বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৫:৪৬:৩৪ অপরাহ্ন

মাজেদা বেগম মাজু
ভাবের আদান-প্রদানের নামই হলো ভাষা। ভাবের বাহনই ভাষা, ভাব প্রকাশের তাগিদেই ভাষার উদ্ভব। ভাষার প্রধান কাজই হলো একের ভাবনাকে অনেকের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ যুগের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী চমস্কির মতে, ‘ভাষা কোন যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, ভাষা মানুষের সৃজনী চেতনার সঙ্গে যুক্ত’। প্রথম মানব হযরত আদম (আ:) এর ভাষাই ছিল পৃথিবীর প্রধান ভাষা।
মায়ের কাছ থেকে শেখা ভাষাকে বলা হয় মাতৃভাষা। ভাষা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জন্মের পর শিশু মায়ের কাছে বা কোলে, বাড়িতে বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশে যে ভাষাটি প্রথম শিখে, সেটাই তার মাতৃভাষা। ভাষা বিজ্ঞানে তাকে এল ওয়ান (খ১) প্রতীকে ব্যবহার করে ল্যাঙ্গুয়েজ ওয়ান বা প্রথম ভাষা বলা হয়। প্রতিটি জাতিসত্তার পরিচয়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদান হচ্ছে তার মাতৃভাষা।
বাংলাদেশে বাঙালির বাইরে প্রায় ৪০টিরও বেশি নৃগোষ্ঠীর লোক বাস করে এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এদেশে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীগুলো পৃথিবীর অন্যতম ৪টি ভাষা পরিবারের প্রায় ৩০টি ভাষা ব্যবহার করে থাকে। এই ভাষাগুলো বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষা পরিবারের সদস্য। গবেষকদের মতে, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তঞ্চঙ্গ্যা চাকমার উপভাষা। কেউ কেউ রাখাইনকে মারমা ভাষার উপভাষ, লালং বা পাত্রকে গারো আর বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি ও হাজারাংকে বাংলার উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর ভাষার সংখ্যা প্রায় ২৬। এর মধ্যে সাঁওতাল, ককবরক, খাসি, গারো, চাক, বম, মারমা, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইন, মৈতৈ মণিপুরি, ম্রো অন্যতম।
সাঁওতাল-অস্ট্রে-এশীয় ভাষা গোষ্ঠীর প্রাচ্যশাখায় অন্তর্ভুক্ত সাঁওতালী ভাষার উপভাষা দু’টি-নাহিলী ও করকু। খ্রিস্টান মিশানারিদের উদ্যোগে রোমান হরফে এই ভাষার প্রথম লিখিত রূপ পাওয়া যায়। ১৮৬৯ সালে ভারতের সাঁওতাল পরগনার পৃথারিয়ান মিশনে স্থাপিত একটি ছাপাখানা থেকে সাঁওতাল ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে রঘুনাথ মুর্মুর উদ্ভাবিত সাঁওতাল লিপি সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে রাজশাহী জেলার বর্ষাপাড়া গ্রামে বাংলা হরফে সাঁওতালি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ককবরকÑত্রিপুরা জাতির ভাষার নাম ককবরক। ‘কক’ মানে ‘ভাষা’ আর ‘বরক’ মানে ‘মানুষ’। এ দুইয়ে মিলে ‘ককবরফ’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘মানুষের ভাষা’। এ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। ককবরক ভাষায় রোমান ও বাংলা এই দু’ধরনের লিপিতে লেখার প্রচলন আছে। বাংলাদেশ ও ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী প্রায় ১০ লক্ষ ত্রিপুরা ককবরফ ভাষায় কথা বলে। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশে ১৬টি গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে উপভাষা ভেদ রয়েছে। অনেক আগে থেকেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরফ ভাষা বাংলা হরফে লিখিত হয়ে আসছে। প্রায় একশ বছর আগে ককবরকের ব্যাকরণ রচিত হয়েছে।
খাসিÑবাংলাদেশের সিলেটের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসরত মঙ্গোলয়েড খায়িয়া বা খাসি জাতির ভাষার নাম খাসি ভাষা যার স্থানীয় নাম ‘খাসিয়া’। বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানী খাসি ভাষার সাথে মিয়ানমারের মোঁয়ে, পলং এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীর ভাষার মিল লক্ষ করেছেন। বর্তমান খাসি ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়। ১৮১২ সালে খ্রিস্টান ধর্মযাজক কৃষ্ণচন্দ্র পাল প্রথম বাংলা বর্ণমালায় খাসি ভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট অনুবাদ করেন।
গারোÑবাংলাদেশের ময়মনসিংহ, মধুপুরের গারো পাহাড়ঘেঁষা অঞ্চল ও সিলেটে গারো বা মান্দিদের বসবাস। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অনুসারী মান্দি নৃগোষ্ঠীর ভাষার নাম ‘আচিক’ বা ‘মান্দি’। গারো ভাষা তিব্বতি-বর্মি ভাষাগোষ্ঠীর ‘বোড়ো’ উপপরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মান্দিদের মোট ১৩টি গোত্রের মধ্যে বাংলাদেশে সাতটি গোত্রের কথা জানা যায়। গোত্রভেদে মান্দিদের আলাদা আলাদা উপভাষার অস্তিত্ব থাকলেও এ ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। জন থুসিন রিসিল, ডানিয়েল আর রুরাম, মার্টিন রেমা, প্রদীপ সাংমাÑএই চারজন গবেষক আলাদা আলাদা গবেষণার মাধ্যমে চার ধরনের বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছেন। বর্তমানে এ ভাষাটি লিখতে প্রধানত রোমান এবং সীমিত পর্যায়ে বাংলা হরফের প্রয়োগ হচ্ছে।
চাকÑবাংলাদেশ চাক জনগোষ্ঠীর বসবাস মূলত বান্দরবান জেলায়। চাকরা যে ভাষায় কথা বলে সেটি চাক ভাষা নামে পরিচিত। ‘তু’ নামের এ ভাষা চীনা-তিব্বতি পরিবারের সদস্য। জর্জ গ্রিয়ারসনের মতে, মনিপুরের আন্দো, সেংমাই এবং বাইরেল উপভাষার সাথে চাক ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। এই ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, মূলত টোনাল ও সুর প্রধান এ ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সাকলুইশ গোত্রভুক্ত। বাংলার সাথে চাক ভাষার অনেক মিল রয়েছে।
বমÑবাংলাদেশে চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ও রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে বসবাসরত বম নৃগোষ্ঠীরা একাধিক নামে পরিচিত, যেমন-বম, বন, বাউন, বোনজোগি, বঙ ইত্যাদি। বমরা যে ভাষায় কথা বলে তার নাম বম ভাষা। এ ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের কুকি-চিন-নাগা শাখার অন্তর্ভুক্ত। ১৮৯৪ সালে রেভারেন্ড জে এইচ লরেইন ও রেভারেন্ড এফ ডব্লিউ স্যাবেজ আইজলে রোমান বর্ণমালা অনুসরণে একটি লিপির প্রবর্তন করেন। এ বর্ণমালায় ২৫টি রোমান বর্ণ ব্যবহার করা হয়। বমদের নিজস্ব ভাষায় বাইবেল অনুদিত হয়েছে।
মারমাÑবাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী মারমাই গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার নাম ‘মারমাচাঘা’। এ ভাষা তিব্বতি-বর্মি শাখার বর্মি দলভুক্ত। ১৩টি স্বরবর্ণ ও ৩৬টি ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে গঠিত মারমা ভাষার নিজস্ব লিপির নাম ‘ম্রাইমাজা’। মারমা সমাজে সংগীত ও গীতিনাট্যে মারমা লিপির ব্যবহার সুপ্রাচীন।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিÑবাংলাদেশে মূলত সিলেট বিভাগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার প্রচলন আছে। এই ভাষার দু’টি উপভাষার একটি ‘রাজার গাঙ’, অর্থাৎ ‘রাজার গ্রাম’, আরেকটি ‘মাদাই গাঙ’ অর্থাৎ ‘রানির গ্রাম’। কে পি সিনহার মতে, ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে ইন্দো-আর্যভাষা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার উদ্ভব হয়েছে। শুরুতে এ ভাষা ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত ছিল। বাংলা ও অহমিয়ার সাথে এ ভাষার সাদৃশ্য থাকায় একে বাংলা বা অহমিয়ার উপভাষাও বলা হয়ে থাকে। বিষ্ণুপ্রিয় মণিপুরি ভাষা এ যাবৎ সংগৃহীত ৩০ হাজার শব্দ সম্ভারের মধ্যে তৎসম শব্দ ১০,০০০, অর্ধ-তৎসম-১,৫০০, তদ্ভব-৮,০০০ এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি শব্দ-২,০০০।
চাকমাÑবাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা ও অবস্থান অনুসারে শীর্ষে থাকা চাকমা বা চাঙমারা নৃতাত্ত্বিকভাবে মঙ্গোলীয় কিন্তু তাদের ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জর্জ গ্রিয়ারসন চাকমা ভাষাকে ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার দক্ষিণপূর্ব উপশাখার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। নিজস্ব বর্ণমালার চাকমা হরফগুলো অনেকটা বর্মী বা খের লিপির মতো। ১৮৬০ সালে খ্রিস্টান মিশনারিরা এলাহাবাদের একটি প্রেস থেকে প্রথম চাকমা লিপিতে বাইবেলের অনুবাদ প্রকাশ করেন। নোয়াবাম চাকমা ১৯৫৯ সালে বাংলা ও চাকমা বর্ণে চাকমার প্রথম শিক্ষা নামে একটি শিশু পাঠ্য বই রচনা করেন। চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র মর থেংগারি।
তঞ্চঙ্গ্যাÑবাংলাদেশের রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এর মূল উৎস ‘মন ভাষা’। তঞ্চঙ্গ্যা লিপির সাথে চাকমার চেয়ে বর্মি লিপির সাদৃশ্য বেশি পাওয়া যায়। বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যাদের দাইনাক বর্ণমালাকে ‘ছালাম্যা’ বলা হয় যার অর্থ ‘গোলাকার’।
রাখাইনÑপটুয়াখালী, কক্সবাজার, বরগুনা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১৭০০০ লোক রাখাইন ভাষায় কথা বলে। মারমার একটি উপভাষা রাখাইন অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। এই ভাষার বর্ণমালার উৎস ‘উত্তর ব্রাহ্মীলিপি’। রাখাইন ভাষার নিজস্ব বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ‘ছারা’ ১২টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ বা ‘ব্যেঃ’ ৩৩টি।
মৈতৈ মণিপুরি-সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত মৈতৈ মণিপুরি ভাষাভাষীদের মৈতৈ ভাষাকে জর্জ গ্রিয়ারসন ভোট চীন পরিবারভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। টি ডি হাডসন তার ‘দ্য মৈতৈস’ বইয়ে মৈতৈ ভাষাকে তিব্বতি-বর্মী ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অধিকাংশ গবেষকদের মতে, মৈতৈ লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভুত। সপ্তম শতকের একটি ব্রোঞ্জ মুদ্রার ওপর মৈতৈ লিপির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। মণিপুরি লিপির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর প্রতিটি হরফের নাম রাখা হয়েছে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাম অনুসারে।
ম্রো-বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের বান্দরবান জেলাতে বসবাসরত ম্রো নৃগোষ্ঠীর ম্রো ভাষা তিব্বতিÑবর্মিভাষা পরিবারের কুকি-চীন গোত্রভুক্ত। জর্জ গ্রিয়ারসন তার লিংগুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে ম্রো ভাষাকে বর্মি দলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে ম্রো ভাষাবিজ্ঞানী মিনলে ম্রো এই ভাষার বর্ণমালার উদ্ভাবন করেন।
তাছাড়া আরো যেসব ভাষা রয়েছে সেগুলো হলোÑমুন্ডা নৃগোষ্ঠীর মৌখিক ভাষা মুন্ডারী, রবিদাস নৃগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা নাগরি। অসমিয়া, বাংলা, গারো প্রভৃতি ভাষার সংমিশ্রণে তিব্বতীয় বর্মণ ভাষার অন্তর্ভুক্ত কোচ, রানা কর্মকার নামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষা খোট্টা, বর্মন নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব কথ্যভাষা ঠার, উত্তর কুকি চিন দলভুক্ত ভোট চীন ভাষাভাষীর ভাষা পাংখোয়া, বম, খিয়াও মণিপুরি ভাষার সংমিশ্রণে ভাষা লুসাই, ওরাঁওদের ভাষা কুরুক, মাহাতো নৃগোষ্ঠীর ভাষা কুর্মালী এবং প্রায় বিলুপ্ত ভাষা রাজবংশী।
সকল ভাষাভাষির লোকেরই নিজেদের ভাষা বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেষ্ট। ভাষার বিলুপ্তি মানে কেবল একটি ভাষারই মৃত্যু নয়, একটি সংস্কৃতির, একটি মানবগোষ্ঠীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের বিলুপ্তি। তাই ভাষাকে বিকৃত করার মাধ্যমে গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে নিজ নিজ ভাষার প্রতি সকলেরই সচেতন ও যত্নবান হওয়া একান্ত জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক।