মূল্য ছিল বেশি। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনকে তিনি এক রাষ্ট্রীয় দুর্যোগে বাংলার মানুষের আপন অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে দেখলেন। লিখলেন কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’। এ কবিতা লেখার দায়ে হুলিয়া মাথায় নিয়ে এবার পূর্ব বাংলা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে নির্বাসনে রইলেন। চাকরিও গেল।
১৯৬৯ সালে প্রকাশ করলেন উর্দু পত্রিকা জারিদা। তাজউদ্দীন আহমদ এ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক। পত্রিকাটি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের উর্দু মুখপত্র। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে হলো সাধারণ নির্বাচন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭০-এ জারিদার হেডলাইন ছিল, ‘দুটো মাত্র পথ, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়তো কেন্দ্রের দাসত্ব’। প্রধান সংবাদ ছিল, ‘হামারি নাজাত তুমহারি নাজাত, ছে নুকাত ছে নুকাত’, মানে, ‘আমার মুক্তি তোমার মুক্তি, ছয় দফা ছয় দফা’। এর কিছুদিন পরেই তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুর পরদিন লিখলেন কবিতা ‘লোহু মেঁ শারাবোর দিন’, ‘রক্তে ভেজা দিন’: রক্তের স্রোতে ভেসে যায় শীতলপাটি/তীক্ষ ক্ষতের মতো ঢাকায় এখন করাচির কথা/কাগান থেকে রাঙ্গামাটি এখন অনেক দূর …/যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো/পথ নেই বাকি/আর কিছু নেই দেওয়ার/শুধু ঘৃণা ছাড়া।
এর পরও নওশাদ নুরী থেমে থাকেননি। লিখলেন কবিতা, ‘সশস্ত্র সৈনিকেরা’ (পাকিস্তানি ফৌজি নীতি)। উর্দু নাম ‘মাসসালাহ ফৌজ’: এত যে সবুজ ধীরে ধীরে আজ/রক্তের লালে হচ্ছে ঘেরাও …/অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না/লাশেরা এখন তুলছে দেয়াল।
শেষ মোহিকানদের একজন
নওশাদ নুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আহমদ ইলিয়াস। বিহারে বাড়ি। বাবার কর্মসূত্রে কলকাতায় ছিলেন প্রথম যৌবন। বাংলাদেশে লেখা সমকালীন উর্দু কবিতার ধারায় অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি কবি। ভারত ভাগের অভিজ্ঞতা নিয়ে উর্দু সাহিত্যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাতে বিশেষ সংযোজনের দাবি করতে পারেন ইলিয়াস। প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন আর রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে জন্ম নেয়ার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এখন পর্যন্ত ছয়টি উর্দু কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সবই ঢাকা থেকে।
ইলিয়াসের কবিতা বর্তমান জাতিরাষ্ট্র কাঠামোর ওপর সন্দিহান। নিজ হতে বিচ্ছেদের মাঝেও তার মানুষের অন্য রকম সম্ভাবনার কথা বলেন তিনি কবিতায়। ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সাহচর্য আর প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের সঙ্গে কাটানো সময় তার কবিতার মোড় ঠিক করে দিয়েছে। ইলিয়াস নিজের জীবনকে দেখেন ইতিহাসের সে পথ হারানোর দাগ ধরে। সেখানে তিনি ছড়িয়ে পড়েন ভাষার রাজনীতি মানুষের ইতিহাস হয়ে ওঠার প্রান্তরে:
আমার পথ হারানোর ইতিহাসও কেউ লিখত যদি/অক্ষরে অক্ষরে ছিন্ন হয়ে আমি ছড়িয়ে আছি পথে।
১৯৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে উর্দু সাহিত্যে পার্টিশন লিটারেচর বলে আলাদা শাখাই আছে। আহমদ ইলিয়াসের কবিতা সে দেশভাগের অনুভব নিয়ে তুলে ধরেছে উপমহাদেশের ইতিহাসের খনন। বাংলাদেশের কবিতায় তা এক প্রায় অনাস্বাদিত পর্ব। একদিকে একান্ত নিজ অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে একদা সমগ্র আর আজ খণ্ডিত এক ইতিহাসের বোঝা। এ দুইয়ের মিথস্ক্রিয়া বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াসের কবিতা।
আহমদ ইলিয়াসের কবিতা বলেছে দেশ ছেড়ে এসে আবার দেশ ছাড়া, রাষ্ট্রহীন হওয়ার কথা। সে বিচারে ইলিয়াসের কবিতা পার্টিশন সাহিত্যের আরেকটি শাখা সৃষ্টি করেছে। সেই দেশ আর বিদেশে নিজের পরিচয়হীনতার সত্যকে তুলে ধরেছেন এমন এক ভাষায়, যে ভাষায় এখন কবিতা লেখেন হাতেগোনা কয়েকজন। যে ভাষায় কয়েক বছর পর বাংলাদেশে আর কেউ কবিতা লিখবে না। আহমদ ইলিয়াস তবু লেখেন:
বাক্য বঞ্চিত ছিলো চোখ, বঞ্চিত ছিলো জিভ/তবুও কথা বলার দোষে অপরাধী আমি।
আহমদ ইলিয়াসের কবিতায় সুরা, সাকি বা শরাবখানা আসে কদাচিৎ। কিন্তু বিপরীত ওয়ায়িজ, মোহতাসিব, মরু, তৃষ্ণা, ক্ষত পায়ে বিরান ভূমিতে পথ খুঁজে ফেরা আসে বারবার। এসবই প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের মজমুন বা বিষয় রূপান্তরের ধারাবাহিকতা। তার কবিতা মানুষের কাছে পৌঁছেছে দিল্লি, লখ্নৌ, কলকাতা, হায়দরাবাদ, করাচি, লাহোরের কবিতা পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে। তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে কলকাতা, কর্ণাটকের সংগঠন। এ উপমহাদেশের অসংখ্য বিভক্তি আর দ্বেষের বাস্তবতায় আহমদ ইলিয়াস খণ্ডের বিপরীতে সংযোগের কবি। ইতিহাসের খাতায় ভুলে যাওয়া মানুষের একজন তিনি:
আমি নিজ ঘরে সেই অতিথি ইলিয়াস/সব আমন্ত্রণকারীরা যাকে ভুলে গেছে
আবেগের কারবার ইলিয়াস গজলে ব্যবহার করেন চিরায়ত বিষয় আর উপমা হাফিজ, সাদি থেকে মীর আর গালিব হয়ে ইকবাল আর ফয়েজ ব্যবহার করেছেন। গজল বা গীতিকবিতা ইলিয়াসের জীবনব্যাপী অনুভবের সারমর্ম। তিনি তাই নিয়ে গর্বিতও বটে:
এক ঢোকে বিষ পান করা খুবই সহজ জানি/সারা জীবন হূদয়ের রক্ত পান করে দেখাক তো কেউ
দেশভাগের পর ফয়েজ আহমদ ফয়েজ স্বাধীনতার রক্তাক্ত চেহারা দেখে বলেছিলেন, রাতের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত ভোর। ফয়েজের উত্তরাধিকার আহমদ ইলিয়াসের ভাবনার জগতেও এ দেশ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থিত নেই। সে আছে এক অনুভূতির মধ্যে, যেখানে বাড়ির উঠোনে বন্ধুরা বসে কবিতা পড়া যায়। জাতিরাষ্ট্রের উত্থান সেই উঠোনকে ধূলিসাৎ করে দেয়। নতুন বাড়ি আবার হয়, কিন্তু কবিতা পড়ার উঠোন আর ফিরে আসে না। স্বপ্নের সে বাড়ি এখন তার কাছে কাগজের ওপর নিজের অজান্তেই আঁকা কিছু রেখার সমষ্টি। সে কাগজে আঁকা রেখার বাড়িও তিনি হারিয়ে ফেলার ভয়ে আকুল হয়ে ওঠেন। ইলিয়াস জেনে ফেলার যন্ত্রণায় অধীর হয়ে আছেন:
যে দিকে সে, সেখানে জীবনের প্রজ্ঞা সাথে তার/এ দিকে আমি আর আমার সঙ্গী জেনে ফেলার এক যন্ত্রণা/তবে এই জেনে ফেলার যন্ত্রণাকে তিনি সাদরে মেনেও নেন:/ঝড় যখন তীব্র, বেঁচে থাকার প্রমাণ দিতে ভুলো না/জানালা খুলে রেখো, প্রদীপও রেখো জ্বালিয়ে।
কোনো বাক্য কখনো নির্দোষ হয় না। সে কারো না কারো পক্ষে আর তাই কারো বিপক্ষে যেতে বাধ্য ঃ মাটিতে রেখা কেটে এখন শব্দ আঁকি/জিভে আসে না কোনো হরফ, কোনো কথা।
জাভেদ হুসেন: উর্দু-ফার্সি সাহিত্য গবেষক ও অনুবাদক।